ক্যামনে বাঁইচ্চা ফিরছি, কইতে পারি না

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ তখন বেলা ১২টা। রাজধানীর অন্য সবকিছু ছিল অন্যান্য দিনের মতোই স্বাভাবিক। করোনা মহামারীর মধ্যেও কর্মচঞ্চল ছিল ঢাকা। কর্মস্থলে ছুটছিল নগরবাসী। ঠিক এ সময়টা সদরঘাটের পরিবেশ ভারি হয়ে যায় আহাজারিতে। নদীর মাঝখান থেকে খবর আসে ডুবে মারা যাওয়া লাশ উদ্ধারের সংখ্যা ১৫। কয়েক মিনিটের মধ্যেই হয়ে যায় ১৬। এরপর রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। শেষ পর্যন্ত বেলা শেষে উদ্ধার করা হয় একে একে ৩২টি লাশ। এদিকে নদীর ঢেউয়ে সঙ্গে তাল মিলিয়ে গড়াতে থাকে সময়, অন্যদিকে লালকুঠি ঘাটের পন্টুনে অশ্রুহীন চোখে বুকফাটা আর্তনাদ বাড়তে থাকে ২৪ বছরের নারী সুমির। গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় মা সুফিয়া বেগমের সঙ্গে ফিরছিলেন তিনি। লঞ্চডুবি থেকে তিনি বেঁচে ফিরলেও তখনো মায়ের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটিয়ে ছোট বোন আর মাকে নিয়ে একই লঞ্চে করে কর্মস্থল রাজধানীতে ফিরছিলেন রিফাত। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে রিফাত বেঁচে গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু পানির অতলে হারিয়ে ফেলেছেন মা আর ছোট বোনকে। চোখের সামনে এমন মর্মান্তিক ঘটনায় যেন কাঁদতে ভুলে গেছেন!
‘ময়ূর-২-এর ধাক্কা লাগতে সময় লাগছে, কিন্তু আমাদের লঞ্চ ডুবতে কোনো সময় লাগেনি। মুহূর্তে ডুবে যায় লঞ্চটি। আমি যে ক্যামনে বাঁইচ্চা ফিরছি, এইটা কইতে পারি না’- ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলছিলেন সুমি। সুমি আর রিফাতের মতো অনেকে ফিরছিলেন ঢাকায়। কেউ ব্যক্তিগত প্রয়োজনে, কেউ কাজে। কিন্তু ফেরা আর হলো না বেশির ভাগ যাত্রীর। বুড়িগঙ্গার শ্যামবাজারে লঞ্চের সঙ্গে ডুবে যায় প্রাণ, ডুবে যায় স্বপ্ন। এমন ঘটনায় স্বজন হারানোদের আর্তনাদ থামছিলই না। অনেকে হাসপাতালের মর্গে, ঘাটে সবখানে ঘুরছিলেন প্রিয়জনের লাশের সন্ধানে। তাদের কান্নায় ভারি হয়ে যায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতাল মর্গের চারপাশ। বেলা যত গড়াতে থাকে, বাড়তে থাকে সদরঘাটে প্রিয়জন হারানো স্বজনের সংখ্যা। তাদের ছোটাছুটিতে ভারি হয়ে ওঠে শ্যামবাজারে বুড়িগঙ্গা পাড়। এদের কেউ কেউ নিজ নিজ স্বজনের ফোন নম্বরে একটু পরপর কল করেন। ফোন বন্ধ। এর পরও বারবার চেষ্টা। তবু নিষ্ঠুরতায় হার মানতে হচ্ছিল তাদের। এমন পরিস্থিতিতে তারা কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। গতকাল বুড়িগঙ্গায় মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার কাঠপট্টি থেকে আসা ‘মর্নিং বার্ড’ নামের একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবে যায়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের ধারণা, লঞ্চে ৫০ জন যাত্রী ছিলেন। তবে বেঁচে ফিরে আসা যাত্রীদের দাবি, লঞ্চে শতাধিক যাত্রী ছিলেন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাসুদের চারপাশে পানি আর পানি : ঢাকায় আসার জন্য কাঠপট্টি ঘাটে গতকাল সকাল পৌনে ৮টায় মর্নিং বার্ড লঞ্চে ওঠেন মাসুদ। সঙ্গে দুই মামা আফজাল আর বাচ্চু মিয়া। লঞ্চের নিচতলায় ছিলেন বাচ্চু মিয়া, দোতলায় কেবিনে ছিলেন মাসুদ আর আফজাল। সকাল ৯টা ১২ মিনিটে লঞ্চটি সদরঘাটে এসে পৌঁছায়। ঘাটে নোঙর করতে তখনো প্রায় ২০০ মিটার বাকি। এমন দূরত্বে নদীতে ভাসছিল লঞ্চটি। গল্পের মধ্যেই নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মাসুদ আর আফজাল। কিছু বুঝে ওঠার আগে মুহূর্তেই তাদের লঞ্চটি তলিয়ে যায়। পানিতে তখন সাঁতরাতে থাকেন মাসুদ। নদীর মৃদু ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে ঘাটে ফেরেন তিনি। ততক্ষণে দুই মামাকে হারিয়ে ফেলেন। প্রায় তিন ঘণ্টা পর আফজালের লাশ উদ্ধার হলেও নিখোঁজ থাকেন বাচ্চু মিয়া। মামাশ্বশুরের জন্য অপেক্ষা যেন ফুরায় না সোহাগের : লঞ্চে ওঠার আগে ঘাটে ইমরান হোসেন সোহাগের সঙ্গে কথা হয় তার মামাশশুরের। দুজনের একসঙ্গে ঢাকায় ফেরার কথা। আগের লঞ্চ ৭টা ২০ মিনিটে ছেড়ে আসে। ওই লঞ্চে সোহাগকে তুলে দেন তার মামাশ্বশুর। এ সময় তাকে মামাশ্বশুর বলেন, ‘তুমি যাও, সদরঘাটে অপেক্ষা কোরো। আমি পরের লঞ্চে আসছি।’ আগে পৌঁছে পন্টুনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন সোহাগ। এর মধ্যে মুঠোফোনে কথাও বলেন মামাশ্বশুরের সঙ্গে। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘাটে ফিরবেন। এর পরই দেখলেন সেই লঞ্চটি অন্য একটি লঞ্চের ধাক্কায় ডুবে গেল। সোহাগের সে অপেক্ষা গড়ায় দুপুর পেরিয়ে। তবু মামাশ্বশুরের লাশের সন্ধান পাননি।
স্বজনদের ছোটাছুটি : লঞ্চডুবির খবরে কাঁদতে কাঁদতে শ্যামবাজারে ছুটে আসেন নাসিমা আক্তার। তার ভাই শাকিল আহমেদ (২৫) সকাল থেকেই নিখোঁজ। তাদের গ্রামের বাড়ি ভোলায়। বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে শাকিল তিন দিন আগে মুন্সীগঞ্জ গিয়েছিলেন। তিনি ঢাকার কেরানীগঞ্জে বোনের সঙ্গে থাকতেন। গতকাল ভাইয়ের ফেরার কথা ছিল। নাসিমা দেখেন তার মোবাইল নম্বর বন্ধ। এতে কলিজা কেঁপে ওঠে। ভাইয়ের খোঁজে বুড়িগঙ্গার তীরে তীরে আহাজারি করে ছুটতে থাকেন। যাকেই পান ভাইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করেন। সিদ্দিক নামে এক যুবক নৌকা নিয়ে বুড়িগঙ্গায় তার মামা মিলনকে খুঁজছিলেন। মামাও ছিলেন ওই লঞ্চে। এ রকম অর্ধশত মানুষ ঘটনাস্থলে এসে ভিড় করেন প্রিয়জনের খোঁজে। কেউ বুক চাপড়িয়ে, কেউ মাথায় হাত দিয়ে, কেউ কাঁদতে কাঁদতে প্রিয়জন হারানোর শোকে মূর্ছা যান। মর্গে লাশ চিনতে বেগ পেতে হয়েছে অনেককে। অনেক লাশের চেহারা ফুলে থাকায় কিংবা নাকমুখ দিয়ে ফেনা বের হয়ে যাওয়ায় চিনতে কিছুটা সমস্যা হয় স্বজনদের। অনেকেই লাশ পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।