বার্সার এত বড় পরাজয়ের পেছনের কারণ কি?

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ এমনটা যেন হওয়ারই ছিল। কোচ সিসে সেতিয়েনের সঙ্গে বিরোধের সূত্রপাত সেই করোনাকালের আগে থেকেই। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের দ্বিতীয় রাউন্ডের প্রথম ম্যাচে ন্যাপোলির সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করার পরই কোচ সম্পর্কে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছিলেন মেসি। বলে দিয়েছিলেন, এভাবে খেলতে থাকলে কিছুই জেতা সম্ভব হবে না। শেষ পর্যন্ত সেটাই হলো। কিন্তু শেষটা যে এত বাজে হবে, কে জানতো? বায়ার্ন মিউনিখের চেয়ে তো কোনো অংশে কম নয় বার্সেলোনা! তাতেও কেন ৮-২ গোলে হারতে হবে বার্সাকে? ১৪ বছর পর এই প্রথম কোনো ট্রফি ছাড়াই মৌসুম শেষ করলো বার্সা। মেসির ক্যারিয়ারে তো এতবড় পরাজয় আর নেই। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নকআউটে এত বড় ব্যবধানও এই প্রথম।
লা লিগা, স্প্যানিশ সুপার কাপ, কোপা দেল রে কিংবা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ- কিছুই জেতা হলো না বার্সার। মেসির মত বিশ্বসেরা ফুটবলার থাকারও পরও কেন এত বড় বিপর্যয়? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে শুরু করেছে সবাই। পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে লিওনেল মেসির বার্সেলোনাকে নিয়ে স্রেফ ছেলেখেলা করল বায়ার্ন। জার্মান-ক্লাবটির এমন দৌরাত্ম্য বিশ্বাস করতে পারছেন না ফুটবল বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ঐতিহাসিক ছাড়া এই ম্যাচ কী বলা যায়? বার্সাকে গুঁড়িয়ে দিল বায়ার্ন।’ মেসির চোখ ঝলসানো স্কিল, সুয়ারেজের গোল খিদে নিয়ে কত আলোচনা হয়, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু জার্মান-ধাঁধার সমাধান করা সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে।
১০ বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার কোচ ছিলেন দিয়েগো ম্যারাডোনা। ‘এল দিয়েগো’র দল সেবারের বিশ্বকাপে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলেছিল; কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে নীল-সাদা জার্সিধারীরা বিবর্ণ হয়ে যায় জার্মানির সামনে এসে। ম্যাচের আগে সংবাদ সম্মেলনে ম্যারাডোনা পর্যন্ত জার্মানদের বিরুদ্ধে মনস্তাত্বিক যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছিলেন। জার্মানির মাঝমাঠের প্রাণভোমরা বাস্তেইন সোয়েইনস্টাইগারকে উদ্দেশ্য করে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘সোয়েইনস্টাইগার, আর ইউ নার্ভাস?’ মাঠে নেমে আর্জেন্তিনাকে ০-৪ গোলে উড়িয়ে দেন থমাস মুলার আর সোয়েনস্টাইগাররা। চার বছর পরের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ঘরের মাঠে জার্মানি ৭-১ গোলে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয় স্বাগতিক সেলেকাওদের। দুঃস্বপ্নের সেই রাত আজও ভোলেননি ৫ বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলিয়ানরা। শুক্রবার রাতে বায়ার্ন মেসিদের ভেঙেচুরে শেষ করে দেয়। ৩১ মিনিটের মধ্যেই ৪-১! তখনই ম্যাচ পকেটে নিয়ে ফেলেছিল বায়ার্ন। নব্বই মিনিটের শেষে সেটাই হয়ে যায় ৮-২। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘জার্মানদের অভিধানে রিল্যাক্স বলে কোনও শব্দ নেই। বার্সেলোনাকে দেখে কেমন যেন ছন্নছাড়া মনে হয়েছে।’ একটা সময়ে স্পেনের ‘তিকিতাকা’ ফুটবল বিশ্বজুড়ে বিপ্লব ঘটিয়েছিল। পাসিং ফুটবলের বিচ্ছুরণ দেখা যেত স্পেনের বিশ্বজয়ী দলের ফুটবলে। পাস খেলতে খেলতেই গোটা দলটা এগিয়ে যেত। ব্রাজিলের ফুটবলে আবার শিল্পের গন্ধ। জার্মানরা দেখিয়ে দিচ্ছে অন্য রাস্তা। বিশেষজ্ঞরা লিখছেন, ‘বল পজেশন কার বেশি, তা এখন আর বিবেচ্য নয়। আসল কথা হল গোল। গোলের কাছে কে কত তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে পারে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। জার্মানরা সেটাই প্রমাণ করে আসছে।’ ফুটবলে স্পেস আর সময় সমার্থক। কোনও ফুটবলারকে জায়গা দিয়ে দেওয়া আর সময় দিয়ে দেওয়া একই ব্যাপার। মেসি-রোনালদোদের মতো সৃজনশীল ফুটবলারদের জায়গা দিয়ে দিলে কী হয়, সেটা সবাই জানেন। জার্মান ক্লাব বা জাতীয় দলের বিরুদ্ধে কিন্তু এই জায়গা সহজে পাওয়া যায় না। মেসি-রোনালদোদের বিচরণ করার জায়গাটা বন্ধ করে দেয় জার্মানরা। শুধুমাত্র ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দিয়ে এসব দলের সঙ্গে এঁটে ওঠা কঠিন। শুক্রবার রাতে ম্যাচ চলাকালীন অনেকেই বলছিলেন, বার্সার মাঝমাঠ বলে কিছু নেই। জাভি-ইনিয়েস্তারা বুট জোড়া তুলে রেখেছেন। পাসিং ফুটবলকে অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন মাঝমাঠের দুই নেতা। জাভি-ইনিয়েস্তা প্রসঙ্গে শোনা যায়, অনুশীলনে দু’জন যখন নিজেদের মধ্যে বল পাস করার অনুশীলন করতেন, সেই শব্দ শুনে তাদের কোচ বুঝে যেতেন দুই শিল্পী সাধনায় মেতে উঠেছেন। মাঠে নেমে ফুল ফোটাতেন জাভি-ইনিয়েস্তা। তাদের পাশে পেয়ে মেসি হয়ে উঠতেন আরও ভয়ঙ্কর। ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যেতেন ‘এলএম টেন’।
বার্সার সেই সোনায় মোড়ানো মাঝমাঠ কোথায় এখন? কোথায় সেই পাসিং ফুটবলের ঝলকানি? জাভি-ইনিয়েস্তার অভাবে বহুদিন ধরেই বার্সার মাঝমাঠে দেখা যাচ্ছে। শুক্রবার হাহাকার দেখা দেয়। মেসির বিরুদ্ধে এক সময়ে খেলা সাবেক স্প্যানিশ ফুটবলার টনি ডোভালে বলছেন, ‘জাভি-ইনিয়েস্তার অভাব পূরণ করতে পারেনি বার্সেলোনা। আর সেটা সম্ভবও নয়। ওদের অভাবটা প্রতি মুহূর্তে অনুভূত হচ্ছে।’ জাভি-ইনিয়েস্তার মতো সৃজনশীল ফুটবলারের অভাবেই কি মেসিকে নিষ্প্রভ দেখিয়েছে? বার্সায় মেসি ম্যাজিক দেখান। কিন্তু জাতীয় দলের হয়ে আর্জেন্তাইন মহানায়ক সেই কক্ষপথে হাঁটতে পারেন না। নিন্দুকরা বলতেন, বন্যেরা বনে সুন্দর, মেসি সুন্দর বার্সেলোনায়। সেই মেসি শুক্রবার রাতে মাঠে ছিলেন কি না, সেটাই ভাল করে বোঝা যায়নি বায়ার্নের দাপটে। টনি বলছেন, ‘মেসি বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই। যে কোনও মুহূর্তে ও ম্যাচের রং বদলে দিতে পারে। তবে ওকে সাপোর্ট দেওয়ার মতো ফুটবলারও তো দরকার। বার্সেলোনায় যে সাপোর্ট আগে পেত মেসি, সেটা এখন আর পাচ্ছে না। জাভি-ইনিয়েস্তার বিকল্প পাওয়া বার্সার পক্ষে কঠিন।’ আবার অতিরিক্ত মেসি নির্ভরতাও কাল হয়েছে বার্সার। মেসিকে যখন বায়ার্ন আটকে দিচ্ছে বারবার, তখন অন্য কেউ সেই জায়গাটা নিতে পারছিল না। সুয়ারেজ উপরে খেলেন। তাকে বল দিতে হয়। সেই বলটা দেবেন কে? মেসি বোতলবন্দী। সুতরাং, মেসি নির্ভরতা না কমানো পর্যন্ত বার্সারও মুক্তি মিলবে না। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বার্সার এই বিপর্যয় প্রমাণ করছে, দলে ব্যাপক পরিবর্তন দরকার। সবার আগে কোপ পড়ছে কোচ সেতিয়েনের উপরে; কিন্তু বার্সা প্রেসিডেন্ট বাতোম্যু চেয়ার ছাড়বেন না। সব জায়গাতেই একই ছবি। দল হারলে ‘ঘ্যাচাং ফু’ হন কোচই।