যে কৌশলে টাকা লোপাট ঢামেকে : হোটেলে না থেকেও বিল, খাবার যায় ক্যান্টিন থেকে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা স্টাফদের থাকা-খাওয়া বাবদ ২০ কোটি টাকার বিল নিয়ে তোলপাড় চলছে সর্বত্র। এ নিয়ে জাতীয় সংসদে সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরক্তি প্রকাশের পর গতকাল এ নিয়ে জোর তদন্ত শুরু হয়েছে। একাধিক সংস্থার কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। চিকিৎসকদের খাবার ও থাকার বিল নিয়ে ক্ষুব্ধ সাধারণ চিকিৎসক ও কর্মচারীরা। তারা বলছেন- অনেক সুযোগ- সুবিধাই তারা পাচ্ছেন না। অথচ তাদের নামে এভাবে মোটা অঙ্কের বিল করে একটি চক্র সরকারি অর্থ আত্মসাতের ফন্দি আঁটছে। মানবজমিন-এর তরফে গত দুইদিনে অনুসন্ধান করেও এমন অনেক তথ্য মিলেছে। জানা গেছে যে কৌশলে বিলের অঙ্ক বাড়িয়ে আত্মসাতের চেষ্টা করা হয়।
হাসপাতালের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন কর্মকর্তা এই কাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন বলে ধারণা করছেন হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দকৃত হোটেলে কেউ থাকেন না। অথচ মাসের পর মাস স্টাফদের থাকার বিল করা হচ্ছে। স্টাফরা এই হোটেলে থাকেন না বলে হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খাবারেরও কোনো চুক্তি করেনি। গতকাল নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেডিওলজি বিভাগের একাধিক কর্মচারী এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তারা বলেছেন, আমরা হোটেলে থাকি না। বাসায় থেকেই ডিউটি ও খাবার খাই। অথচ আমরা কোনো বিল পাই না। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, রেডিওলজি বিভাগের ২১ জন কর্মচারীর জন্য গ্রীণ রোডের হোটেল মুনা ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে। কিন্তু গত তিন মাস ধরে সেখানে রেডিওলজি বিভাগের কেউ থাকেন না। যদিও মুনা ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সেখানকার ব্যবস্থাপক পরিচয় দেয়া সজীব বলেন, ঢাকা মেডিকেলের ৬১ জন স্টাফ নিয়মিত তাদের হোটেলে থাকেন। খাবারের চুক্তি না থাকায় নিচের একটি হোটেল থেকে স্টাফরা খাবার খান। এদিকে ঢাকা মেডিকেলের করোনা ইউনিটে ডিউটি করেন এমন সকল স্টাফদের খাবারের বিষয়ে হোটেল কর্র্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ। অথচ হাসপাতালের একটি সিন্ডিকেট হাসপাতালের কিচেনেই খাবারের আয়োজন করে হোটেলে পাঠাচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা নিম্নমানের খাবার তৈরি করে উচ্চমূল্যের বিল করছেন। আর এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত আছেন হাসপাতালের দুই প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ কয়েকজন। শুরু থেকেই খাবারের মান নিয়ে অভিযোগ করে আসছেন চিকিৎসক, নার্সসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারীরা। প্রত্যেকের খাবারের জন্য ৫০০ টাকা করে বরাদ্দ থাকলেও গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার খাবার দেয়া হয় বলে অভিযোগ আছে। মানের দিক দিয়েও সেটা নিম্নমানের। অভিযোগকারীরা জানিয়েছেন, প্রতিদিন সকালের নাস্তায় ডিম, কলা, রুটি, দুধ ও মিষ্টি দেয়া হয়। আর দুপুর ও রাতে সাদা ভাত, মাছ, মাংস ও সবজি। মাছ দেয়া হলে মাংস দেয়া হয় না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ২০ কোটি টাকার বিলের বিষয়ে নানা প্রতিক্রিয়া আসার পর সোমবার বিষয়টি সংসদে উপস্থাপন করেন বিরোধী দলের উপনেতা জি এম কাদের। বিষয়টি আমলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী সংসদে জানান, বিষয়টি তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। বিলের বিষয়টি তদন্ত হবে বলে তিনি সংসদকে জানান। গতকাল হাসপাতালে অবস্থানকালে দেখা গেছে, বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা অনিয়মের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছেন। হাসপাতালের প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, করোনা ইউনিটের দায়িত্বপালনকারী চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ও নিরাপত্তাকর্মীদের জন্য ৩০টি হোটেলের সঙ্গে চুক্তি করেছে মেডিকেল কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে রয়েছে, হোটেল সালিমার ইন্টারন্যাশনাল (কমলাপুর), হোটেল স্টার সিটি ইন্টারন্যাশনাল (রেলওয়ে হাসপাতাল), হোটেল রাহমানিয়া ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল আল ফয়সাল ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল ওসমানী ইন্টারন্যাশনাল (ওয়ারি), সুন্দরবন হোটেল (সিআর দত্ত রোড), হোটেল মেলোডি ইন্টারন্যাশনাল (নওয়াবপুর রোড), হোটেল ডিলাক্স ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল ফারুক ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল ইনসাফ ইন্টারন্যাশনাল, বিসমিল্লাহ হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট (গ্রীণ রোড, শুধুমাত্র খাবারের হোটেল), হোটেল মুনা ইন্টারন্যাশনাল (গ্রীণ রোড, শুধুমাত্র আবাসিক), লেকসোর সার্ভিস এপার্টমেন্ট প্রা. লি. (গুলশান), হোটেল গ্রীণ ইন্টারন্যাশনাল (আবাসিক, গ্রীণ রোড), ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট (নিকুঞ্জ-২), হোটেল নিউ ইয়র্ক (তোপখানা রোড), হোটেল ৭১ (রেলওয়ে হাসপাতালের জন্য, শহীদ নজরুল ইসলাম সরণি), হোটেল গিভেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (ফার্মগেট), হোটেল গোল্ডেন টিউলিপ দ্যা গ্রান্ডমার্ক (বনানী), হোটেল সেন্টার পয়েন্ট (গুলশান), হোটেল ঢাকা সাফারী (বনানী), হোটেল লা-ভিনসি (কাওরান বাজার), ইন্নোটেল লাক্সারি হোটেল (বনানী), হোটেল দি রহমানিয়া ইন্টারন্যাশনাল (টয়েনবি সার্কুলার রোড), হোটেল স্প্রিং হিল (গুলশান-২), হোটেল আশিয়ানা (ফকিরাপুল বাজার), হোটেল পিনাকল ইন (গুলশান-১), হোটেল দি ক্যাপিটাল লিমিটেড (রেলওয়ে হাসপাতাল), লা ভিলা ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ (বারিধারা), ডেইজ হোটেল (বারিধারা)।
অনিয়মের অভিযোগ আসা এবং সমালোচনার মধ্যেই গতকাল জাতীয় সংসদে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক জানিয়েছেন, ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসক-কর্মচারীদের থাকা-খাওয়ার বিলে কোনো অনিয়ম হয়নি। ওদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনাকালে জরুরি পরিস্থিতিতে বিলের বিষয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না এমনটি ধরে নিয়ে হাসপাতালের কয়েকজন কর্মকর্তা বাড়তি বিল তৈরির কৌশল নেন। সূত্র জানায়, বুকিং দেয়া হোটেলগুলো এই সময়ে এমনিতেই খালি পড়ে থাকতো। তাদের সঙ্গে চুক্তি হলেও বিলের অংশ ভাগ-বাটোয়ারার অলিখিত চুক্তি হয়। বিলের বিষয়টি প্রকাশ হওয়ার পর এখন ওই চক্রটি বেশ বেকায়দায় আছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, চিকিৎসক ও নার্সরা ৭ দিন ডিউটি করে পরবর্তী ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকেন। সব মিলিয়ে তারা ২১ দিন হোটেলে থেকে ডিউটি করেন। পরবর্তীতে তাদের করোনা পরীক্ষায় যদি পজেটিভ আসে তবে তাদেরকে আইসোলেশন বা হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নিতে হয়। আর নেগেটিভ আসলে তাদেরকে হোম রেস্টে পাঠানো হয়। করোনা ইউনিট-১ ও ২ এ ৭০০ রোগীর জন্য তিন সপ্তাহে চিকিৎসক প্রয়োজন হয় ৫১০ জন। আর রেস্টে থাকেন ১৭০ জন। সবমিলিয়ে ১ মাসে আমাদের ৬৮০ জন চিকিৎসক লাগে। একইভাবে করোনার দুই ইউনিটে তিন সপ্তাহের জন্য নার্সের প্রয়োজন ৬৩৬ জন। আর ২১২ জন থাকেন হোটেলে। সবমিলিয়ে এক মাসে নার্স লাগে ৮৪৮ জন। ১ মাসে টেকনোলজিস্ট লাগে ৭৬ জন। চতুর্থ শ্রেণি ও নিরাপত্তাকর্মীদের ১৫ দিন পরপর ডিউটি করানো হয়। তার মধ্যে মাসে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী লাগে ৪৫৬ জন। আর মাসে নিরাপত্তাকর্মী লাগে ২১৬ জন। সবমিলিয়ে তিন সপ্তাহের জন্য ১৮৯৪ জন জনবল লাগে করোনা ইউনিটে। আর ৩৮২ জন বিশ্রামে থাকেন। এক মাস কাজ করার জন্য মোট ২২৭৬ জন জনবল দরকার। তিনি বলেন, মে ও জুন মাসে করোনা চিকিৎসার জন্য কি পরিমাণ বাজেট লাগতে পারে সেজন্য মন্ত্রণালয় থেকে জুনের প্রথমদিকে আমাদের কাছে একটা বাজেট চাওয়া হয়েছিলো। তখন আমরা দুই মাসে ৪ হাজার জনবলের পেছনে ২০ কোটি টাকা লাগবে ধরে একটি বাজেট দিয়েছিলাম। তাদের থাকা-খাওয়া ও ট্রান্সপোর্টের জন্য এ বাজেট দিয়েছিলাম। থাকা-খাওয়ার বাইরে স্টাফদের আসা-যাওয়ার জন্য ১৫টি মাইক্রোবাস, দুটি বাস লাগে। সেখানে ৪০ লাখ টাকার মতো লাগে। চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ও নিরাপত্তাকর্মীদের সকালের নাস্তা, দুপুরের ও রাতের খাবারের বাজেট ৫০০ টাকা। হোটেলগুলোকে সেভাবেই বলা হয়েছে।
রেডিওলজি বিভাগের কর্মচারীদের নির্ধারিত হোটেলে কেউ থাকে না। অথচ তাদের নামে থাকা- খাওয়ার বিল করা হচ্ছে। এ অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাদের ডিউটি আছে তারা আসা-যাওয়া করবে। আর যাদের ডিউটি শেষ তারা দুই সপ্তাহ কোয়ারেন্টিনে থাকবে। তাদেরকে বলা আছে তারা হোটেলেই থাকবে ও খাওয়া-দাওয়া করবে। কিন্তু আমরা সব জায়গায় কন্ট্রোল করতে পারি না। আমাদের হাতে তেমন লোকও নেই যে হোটেলে গিয়ে তদারকি করবে। হোটেলগুলোকে বলা আছে কেউ যদি না থাকে তবে আমাদের যেন তথ্য দেয়। কিছু কিছু তথ্য আমাদের কাছে এসেছে। অনেকে দেরি করে এসেছে বা বাইরে চলে গেছে। আমরা তাদের শাস্তি দিয়েছি। ফোন করে জবাবদিহিতা করেছি। আমরা আমাদের মতো বিষয়গুলো কন্ট্রোলের চেষ্টা করেছি। আর যদি হোটেলে না থাকে তবে ব্যক্তিগতভাবে গিয়েছে।
মেডিকেলের কেন্টিন থেকে স্টাফদের খাবার দেয়া হচ্ছে এ বিষয়ে তিনি বলেন, এটা কেমনে সম্ভব? খাবারের বিষয়টি হোটেলের সঙ্গে আমাদের চুক্তি আছে খাবার ও থাকা বাবদ এত টাকা পাবে। এটা একটা ভুল তথ্য। তবে রেলওয়ে হাসপাতাল আমরা চালাচ্ছি। ওখানের রোগীদের খাবার আমাদের কিচেনে তৈরি হচ্ছে। আমরা এখান থেকে গাড়ি করে তিন বেলা খাবার পৌঁছে দেই। তিনি বলেন, চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারীদের স্ট্যাটাস অনুযায়ী ৩০টি হোটেলের সঙ্গে আমরা চুক্তি করেছি। হোটেলগুলো সিলেক্ট করেছে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী। তারা এগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। আমাদের চার সদস্যবিশিষ্ট কমিটি আছে যারা হোটেল সিলেকশন ও অন্যান্য বিষয়ে কাজ করে। এর মধ্যে করোনা ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান, এনেস্থেশিয়ার বিভাগীয় প্রধান, একজন উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালক রয়েছেন। আমরা যখন আমাদের ডাক্তার- নার্সদের জন্য চাহিদার কথা জানাই তখন তারা নিরাপত্তাকর্মীরা আমাদের তথ্য দেয়। তখন আমাদের টিম দর ঠিক করা থেকে শুরু করে অন্যান্য সুবিধা যাতে দেয় সেভাবে আলোচনা করে হোটেলগুলো নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা যখন শুরু করি তখন লকডাউন ছিল। কোনো হোটেলই খোলা ছিল না। আমাদের নিরাপত্তাকর্মীরা হোটেল মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে তারাই ঠিক করেছে। শুরুতে যে হোটেল পেয়েছি সেগুলোর সঙ্গে চুক্তি করেছি। পরে অন্যান্য হোটেল খোলার পর আমরা দরাদরি করে অন্য হোটেল ঠিক করেছি। এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৬৮৮ জন বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা হোটেলে থেকে ডিউটি করেছেন। এরমধ্যে ডাক্তার আছে ১২৫৮ জন, ১৫৬৭ জন নার্স, ৫০ জন টেকনিশিয়ান, ১৬ জন ফার্মাসিস্ট, ৪৪৩ জন বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারী এবং ৩৫৪ জন আনসার সদস্য রয়েছেন।