পেট্রাপোল থেকে পণ্য আনতে সময় লাগছে ১০ দিন

0

স্টাফ রিপোর্টার॥ জায়গা সঙ্কটে বেনাপোল স্থলবন্দরে পণ্যজট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে একটি ট্রাক ভারত থেকে প্রবেশ করে পণ্য খালাস করার পর আরেকটি প্রবেশ করছে। আবার অনেকে দীর্ঘদিন বসে থাকার কারণে পণ্য নিয়ে আসতে চাচ্ছেন না। বন্দর কর্মকর্তারা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে বন্দর দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর শুধুমাত্র জুলাই মাসে প্রায় দেড় লাখ মেট্রিক টন পণ্য ও চলতি আগস্ট মাসের ১০ দিনে ৪৩ হাজার মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয়েছে। যে কারণে বন্দরে পণ্য রাখার জায়গা নেই।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্থল বাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম হচ্ছে বেনাপোল স্থলবন্দর। এই বন্দর দিয়ে বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি-রফতানি হয়ে থাকে। দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি। এ কারণে ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য বেনাপোল স্থলবন্দর অনুপযোগী হতে চলেছে। এখানে পণ্যজট অসহনীয়। বন্দরে ট্রাকজটও পীড়াদায়ক। আর পণ্য লোড-আনলোডের জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম নেই এখানে। বেনাপোল স্থলবন্দরে আসা পণ্য লোড-আনলোডের জন্য মাত্র ছয়টি ক্রেন ও পাঁচটি ফর্কলিফট রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ যন্ত্রপাতি অচল অবস্থায় থাকে বলে অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। অচল সরঞ্জাম দিয়ে বেসরকারি একটি সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। যার মেয়াদ শেষ হলেও নতুন করে টেন্ডার দিচ্ছে না বন্দর কর্তৃপক্ষ। বেনাপোল বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ১২ লাখ ৮৮ হাজার ৯৩৮ মেট্রিক টন পণ্য, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩১৯ মেট্রিক টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৯ লাখ ৮৮ হাজার ৩৫৭ মেট্রিক টন ও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২১ লাখ ৮১ হাজার ১২৩ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি করা হয়। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ১৯ লাখ ৭৭ হাজার ৭৪ মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছে।
জানা গেছে, বেনাপোল বন্দরে ৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে। বর্তমানে বন্দরে ৩২টি শেড ও ১০টি ইয়ার্ড রয়েছে। যেখানে পণ্য ধারণ ক্ষমতা মাত্র ৫১ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমানে বন্দরটিতে এক লাখ মেট্রিক টনের বেশি পণ্য রয়েছে। জায়গা সঙ্কটের জন্য অনেক পণ্য রাখা যাচ্ছে না। ভারতীয় ট্রাকগুলো পণ্য নিয়ে দিনের পর দিন বসে আছে। বন্দরে জায়গা না থাকায় আনলোড করতে পারছে না। বাইরে যত্রতত্রভাবে ফেলে রাখা হচ্ছে এসব পণ্য। এতে করে পণ্য চুরিসহ নানাভাবে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন আমদানিকারকরা। ভারত থেকে আসা সাড়ে ৪শ থেকে ৫শ পণ্যবোঝাই ট্রাক বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিদিন বাংলাদেশে প্রবেশ করার কথা। কিন্তু জুলাই মাসে প্রবেশ করেছে ৪ থেকে ৫শ গাড়ি। এখনও বেনাপোলের বিপরীতে পেট্রাপোল ও বনগাঁর কালিতলা পাকিংয়ে অপেক্ষা করছে কয়েক হাজার ট্রাক। ইন্দো-বাংলা চেম্বার অব কমার্স সাব কমিটির পরিচালক মতিয়ার রহমান জানান, বেনাপোল বন্দরে জায়গা সঙ্কট দীর্ঘদিনের। আমরা বারবার জায়গা বাড়ানোর দাবি করলেও কেউ শুনছেন না। বন্দরে জায়গা সঙ্কটের কারণে পেট্রাপোলে হাজারো পণ্যবাহী ট্রাক দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেখানে তারা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে। এখন সময় এসেছে বন্দরের আশপাশে বেসরকারিভাবে ওয়্যার হাউস নির্মাণ ও আইসিটি গড়ে তুলতে হবে।
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান বলেন, বেনাপোলে প্রবেশের অপেক্ষায় পণ্যবাহী ট্রাক পেট্রাপোলে দাঁড়িয়ে থাকে বলে সঠিক সময় ওই আমদানি পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। আবার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে প্রতিদিন তিন হাজার টাকা অতিরিক্ত গুনতে হয়। কোনো কোনো ট্রাক ১০ দিনও পেট্রাপোলে দাঁড়িয়ে থাকছে। অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে বলেই ব্যবসায় লোকসান হচ্ছে। এর সঙ্গে নষ্ট হচ্ছে আমদানি করা পণ্য ও মূল্যবান সময়। চট্টগ্রামের বিএসআরএমের নির্বাহী পরিচালক তপন সেন গুপ্ত বলেন, করোনার মধ্যে পণ্য আমদানি বাড়ায় বেনাপোলে জট লেগেছে। আমরা ১০ দিন পর সোমবার (১০ আগস্ট) পণ্য খালাস করতে পেরেছি। তবে অন্য সময় খালাস প্রক্রিয়া স্বাভাবিক থাকে।
যশোর মোটর পার্টস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও আমদানিকারক শাহিনুর হোসেন জানান, বর্তমানে বেনাপোলে পণ্যজট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ওপার থেকে বেনাপোলে প্রবেশ করতে ১০ দিন সময় লাগছে। আবার তাড়াহুড়া করে পণ্য খালাস করায় অনেক সময় পণ্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মফিজুর রহমান সজন বলেন, বেনাপোল স্থলবন্দর দেশের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। স্থলবন্দরটি খুবই অচলাবস্থার মধ্যে দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। ধীরে ধীরে বন্দরটি ব্যবসায়িক কার্যক্রমের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এই বন্দরকে আরও গতিশীল করে তোলার জন্য প্রথমেই জায়গা সঙ্কট দূর করতে হবে। জায়গা সঙ্কটের কারণে অনেক পণ্য রাখা যাচ্ছে না। এখন একটি ট্রাক খালাসের পর আরেকটি প্রবেশ করছে। এ কারণে ভারতের পেট্রাপোল বন্দর থেকে আমদানিকৃত পণ্য নিয়ে ট্রাককে বেনাপোলে প্রবেশের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। এখনও বেনাপোলে প্রবেশের অপেক্ষায় পেট্রাপোলে কয়েক হাজার ট্রাক লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি বলেন, বেনাপোল স্থলবন্দরকে বাণিজ্যের উপযোগী করে তুলতে এর ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি নির্মাণ করতে হবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো। বাড়াতে হবে বন্দরের যন্ত্রপাতি। এ বিষয়ে সরকার যদি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে বন্দরটি শিগগিরই অচল হয়ে পড়বে।
এ বিষয়ে বেনাপোল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের উপপরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবির তরফদার বলেন, বন্দরের জায়গা সঙ্কট ও যন্ত্রপাতি স্বল্পতার বিষয়ে ব্যবসায়ীরা আমাদের জানিয়েছেন। এই সমস্যাগুলো সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ইতোমধ্যে আমাদের ৮৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বৃহৎ দুটি ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে। এতে পণ্য ধারণ ক্ষমতা বেড়েছে। ২৫ একর জায়গা আমরা অধিগ্রহণ করেছি। আরও সাড়ে ১৬ একর অধিগ্রহণের প্রস্তাবনা রয়েছে। শিগগিরই ২৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে বোনপোলে কার্গো ভেহিক্যাল টার্মিনাল স্থাপনের কাজ শুরু হবে। ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সিসি টিভি স্থাপন করা হবে। এসব বাস্তবায়ন হলে এই বন্দরে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। তিনি বলেন, করোনার কারণে সব কিছু বন্ধ থাকার পর এখন আমদানি বেড়েছে। গেল জুলাই মাসে পণ্য আমদানি হয়েছে এক লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। আর চলতি আগস্ট মাসের ১০ দিনে আমদানি হয়েছে ৪৩ হাজার মেট্রিক টন। যে কারণে পণ্যজট লেগেছে। তবে আগামী ৮-১০ দিনের মধ্যে পণ্য খালাস হয়ে গেলে জায়গা কিছুটা বেড়ে যাবে।