লোকসমাজ ডেস্ক॥ মহান স্বাধীনতা অর্জনের ইতিহাস নিয়ে পাঠ্যবইয়ে বিকৃতি নতুন কিছু নয়। বিজয় দিবসকে পাঠ্যবইয়ে পড়ানো হচ্ছে ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের দিন’ হিসেবে।২০২০ শিাবর্ষের জন্য ২০১৯ সালে পুনর্মুদ্রিত নবম ও দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ পাঠ্যবইয়ে এই বিকৃতি দেখা গেছে। বইটি প্রথম প্রকাশ হয় ২০১৩ সালের অক্টোবরে। প্রথম পরিমার্জিত সংস্করণ ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে এবং দ্বিতীয় পরিমার্জিত সংস্করণ ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে। আর বইটি পুনর্মুদ্রণ ২০১৯ সালে। শুধু এই বই নয়, জাতীয় শিাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) মাধ্যমিক পর্যায়ের কয়েকটি বইতে এমন বিকৃতি, ভুল ও অসঙ্গতি দেখা গেছে।
বর্তমান সময়ে পাঠ্যবইয়ে ইতিহাস বিকৃতির এসব ঘটনায় দেশের শিাবিদ ও সংশ্লিষ্টরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অযোগ্য লোকজন বা ভিন্ন মতাদর্শের লোকজনকে দিয়ে বই লেখার কাজ করানো হচ্ছে বলেও অভিমত প্রকাশ করেছেন তারা। নবম ও দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ পাঠ্যবইয়ের ১০৬ নম্বর পৃষ্ঠার ৭.২ পরিচ্ছেদে ‘বাংলাদেশের প্রশাসন ব্যবস্থা’ অধ্যায়ের তিন নম্বর লাইনে লেখা হয়েছে ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে’। এমন অসঙ্গতি ও ভুল প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘অবহেলা ও অজ্ঞতার কারণে এসব হয়ে থাকে, কখনও কখনও উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেও হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শিশু-কিশোর পাঠ্যবই থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পাঠ্যবই লেখার কাজে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাদের শুধু লেখাপড়া বা সার্টিফিকেট থাকলেই হবে না, বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও দতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উজ্জ্বল থাকতে হবে। যে প্রজন্মের জন্য বই লেখা হচ্ছে, সেই প্রজন্মই পরবর্তী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাবে। কারণ মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম শেষ হয়ে যাচ্ছে।’
নবম ও দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের ২৮ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘১৯৭২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য’ অনুচ্ছেদের ৯, ১০ ও ১১ নম্বর লাইনে লেখা হয়েছে, “এ সংবিধানে বাংলাদেশকে প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত। ‘জনগণই সকল মতার উৎস’- সংবিধানের এ ঘোষণা দ্বারা জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।” এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আরিফ খান বলেন, ‘১৯৭২ সালের সংবিধানের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল মতার মালিক জনগণ।” সংশ্লিষ্ট একজন বিশেষজ্ঞ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, “একটি রাজনৈতিক দল ‘জনগণই সকল মতার উৎস’ স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করে। এটি তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে পাঠ্যবইয়ে।” তিনি আরও জানান, বর্তমানে এনসিটিবিতে সংবিধান বিশেষজ্ঞ নেই। একজন ছিলেন অনেক আগেই তাকে তাকে ওএসডি করা হয়েছে।
নবম ও দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইটির ১০২ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘রাষ্ট্রপতির জরুরি মতা’ অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি যদি বুঝতে পারেন যে, যুদ্ধ, বহিঃশক্তির আক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে বাংলাদেশ বা এর কোনও অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন হয় তাহলে তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারেন। ’তবে সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্রপতির কাছে সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে,’ৃ। ‘রাষ্ট্রপতি বুঝতে পারেন’ এটি সংবিধানে নেই। বইটির ২২ নম্বর পৃষ্ঠার ৬ ও ৭ নম্বর লাইনে লেখা হয়েছে ‘তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও স্বাধীন বাংলাদেশের মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি।’ সংশ্লিষ্টরা জানান, স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার ছিল মুজিবনগর সরকার আর স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই ‘বাংলাদেশের মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি’ না লিখে লিখতে হতো ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি’। নবম ও দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ পাঠ্যবইয়ের ২৭ নম্বর পৃষ্ঠার সর্বশেষ দুটি লাইনে লেখা হয়েছে, “রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২৩শে মার্চ ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ’ নামে একটি আদেশ জারি করেন।” কিন্তু বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি থেকেই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। অষ্টম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ পাঠ্যবইয়ের ৩০ নম্বর পৃষ্ঠায় দ্বিতীয় প্যারার ৪ ও ৫ নম্বর লাইনে লেখা হয়েছে, ‘১৯৭১ এর ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, শহীদুল্লা কায়সার, মুনীর চৌধরী ও জ্যোর্তিময় গুহ ঠাকুরতা,’। আর বইটির ২৩ নম্বর পৃষ্ঠার শেষের প্যারার আগের প্যারায় রাজাকার অংশে লেখা হয়েছে ‘বেকার যুবকরা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়’।
আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করি, সে কারণে এমনটা মনে করা হয়েছে। ১৪ ডিসেম্বরের পর দেশের বেশি বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছে। অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কাল রাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। জ্যোর্তিময় গুহ ঠাকুরতা ২৫ মার্চের সার্চ লাইট অপরেশেনের পরে মারা যান। এছাড়া রাজাকার বাহিনীতে বেকার যুবকরা নন, যারা স্বাধীনতার বিপে ছিলেন তারাই যোগ দিয়েছিল। পাঠ্যবইয়ের এই তথ্য মিস লিডিং।’
নবম ও দশম শ্রেণির পৌরনীতি ও নাগরিকতা বইয়ের জাতীয় সংসদের মতা ও কার্যাবলী অনুচ্ছেদের ৪ নম্বরে (৬৬ নম্বর পৃষ্ঠায়) লেখা হয়েছে ‘তাছাড়া সংবিধান লঙ্ঘন করলে সংসদ স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা ও রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনতে তা তাদের অপসারণ করতে পারে।’ এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আরিফ খান বলেন, ‘সংবিধান লঙ্ঘন করলে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে অভিশংসন হবে, অনাস্থা হবে না। আর প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা হবে। তবে সংসদ স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের েেত্র অন্য কার্যপ্রণালীতে অপসারণ করার বিধান রয়েছে। ’ অষ্টম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের ১৭ নম্বর পৃষ্ঠার ২ নম্বর লাইনে লেখা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়ি থেকে’। প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধুর বাড়ি (৬৭৭ নম্বর বাড়ি) থেকে। অষ্টম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইটির ৭৯ পৃষ্ঠার ১০ ও ১১ নম্বর লাইনে লেখা হয়েছে ‘আটটি বিভাগ ছাড়াও কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও ময়মনসিংহে সিটি করপোরেশন রয়েছে’ৃ। অথচ ময়মনসিংহ আটটি বিভাগের মধ্যে একটি। বইটির ৮০ নম্বর পৃষ্ঠার প্রথম লাইনে দ্বিতীয় বাক্যে এবং দ্বিতীয় লাইনে লেখা হয়েছে ‘জেলার অন্তর্গত সব মেয়র ও কমিশনার,’ এখানেও কাউন্সিলর না লিখে লেখা হয়েছে কমিশনার। এই ভুল একাধিক জায়গায় করা হয়েছে।
সপ্তম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের ৭ নম্বর পৃষ্ঠার ছয় দফা কর্মসূচির ২ নম্বর দফায় লেখা হয়েছে ‘ফেডারেশন (কেন্দ্রীয়) সরকারের এখতিয়ারে কেবলমাত্র দেশরা ও পররাষ্ট্রীয় বিষয় দুটি থাকবে। অবশিষ্ট সমস্ত বিষয় প্রদেশের হাতে থাকবে।’ আইনজীবী আরিফ খান বলেন, ‘ফেডারেশন সরকার হবে না’ প্রকৃতপে তা হবে ‘ফেডারেল সরকার’। সপ্তম শ্রেণির এই বইটিতে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সংগ্রাম’ অধ্যায়ের ১০ নম্বর পৃষ্ঠার ৫ ও ৬ নম্বর লাইনে লেখা হয়েছে, ‘এরপর ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচন ছিল শুধু পূর্ব পাকিস্তানে।’ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আরিফ খান বলেন, ‘এখানে ভুল লেখা হয়েছে। পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন ও প্রাদেশিক নির্বাচন হয়েছিল একই সময়। আমরা পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিলাম।’
সপ্তম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের ৫৫ নম্বর পৃষ্ঠায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অংশে তিন নম্বর লাইনে লেখা হয়েছে ‘জনগণের প্রত্য ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও জনপ্রতিনিধিরাই ভোট দিয়ে পাঁচ বছরের জন্য দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন।’ আইনজীবী আরিফ খান বলেন, ‘এখানে সংসদ সদস্য লেখার পর জনপ্রতিনিধি লেখা অপ্রয়োজনীয়। কারণ সংসদ ছাড়াও স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিও রয়েছে। আর তাছাড়া শুধু জনগণের প্রত্য ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যই নন সংরতি সংসদ সদস্যরাও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেন। সংরতি সংসদ সদস্যরা প্রত্য ভোটে নির্বাচিত নন।’ ষষ্ট শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ বইয়ের ‘বাংলাদেশের ইতিহাস অধ্যায়’-এর ২ নম্বর পৃষ্ঠার শেষ লাইনের শেষ শব্দ ও ৩ নম্বর পৃষ্ঠার প্রথম লাইনে লেখা হয়েছে ‘এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিুবর রহমানের মতো এক সাহসী, ত্যাগী ও দূরদর্শী নেতার আবির্ভাব হয়।’
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু একদিনে হঠাৎ আবির্ভাব হননি। তার অনেক দিনের সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্যদিয়ে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন।’
নবম ও দশম শ্রেণির ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ পাঠ্যবইয়ের ২২ নম্বর পৃষ্ঠায় একাধিক ভুল দেখা গেছে, জাতীয় চার নেতার নামের আগে জাতীয় নেতা লেখা হয়নি, শীর্ষ নেতা লেখা হয়েছে। পাঠ্যবই লেখা ও সম্পাদনায় অবহেলা অজ্ঞতার ছাপ ফুটে উঠেছে। পাঠ্যবইয়ে ভুল, ইতিহাস বিকৃতি ও সঙ্গতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, ‘প্রতি বছরই ছোটখাটো ভুল আমরা সংশোধন করছি। ভুল থাকলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’