‘সেদিন দুপুর থেকেই ফোর্স নিয়ে মেরিন ড্রাইভে অবস্থান করছিলেন ইন্সপেক্টর লিয়াকত’

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ কক্সবাজারের টেকনাফ মেরিনড্রাইভের যে চেকপোস্টে গত ৩১ জুলাই পুলিশের গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ নিহত হন সেটি বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের চেকপোস্ট ছিল না। এটি ছিল আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)-১৬ এর চেকপোস্ট। তবে এটিতে অভিযান চালানোর জন্য পুলিশ সুপারের অনুমতি আগেই নিয়েছিল অভিযানকারী বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইন্সপেক্টর (আইসি) লিয়াকত আলী।
মেজর (অব.) সিনহার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ঘটনাটি পূর্ব পরিকল্পিত ছিল বলেই স্থানীয়দের দাবি। কারণ, ওই তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্ব নেওয়ার পর কখনোই চেকপোস্টে না দাঁড়ালেও সেদিন ঘটনার ৬ ঘণ্টা আগেই বিকাল ৩টার দিকে চেকপোস্টের ২০ গজ দূরে অবস্থান নেন ইন্সপেক্টর লিয়াকত ও তার টিম। তাকে সেখানে ওইদিন অনেকেই দেখেছেন। ওই চেকপোস্টের পাশের একটি দোকানে দুপুরের আহার সারেন তারা। ইন্সপেক্টর লিয়াকতকে সড়কে দাঁড়াতে ও সারাণ ফোনে ব্যস্ত থাকতে দেখে স্থানীয়রা বুঝতে পারেন এখানে বড় কিছু ঘটতে যাচ্ছে। এমন তথ্য বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও রয়েছে বলে একটি বিশ্বস্ত সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা গেছে, সিনহাকে যে চেকপোস্টে গুলি করা হয়, তা বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের অধীনে ছিল না। সেটি ছিল আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ১৬’র চেকপোস্ট। এই চেকপোস্টেই তদন্তকেন্দ্রের কর্মকর্তার গুলিতে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ নিহত হন। বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের চেকপোস্ট। মূল সড়কে থাকা এপিবিএন এর চেকপোস্টের ঢাল দিয়ে নেমে দেড় কিলোমিটার ভেতরে এই চেকপোস্টের অবস্থান। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজারের ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) মো. হেমায়েতুল ইসলাম বলেন, যে চেকপোস্টে ঘটনা ঘটেছিল, তা এপিবিএনের ছিল। বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলী তাদের লোকজনকে ফোন করে বলেছিলেন, একটি গাড়ি আসবে, তা যেন থামানো হয়। তাদের লোকজন ওই রঙের গাড়িটিকে সিগন্যাল দিলেও সেটি থামেনি। ততণে লিয়াকত আলী চেকপোস্টে চলে আসেন। তিনি একটু সামনে গিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে গাড়িটি থামান। ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পানের দোকান করেন মো. রফিক। এই পান দোকানদার বলেন, ‘সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার ঘটনার দিন বিকেল ৩ টার দিকে টেকনাফের বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর (আইসি) লিয়াকত আলীর নেতৃত্বে একটি সাদা নোয়া গাড়ি নিয়ে পুলিশের একটি দল মেরিন ড্রাইভে ঘটনাস্থল থেকে ২০ গজ দূরে অবস্থান করছিল। আইসি লিয়াকতকে হঠাৎ এই চেকপোস্টে দাঁড়াতে দেখে তারসহ অনেকের কৌতুহল জাগে। কারণ, বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তাকে এর আগে কখনও সেখানে দাঁড়াতে দেখেননি তারা। তবে তাকে সবাই চেনেন। সেসময় ওই ঘটনাস্থলে তাকে মোবাইল ফোনে খুবই ব্যস্ত দেখা গেছে।’ পান দোকানদার মো. রফিক বলেন, ‘‘কয়েক ঘণ্টা ধরে তাকে (ইন্সপেক্টার লিয়াকত) সেখানে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখা গেছে। সেই দিন পুলিশের মেস ম্যানেজারসহ অন্য পুলিশ সদস্যদেরও তৎপর দেখা গেছে। বিষয়টি দেখে স্থানীয় লোকজনও কিছু একটা হবে বুঝতে পেরে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল আর পুলিশের গতিবিধি খেয়াল করছিল। এছাড়া ঘটনাস্থলের পাশে ‘সিরাজ ভাত ঘর’ নামে একটি হোটেলে আরও ৬-৭ জন পুলিশ সদস্য দুপুর থেকে অবস্থান করছিল। এর আগে কখনও সেই দোকানে পুলিশের যাওয়া আসা ছিল না। পরে তারা একটি মাছের আড়ত থেকে ইলিশ মাছ এনে রান্না করে নিয়ে সেইখানে খাবারও খান। এতে আমাদের মতো অনেকেই- যারা এই চেকপোস্টে পুলিশের কাজকর্ম নিত্যদিন দেখেন তারা ধারণা করেন এখানে আজ বড় অভিযান হবে। এসময় দোকানে আসা লোকজনও পুলিশের আজ বড় অভিযান হতে পারে এমনটা বলাবলি করছিল। তবে পুলিশের কাছে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে দেখা যায়নি। তদন্ত কর্মকর্তা লিয়াকতও কিছু কাউকে বলেননি। এরপর যে যার মতো ছিল। কারণ দিনে কিছু ঘটেনি। রাতে যখন গুলির আওয়াজ পাই তখন দিনে পুলিশের তৎপরতা মনে পড়ে। ভেবেছিলাম ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ঘটেছিল। রাতে সেখানে ছিলাম না।’ তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রত্যদর্শী বলেন ‘রাত ৯ টার পরে লোকজন জড়ো হয়ে আলোচনা করছিল। এই সময় তাদের সঙ্গে আমি যোগ দেই। পরে মেরিনড্রাইভে দেখতে পাই কয়েকজন পুলিশ সদস্য উঁচু করে দুই হাত তোলা অবস্থায় একটা লোককে ঘিরে রাখে। হঠাৎ করে গুলি করে। পরপর কয়েকটা গুলির শব্দ শুনা যায়। এর ১০-১২ মিনিট পর দুটি সাদা গাড়ি আসে। একটাতে ছিলেন ওসি প্রদীপ। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে লাথি মারেন ওসি। এসময় মানুষকে দেখিয়ে বলেন, ‘দেখেন এইটি বেয়াদবের শাস্তি।’ তবে ওসির উপস্থিতির কথা অন্য কোনও প্রত্যদর্শীর কাছ থেকে শোনা যায়নি। ঈদের আগের দিনের ঘটনা হওয়ায় সেদিন রাস্তা একেবারে ফাঁকা ছিল না। মানুষজনের চলাচল ছিল। সেদিন টেকনাফ বাজার থেকে ঈদের শপিং করে বিকালে ঘরে ফিরছিলেন একজন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার ঘটনাস্থলের কাছাকাছি ইন্সপেক্টর (আইসি) লিয়াকতসহ পুলিশের বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে দেখে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। এরপর এলাকায় এসে দেখি মেস ম্যানজার মোটরসাইকেল নিয়ে বেশ ব্যস্ত ছিল। আমারও মনে হয়েছিল আজ হয়তো এখানে কোনও একটা ঘটনা হতে যাচ্ছে। কেননা সেই দিন পুলিশের যে অবস্থা চোখে পড়েছে সেটি সন্দেহজনক। রাত ৯টার পরে যখন শুনি মেরিন ড্রাইভে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা তখন নিশ্চিত হই, এ ঘটনার জন্য পুলিশ দৌড়ের ওপর ছিল।’ প্রসঙ্গত: গত ৩১ জুলাই ঈদের আগের রাতে টেকনাফের একটি পুলিশ চেকপোস্টে পরিচয় দেওয়ার পরেও মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় সেনাবাহিনী ও পুলিশবাহিনীর মধ্যে সম্পর্কের েেত্র টানাপড়েনের সৃষ্টি হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি উচ্চ পয়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে। নিহত মেজরের মাকে সান্ত্বনা দিয়ে ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর সেনাপ্রধান ও পুলিশের মহাপরিচালক একত্রে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা উল্লেখ করে দায়ীদের আইন অনুযায়ী বিচারের কথা বলেন। নিহত মেজরের বোন আদালতে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করলে আদালত টেকনাফ থানাকে মামলা গ্রহণের আদেশ দেন। মামলা হওয়ার আগেই থানা থেকে ওসি প্রদীপকে প্রত্যাহার করা হয়। এর পরদিন ওসিসহ ৭ আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাদের জামিন না মঞ্জুর হয়। আদালত ওসিসহ তিন জনের ৭ দিনের রিমান্ড এবং গ্রেফতার বাকি চার জনকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন। পলাতক বাকি দুজনকেও আত্মসমর্পণ না করলে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ হত্যা মামলায় গ্রেফতার সাত পুলিশ সদস্যকে শুক্রবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্ত হওয়া পুলিশ সদস্যরা হলেন প্রত্যাহার হওয়া ওসি প্রদীপ, সিনহাকে গুলি করা হত্যাকারী পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলী, উপপরিদর্শক নন্দ দুলাল রতি, সহকারী উপপরিদর্শক লিটন মিয়া এবং কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আবদুল্লাহ আল মামুন। ওসি প্রদীপ গ্রেফতার হওয়ার পরই তার অত্যাচারের বিষয়ে এখন টেকনাফের সাধারণ মানুষ মুখ খুলতে শুরু করেছে। অপরাধ করলেও তাদের কাছে ঘুষ আদায় ও বিনা বিচারে তাদের ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করা নিয়েই ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ। এদের কেউ কেউ মামলা করারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।