ওদের পথ চেয়ে থাকে পরিবার

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস আজ। জাতিসংঘ ঘোষিত অপহরণ, গুম, গুপ্তহত্যা, বিচারবহির্ভূত খুন ও হেফাজতে নির্যাতন, ন্যায়বিচারের সুযোগহীনতার মতো বিষয়গুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের নৃশংসতম ও চরম অপরাধগুলোর অন্যতম। দেশে নানা সময়ে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিরা ফিরে না আসায় অন্তহীন অপেক্ষায় তাদের পরিবারগুলো। এর মধ্যে একজন সাজিদুল ইসলাম সুমন। তার মা হাজেরা খাতুন ছেলে ফিরে আসার প্রহর গুনছেন। কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, আজও আমার মেয়ে নিখোঁজ হওয়া অন্য পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ভাইয়ের সন্ধান চেয়ে ব্যানার হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে। কি বলবো, বলার আর কি আছে। ছেলেকে তো পাইনা।
প্রত্যেক বছর সকলের সঙ্গে প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করি। কান্না করি। রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকি। রাতের বেলা মনে হয় এই বুঝি একটি গাড়ি এসে ছেলেকে নামিয়ে দিয়ে গেছে। কি যে অস্থিরতা কাজ করে বোঝাতে পারবো না। ছাদে যাই। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি ছেলে আসে না কি। বাসার পাশ দিয়ে বড় গাড়ি আসলে গেইট খুলে তাকিয়ে থাকি। ছেলেকে কেউ ফেলে রেখে গেলো মনে হয়। ছেলেতো আর ফিরে আসে না। কি করলে ছেলেকে পাবো সেটাই বুঝতে পারছি না। প্রথম পাঁচ বছর প্রত্যেক দিনই থানায় গিয়েছি। কখনো পুলিশ দেখা করে কখনো করে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সকলের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। কি করবো। কোথায় গেলে, কার কাছে ছেলেকে পাবো?
নিখোঁজ হওয়া সেন্টুর স্ত্রী লাভলী আক্তার বলেন, গত সাত বছর ধরে সে নিখোঁজ। ২০১৪ সালে কোর্ট এলাকায় আমার সামনে থেকে তাকে র? র‍্যাব পরিচয়ে ধরে নিয়ে যায়। তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে থাকি। থানায় মামলা করলে সেখান থেকে পুলিশ মামলা ডিবিতে ট্রান্সফার করে দেয়। আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেখান থেকে সিআইডিতে ট্রান্সফার করা হয়। পরবর্তীতে ডিবিতে ডাকা হয়। গত বছর গুমের মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় তারা। তখন সিআইডি থেকে বলা হয়, তিনি গুম হয়েছেন এটা সত্য। কিন্তু এটার সঙ্গে কে বা কারা জড়িত সেটা আমরা খুঁজে পাইনি। তিনি বলেন, যারাই আমাদের মতো এই অবস্থায় আছেন তাদের অন্তত সঠিক তথ্যটা দেয়া হোক। তারা কি আছে, না নেই? এ বিষয়টি আমাদের কাছে স্বচ্ছ হওয়া উচিৎ। কারণ, সন্তানকে কিছু বলতে পারিনা। নাই এটা বলা যায়। কিন্তু সে আছে না নাই এটা নিজেই তো জানিনা। সন্তানকে মিথ্যা বলবো তোমার বাবা নেই। কিন্তু এক সময় সে তো ফেরত আসতেও পারেন। আমার চাওয়া যতোগুলো গুমের মামলা আছে সরকারের তরফ থেকে পুনরায় তদন্ত করা হোক। আমাদেরকে জানানো হোক তাদের বর্তমান অবস্থা কি?
শিক্ষার্থী মাজহারুল ইসলাম রাসেলের বাবা আমিনুল হক বলেন, রাসেল ২০১৩ সালে নিখোঁজ হয়। ছেলেকে হারিয়ে আমরা অর্ধমৃত অবস্থায় আছি। ভালো নেই। ছেলেকে ছাড়া মা-বাবা যেমন থাকার কথা সেভাবে বেঁচে আছি। রাসেল স্নাতকোত্তর শেষ করে বিসিএস পরীক্ষায় প্রিলিতে উত্তীর্ণ হয়েছিল। নাখালপাড়ার বাসা থেকে ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কোচিং করতে যাওয়ার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরিচয়ে তাকে তুলে নিয়ে যায়। সে ছাত্রদল করতো। এটা ছিল তার বড় দোষ। তিন ভাই-বোনের মধ্যে রাসেল ছিল মেজ। রাসেল থাকলে এখন হয়তো বিসিএসে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়ে প্রশাসনিক বড় কোনো পদে চাকরি করতো। গুম দিবসে একটি কথাই বলার আছে, ছেলে যদি বেঁচে থাকে তাহলে তাকে ফেরত চাই। যদি না থাকে তাহলে কীভাবে নেই, কেন নেই এটা জানতে চাই। তার মা ছেলেকে হারিয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এটাই চাওয়া ছেলে বেঁচে থাকলে ফেরত দিন। যদিও নেই কথাটি আমার অন্তরে আসে না। কি অন্যায় সে করেছিল। ছেলে বেঁচে থাকলে আমার এবং তার মায়ের জীবন বাঁচানোর জন্য অন্তত তাকে ফেরত দেয়া হোক।
নিখোঁজ হওয়া চঞ্চলের স্ত্রী রেশমা আক্তার জানান, স্বামীর শোকে শরীরে অনেক রোগ বাসা বেঁধেছে। ছেলেও অসুস্থ। আগামী ২রা ডিসেম্বর চঞ্চল নিখোঁজের সাত বছর পূর্ণ হবে। ২০১৩ সালে নিখোঁজ হয় সে। এটাকে ওভাবে নিখোঁজ বলতে চাই না। কারণ তাকে প্রকাশ্যে দিনের আলোয় সবার সামনে শাহবাগের শিশুপার্ক এলাকা থেকে তুলে নেয়া হয়। সে যাওয়ার পর থেকে আর সুস্থ নেই। চিকিৎসকের কাছে নিয়মিত যেতে হয়। মানসিকভাবেও ভালো নেই। আর্থিকভাবেও সমস্যায় আছি। ঘরের কর্তা না থাকলে তার পরিবারের সদস্যরা কেমন থাকে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। একমাত্র ছেলে আব্দুল আহাদের ১০ বছর পূর্ণ হয়েছে। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে সে। আমাদের স্বজনরা যেভাবেই আছে তাদের ফিরিয়ে দেয়া হোক। দেশে আইন আছে। আইনের শাসন আছে। গত সাত বছর ধরে বলছি। আর কতো বলবো। গুম হওয়াদের অনেকের পরিবারের অনেক সদস্য কারো বাবা, মা, আপনজন স্বজন হারানোর শোকে মারা গেছেন। একদিন শুনবেন আমরাও মারা গেছি। মনে হয় এটাই হবে। ছেলের খুব ইচ্ছা বাবাকে দেখবে। কিন্তু বাবাকে তো পাই না। ছেলেকে নিয়ে বংশালে শ্বশুরের বাসায় আছি।