ভোক্তা অধিকারের কথা আইনে থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন

0
ইকতেদার আহমেদ
সাধারণ অর্থে ‘ভোক্তা’ বলতে আমরা বুঝি এমন কোনো ব্যক্তি যিনি নিজ প্রয়োজন ও ব্যবহারের উদ্দেশ্যে পণ্য ক্রয় করেন। একজন ভোক্তার পণ্য ক্রয়ের মধ্যে কোনো ধরনের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য থাকে না। ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ যেকোনো দেশের সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। ব্যবসায়ীরা সবসময়ই লাভ বা মুনাফার উদ্দেশ্যে ব্যবসা করেন। যেকোনো ব্যবসায়ী যুক্তিসঙ্গত মুনাফা বা লাভের বিনিময়ে, ক্রেতার স্বার্থের হানি না ঘটিয়ে যদি ব্যবসা করেন সে ক্ষেত্রে একজন ক্রেতার ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আমাদের দেশে ব্যবসায়ীসহ একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা বিরাজমান। এ কারণে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী আছেন যারা সততা এবং কোনো ধরনের নীতিনৈতিকতার বালাই না করে বিভিন্ন অসাধু পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ভোক্তাদের ঠকিয়ে যাচ্ছেন। এসব অসাধু কাজের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বিক্রি, মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর এমন দ্রব্য মিশিয়ে পণ্য বিক্রি, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি, নকল পণ্য বিক্রি, ওজন বা মাপে কম দেয়া প্রভৃতি।
আমাদের দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য ভোক্তাদের পক্ষ থেকে দীর্ঘ দিন দাবি করা হলেও শেষ অবধি ২০০৯ সালে আইনটি প্রণীত হয়। পরবর্তী প্রায় সাত বছর অতিবাহিত হতে চললেও এ আইনটির বিষয়ে ভোক্তাদের স্বচ্ছ ধারণা না থাকার কারণে তারা এর সুফল থেকে বঞ্চিত। তা ছাড়া এ আইনটিতে ভোক্তাদের জন্য ক্ষতিকর এমন কাজের সাথে সম্পৃক্ত ব্যবসায়ী বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রতিকার চাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে বিচারিক ক্ষমতা দেয়া হলেও ভোক্তা কর্তৃক সরাসরি মামলা দায়েরের অধিকার দেয়া হয়নি। মামলা দায়েরের বিষয়ে বলা হয়েছে একজন ভোক্তা, সরকারের ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক অথবা মহাপরিচালকের কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা অথবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা তার কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে পারবেন। এ ধরনের অভিযোগ দায়ের করার পর এগুলো তাদের বিবেচনায় যথার্থ বিবেচিত হলে সংশ্লিষ্ট প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট বা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে তাদের উদ্যোগে মামলা দায়েরের বিধান করা হয়েছে। এ আইনের অধীন কৃত অপরাধ দণ্ডনীয় এবং একজন ম্যাজিস্ট্রেট বিচার সমাপনান্তে আইনে উল্লিখিত অপরাধের জন্য অপরাধীকে দণ্ড দিতে পারেন। এ আইনে দণ্ডের পাশাপাশি জরিমানা করারও বিধান রয়েছে এবং জরিমানার টাকা ২৫ শতাংশ অভিযোগকারীকে দেয়ার কথা বলা হয়েছে; তবে তা শুধু অধিদফতরের বহির্ভূত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আইনটিতে ফৌজদারি প্রতিকারের পাশাপাশি দেওয়ানি প্রতিকারের কথা বলা হয়েছে এবং দেওয়ানি প্রতিকার প্রার্থনার ক্ষেত্রে যুগ্ম জেলা জজ আদালতকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। দেওয়ানি মামলায় প্রতিকার প্রদানের সময় আদালত ত্রুটিপূর্ণ পণ্য প্রতিস্থাপন অথবা ফেরত গ্রহণপূর্বক বাদিকে মূল্য প্রদান অথবা প্রমাণিত ক্ষতির পাঁচ গুণ পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশ দিতে পারেন।
ভোক্তা অধিকার আইন বিষয়ে ভুক্তভোগীদের অভিমত- এ আইনটির প্রয়োগ নেই। যাদের ওপর প্রয়োগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারা সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ভোগ করে থাকেন। এতে আইন বাস্তবায়নকারী ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীর কোনো দোষ বা ত্রুটি বা আইন লঙ্ঘনজনিত কর্মকাণ্ড অপরাধ হিসেবে দেখেন না। আমাদের বিভিন্ন মিষ্টির দোকানসহ পাইকারি ও খুচরা খাদ্যসামগ্রী বিক্রয়ের দোকানে দেখা যায় ওজন দেয়ার সময় মোটা কাগজে প্রস্তুত মিষ্টির বাক্সসহ অথবা মোটা কাগজে প্রস্তুত করা ঠোঙ্গাসহ ওজন দেয়া হয়। বাক্স বা ঠোঙ্গার ওজনের কারণে ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এর প্রতিবাদ করতে গেলে ভোক্তাকে অপমানিত হতে হয়। জনৈক বিশিষ্ট ব্যক্তি মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টি কিনে প্রতারিত হওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন- তিনি জেলা শহরের একটি দফতরের কর্ণধারের বাসায় গেলে তাকে অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীর পাশাপাশি বিভিন্ন মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়। আপ্যায়নের উদ্দেশ্যে পরিবেশিত মিষ্টিগুলো দেখতে খুব সুন্দর ও সুস্বাদু ছিল। মিষ্টি খেয়ে তিনি পরম তৃপ্ত হন। গৃহস্বামীকে জিজ্ঞাসা করার পর তিনি জানালেন তার অফিসের সম্মুখস্থ প্রধান ফটকের পাশের দোকানের মিষ্টি। বাসায় ফেরার পথে তিনিও ওই দোকান থেকে মিষ্টি কিনে তার স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাকে মিষ্টির গুণাগুণ বর্ণনাপূর্বক তাদের সাথে খেতে থাকলে উপলব্ধি করেন ওই কর্ণধারের বাসায় পরিবেশিত মিষ্টির স্বাদ ও মান নিজের ক্রয়কৃত মিষ্টির স্বাদ ও মান এক নয়। পরে খবর নিয়ে জানা গেল, জেলার বিভাগীয় কর্ণধারকে তুষ্ট রাখার মানসে তারা তাকে বিশেষভাবে মিষ্টি বানিয়ে দেন। কারণ উনি নাখোশ হলে দোকানের ইজারা বাতিল হয়ে যাবে। পরে কর্ণধারকে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করা হলেও মিষ্টি দোকানের মালিক দ্বারা তার স্বার্থ হাসিল হওয়ার কারণে তিনি এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি।
ভোক্তা অধিকার আইনে ‘অভিযোগকারী’ বলতে- যেকোনো ভোক্তা, একই স্বার্থসংশ্লিষ্ট এক বা একাধিক ভোক্তা, কোনো আইনের অধীন নিবন্ধিত কোনো ভোক্তা সংস্থা, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ বা এর পক্ষে অভিযোগ দায়েরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা, সরকার বা এ উদ্দেশ্যে সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো সরকারি কর্মকর্তা বা সংশ্লিষ্ট পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীকে বুঝানো হয়। আইনটি পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয়- এখানে ‘ভোক্তাদের অধিকার’গুলো কী কী তার স্পষ্ট কোনো বর্ণনা নেই; তবে অধিকার লঙ্ঘন করা হলে ভোক্তা বা কর্তৃপক্ষের করণীয় বিষয়গুলোর উল্লেখ আছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কমিটি ও অধিদফতর প্রতিষ্ঠার ওপর আইনটি গুরুত্ব দিয়েছে যদিও অধিকারভিত্তিক এবং সে অধিকার রক্ষামূলক মনোভাব আইনে অনেকটা অনুপস্থিত। এ বিষয়ে প্রতিবেশী ভারতে বহু আগেই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ভারতে আইন অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে। এটি উপ-আইনত ব্যবস্থা অর্থাৎ Consumers Association of Bangladesh (CAB)। সেখানে জাতীয়, রাজ্য ও জেলাপর্যায়ে তিন স্তরবিশিষ্ট আইনি পদক্ষেপ নেয়ার বিধান আছে। আমাদের আইনে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ নামে বাণিজ্যমন্ত্রীকে চেয়ারম্যান করে ২৭ সদস্যবিশিষ্ট যে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পরিষদ গঠন করা হয়েছে এর যারা সদস্য তাদের কর্মব্যস্ততার কারণে এ পরিষদের সভায় আদৌ সব সদস্যের উপস্থিতি নিশ্চিত করা সম্ভব কি না সে প্রশ্নটির উদয় হয়। আইনে প্রতি দু’মাসে পরিষদের চেয়ারম্যান বা তার অনুপস্থিতিতে বাণিজ্য সচিবের সভাপতিত্বে কমপক্ষে একটি সভা অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে এবং ন্যূনতম ১০ জন সদস্যের উপস্থিতিতে পরিষদের সভার কোরাম হবে মর্মে উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু নিয়মিত পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয় কিনা পরিষদ সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করতে পারেননি। আইনটিতে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে আট সদস্যবিশিষ্ট যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কমিটির উল্লেখ রয়েছে তা কতটা কার্যকর এ নিয়েও প্রশ্ন আছে।
বলা হয়েছে- এ আইনের অধীন সব অপরাধ জামিনযোগ্য, আমলযোগ্য ও আপসযোগ্য। কিন্তু কোনো ব্যক্তি কারণ উদ্ভব হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে এ আইনের অধীন ভোক্তা অধিকারবিরোধী কার্য সম্পর্কে মহাপরিচালক কিংবা অধিফতরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ না করলে ওই অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না। স্পষ্টত আইনটিতে উল্লিখিত অপরাধ ফৌজদারি। এই ফৌজদারি অপরাধের বিষয়ে আইনের চিরাচরিত বিধান- অপরাধীর মৃত্যু ব্যতীত এ ধরনের অপরাধ সময় দ্বারা বারিত নয়। আইনটিতে অপরাধ সংঘটনের ৩০ দিনের মধ্যে অভিযোগ দায়ের না করলে তা বারিত হবে- এই বিধানটি আমাদের প্রচলিত ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মৌলনীতি ‘যেকোনো ফৌজদারি অপরাধ সময় দ্বারা বারিত নয়’ এর পরিপন্থী। আমাদের দেশে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন প্রণয়নের আগে থেকে ঈড়হংঁসবৎং অংংড়পরধঃরড়হ ড়ভ ইধহমষধফবংয (ঈঅই) নামক একটি সংগঠন ভোক্তাদের অধিকার রক্ষায় ভূমিকা পালন করে আসছে। আইনটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংগঠনটির ইতিবাচক অবস্থান থাকলেও পরবর্তী সময়ে দেখা যায় এটির আইনটির কার্যকরতা পর্যবেক্ষণের চেয়ে সভা, সেমিনার আয়োজন এবং বক্তব্য ও বিবৃতি প্রদানের মধ্যে এর তৎপরতা অধিক সীমাবদ্ধ। আমাদের দেশে মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে সাধারণ মানুষ পারতপক্ষে ফৌজদারি বা দেওয়ানি প্রতিকার প্রার্থনায় আদালতের দ্বারস্থ হন না। তবে যেকোনো ধরনের ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কর্তৃক সরাসরি থানা বা আদালতে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই।
আলোচ্য আইনটিতে ফৌজদারি মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে ভোক্তা কর্তৃক থানায় বা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সরাসরি মামলা দায়ের করার বিধান না থাকায় তাতে একজন ভোক্তার মামলা দায়ের করার আগ্রহে যে ভাটা পড়বে, সেটি অনেকটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। সুতরাং ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে যে আইনটি প্রণীত হয়েছে সে আইনটি প্রণয়নের পর অর্ধ-যুগের অধিক সময় চলে গেলেও যখন দেখা যায় ব্যবসায়ী কর্তৃক ভোক্তাদের ঠকানোর প্রবণতা একই আছে তাতে এ আইনটি যে থেকেও না থাকার নামান্তর, এটি বলা কি অত্যুক্তি হবে?
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: [email protected]