বুড়িগঙ্গায় লাশের সারি, স্বজনদের আহাজারি

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ হঠাৎ বিকট শব্দ। কেঁপে ওঠে আশপাশ। মনে হলো যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। লঞ্চের জানালা দিয়ে প্রবেশ করছে পানি। চোখের পলকে ডুবে যায় লঞ্চটি। মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা লঞ্চ মর্নিং বার্ড বুড়িগঙ্গা নদীতে দুর্ঘটনার বর্ণনা এভাবেই দেন প্রত্যক্ষদর্শী সাদিকুর রহমান। তিনি শ্যামবাজারের ব্যবসায়ী। এ সময় তিনি ঘাট পার হতে নৌকার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন পল্টুনে।
বলেন, চাঁদপুরগামী ময়ূর-২ লঞ্চটি যেন ইচ্ছে করেই মর্নিং বার্ডকে ধাক্কা দেয়। শুধু ধাক্কা নয়, যেন চেপে ধরে পানিতে ডুবিয়ে দেয়। তার কথা, ময়ূর-২ লঞ্চের খামখেয়ালিপনার বলি হলো মর্নিং বার্ড। প্রাণ গেল ৩২ জনের। আরো কতজন নিখোঁজ রয়েছে কে জানে। তিনি বলেন, ঘটনা এত দ্রুত ঘটেছে যে দুই চারজন ছাড়া কেউই লঞ্চ থেকে বেরুতে পারেনি। দুজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই তারা মারা যায়। ৬০ থেকে ৬৫ জন যাত্রী নিয়ে মর্নিং বার্ড মুন্সীগঞ্জ থেকে ছাড়ে সকালে। বেলা ৯টা ১৩ মিনিটে লঞ্চটি শ্যামবাজার ফরাসগঞ্জ ঘাটে ভেড়ার জন্য সোজা আসছিল। অন্যদিকে চাঁদপুরগামী ময়ূর-২ লঞ্চটি ফরাসগঞ্জ ঘাট থেকে সদরঘাট ঘাটে আসতে পেছনের দিকে যায়। ঘাটে ভেড়ানোর আগ মুহূর্তে ময়ূর ধাক্কা দেয় মর্নিং বার্ডকে। কিছু বুঝে ওঠার আগে তলিয়ে যায় দোতলা এ ছোট লঞ্চটি।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে স্বজনরা ভিড় জমায় বুড়িগঙ্গায়। নিহত ও নিখোঁজদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে বাতাস। ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ড ও নৌ পুলিশ, নেভী, র‌্যাব সদস্যরা উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নেয়। র‌্যাবের হেলিকপ্টার আকাশ থেকে নজরদারি করে। উদ্ধার কাজে ১৪ জন ডুবুরি অংশ নেন। একে একে লাশের সারি দীর্ঘ হতে থাকে। একেকটি লাশ তীরে উঠানোর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় আহাজারি। উদ্ধারকৃত লাশের মধ্যে ৩ জন শিশু, ৮ জন মহিলা ও ২১ জন পুরুষ রয়েছে। ওদিকে দুর্ঘটনার পর ময়ূর-২ এর চালক ও স্টাফরা পালিয়ে যায়। পুলিশ লঞ্চটি জব্দ করেছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা রায়হানুল ইসলাম জানান, নদীতে স্রোত ও বাতাস থাকার কারণে লাশগুলো ছড়িয়ে পড়েছে। এ কারণে লাশ উদ্ধারে সমস্যা হচ্ছে। অক্সিজেন পর্যাপ্ত পরিমাণে আনা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ডুবুরি সুমন জানান, লঞ্চটি যেখানে ডুবেছে ওই স্থানে লঞ্চটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লঞ্চটি খুঁজে পেতে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। ঘটনাস্থলে ছুটে যান নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালেদ মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেছেন, আপাতদৃষ্টিতে ঘটনাটি পরিকল্পিত মনে হয়েছে। এ ঘটনায় বিআইডব্লিওটিএ ও মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি আরো জানান, নিহতদের পরিবারকে দেড় লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। দাফন ও সৎকারে ১০ হাজার টাকা নগদ দেয়া হবে। নৌ পুলিশের ডিআইজি আতিকুর রহমান বলেন, খবর পেয়েই পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যান। দুর্ঘটনায় কারো গাফিলতি থাকলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। খবর পেয়ে শত শত মানুষ ভিড় জমায় বুড়িগঙ্গার তীরে। কেউ কেউ স্বজনদের লাশের অপেক্ষায়। আয়েশা বেগম নামে একজন মুন্সীগঞ্জ থেকে ছুটে এসেছেন। তিনি তার স্বজনের খোঁজে দিশাহারা। এমন স্বজনদের চিৎকারে ভারি হয়ে উঠেছে বুড়িগঙ্গার বাতাস।
সূত্র জানায়, চাঁদপুর থেকে আসা ময়ূর-২ লঞ্চটি ভোর সাড়ে ৪টার দিকে লালকুঠি ঘাটে যাত্রী নামিয়ে সদরঘাটের চাঁদপুর ঘাটে গিয়ে নোঙর করার জন্য ব্যাক গিয়ারে ঘুরছিল। ওই সময় পেছনে থাকা এমভি মর্নিং বার্ডের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। পুরো ঘটনাটি ঘটেছে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে। ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ওই সময়ে লঞ্চের সঙ্গে ধাক্কা লেগে নিমিষেই ডুবে যায় ছোট লঞ্চটি। ঠিক কতজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন, তা স্পষ্ট করে বলতে পারছে না কেউ। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা যেসব লাশ উদ্ধার করেছেন, তাদের মধ্যে যমুনা ব্যাংকের ইসলামপুর শাখার কর্মচারী সুমন তালুকদারকে শনাক্ত করেন তার বড় ভাই নয়ন তালুকদার। ডুবে যাওয়া ওই লঞ্চে ছিলেন আবদুর রউফ। ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছেন তিনি। রউফ বলেন, লঞ্চটি সদরঘাটের একেবার কাছে চলে আসে। আমরা নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ করে ঘাটের খালি একটি লঞ্চ আমাদের লঞ্চটিকে ধাক্কা দেয়। ভয়ে আমরা সবাই চিৎকার দিই। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমাদের লঞ্চটি উল্টে যায়। আমরা ছিলাম লঞ্চের নিচের তলায়। পানিতে হাবুডুবু খেতে থাকি। দম আমার বের হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি পানির উপরে উঠতে পারি। বেঁচে যাই। কিন্তু আমার বন্ধু সত্য রঞ্জন উঠতে পারেনি। লঞ্চটিতে প্রায় ৬০-৭০ জন ছিলাম। তিনি বলেন, যারা ডুবে গেছেন, তাদের অনেককে আমি চিনি। কারণ এসব মানুষ মুন্সীগঞ্জ থেকে প্রতিদিন ঢাকায় আসেন। কাজ শেষে আবার মুন্সীগঞ্জে চলে যান। ওদিকে ভাগিনার লাশ শনাক্ত করেছেন মুন্সীগঞ্জের শাকিল। তিনি বলেন, আমার ভাগিনা নিয়মিত মুন্সীগঞ্জ থেকে ইসলামপুরে আসতেন। লঞ্চ দুর্ঘটনায় সে মারা গেছে। আমরা তার লাশ শনাক্ত করেছি। সদরঘাট টার্মিনালে বিলাপরত হামিদা বেগম জানান, তার বড় ভাই আবু তাহেরের (৫৫) আর অফিসে যাওয়া হলো না। তিনি যমুনা ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় চাকরি করতেন। বিক্রমপুর নিজ বাড়ি থেকে সকালে ওই লঞ্চযোগে ঢাকায় এসে অফিস করার কথা ছিল। শরিফ তালুকদার নামে অপর এক ব্যক্তি জানান, তার ছোট ভাই সুমন তালুকদার (৩৭) ওই লঞ্চ ডুবির ঘটনায় মারা গেছে। ওদিকে ভগ্নিপতির লাশের জন্য পাগলপ্রায় ষাটোর্ধ্ব নারায়ণগঞ্জের মো. সেলিম। তিনি বলেন, তার ভগ্নিপতির নাম মনির হোসেন। বয়স ৫০ বছরের মতো। লঞ্চে করে তিনি ঢাকায় আসছিলেন। লঞ্চ ডুবির পর থেকে তাকে পাচ্ছি না। সকাল থেকে তার ফোন বন্ধ। জীবিত উদ্ধার হওয়া যাত্রী মাসুদ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ঘাটে ভেড়ার জন্য আমাদের লঞ্চ সোজা আসছিল। অন্য একটা লঞ্চ বাঁকা রওনা দিয়েছে। ফলে আমাদের লঞ্চের মাঝামাঝিতে ধাক্কা লাগে। এতে সঙ্গে সঙ্গে লঞ্চটি কাত হয়ে ডুবে যায়। নিজের অবস্থান বর্ণনা দিয়ে ওই যাত্রী বলেন, আমি কেবিনে ছিলাম। গ্লাস খুলে বের হয়েছি। ভেতরে আমার আপন দুই মামা ছিলেন। তারা বের হতে পারেননি। তাদের খোঁজ করছি। ঘটনাস্থলে উপস্থিত বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক সাংবাদিকদের বলেন, দুই লঞ্চের কর্মীদের অসতর্কতায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে তারা মনে করছেন। উদ্ধার অভিযান শেষে এ বিষয়ে তদন্ত শুরু হবে। অন্যদিকে, লঞ্চডুবির ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএ। একই ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৩২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজদের উদ্ধারে তৎপরতা অব্যাহত আছে। উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন। তিনি বলেন, এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা হবে। উদ্ধারকৃত লাশগুলো ময়নাতদন্তের জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। সেখানেও স্বজনদের ভিড় জমে। তাদের আহাজারিতে ওই এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।