করোনার সেকেন্ড ওয়েভ কী, সেরকম কিছু কি আসতে যাচ্ছে?

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ করোনাভাইরাস মহামারী শেষ হতে আরো বহু সময় বাকি। কখন শেষ হবে সেটাও কেউ বলতে পারে না। কোনো কোনো দেশে এখনও প্রচুর সংখ্যক মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। যেসব দেশ ভাইরাসটিকে ইতোমধ্যে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে, তাদের মধ্যেও সংক্রমণ দ্বিতীয় দফায় ফিরে আসা নিয়ে ভীতি রয়েছে। একে বলা হচ্ছে সেকেন্ড ওয়েভ বা দ্বিতীয় ঢেউ। শতবর্ষ আগে স্প্যানিশ ফ্লু-ও দ্বিতীয় দফায় ফিরে এসেছিল এবং তাতে প্রথম দফার চেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। করোনাভাইরাসের সেকেন্ড ওয়েভও কি অবশ্যম্ভাবী? এবং এরকম কিছু হলে সেটা কতোখানি মারাত্মক হতে পারে?
সেকেন্ড ওয়েভ কী?
এটাকে সমুদ্রের ঢেউ এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। সামুদ্রিক ঢেউ যেমন উঠা নামা করে তেমনি করোনাভাইরাসের সংক্রমণও বাড়ে এবং তার পর আবার কমে আসে। এই উঠা নামা বা বাড়া কমার প্রত্যেকটা ধাপকে বলা হয় ঢেউ বা ওয়েভ। এর কোনো আনু্ষ্ঠানিক সংজ্ঞা নেই। ‘এটা ঠিক বৈজ্ঞানিক কিছু নয়, ওয়েভ বলতে আপনি যা বোঝাবেন সেটা অনেকটাই আবেগ-নির্ভর,’ বলেন যুক্তরাজ্যে ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মাইক টিলডেসলি। কেউ কেউ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়াকেই ওয়েভ বলেন। প্রথম ওয়েভেও কিন্তু কয়েকবার এই উঠা নামা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কিছু রাজ্যে সংক্রমণ কমে গিয়ে আবারও বাড়ছে, আবার কমছে।
প্রথম ঢেউটি তখনই সমাপ্ত হয়েছে বলা যাবে যখন ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা যাবে। এক্ষেত্রে সংক্রমণের হার নাটকীয়ভাবে কমে আসবে। এর পরে সংক্রমণ যখন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বৃদ্ধি পাবে তখনই সেটাকে দ্বিতীয় ঢেউ বা সেকেন্ড ওয়েভ বলা হবে। নিউজিল্যান্ডে ২৪ দিন পর এবং বেইজিং ৫০ দিন ভাইরাসমুক্ত থাকার পর সেখানে নতুন করে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে দেখা যায়। কিন্তু সেখানে দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে সেটা বলা যাবে না। তবে কোনো কোনো বিজ্ঞানী মনে করেন ইরানে যেভাবে পুনরায় সংক্রমণ ঘটছে সেটাকে সেকেন্ড ওয়েভের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। সংক্রমণ দ্বিতীয় দফায় ফিরে আসা নিয়ে অনেকের মধ্যে উদ্বেগ থাকলেও কোনো দেশে সেরকম কিছু ঘটবে কীনা সেটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। ব্রিটেনেও সেকেন্ড ওয়েভের বিষয়ে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত নন। তবে এরকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা পুরোপুরিই রয়ে গেছে। কারণ এখনও দেশটিতে সংক্রমণ ঘটছে। ব্রিটেনের মোট জনসংখ্যার মাত্র পাঁচ শতাংশ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে ধারণা করা হয় এবং তাদের সবার দেহেই যে এই ভাইরাসটি প্রতিরোধের ক্ষমতা তৈরি হয়েছে সেটাও নিশ্চিত করে বলা যাবে না। ‘বেশিরভাগ মানুষ এখনও আক্রান্ত হতে পারেন। ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে যেসব বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে সেগুলো তুলে নেওয়া হলে আবারও ফেব্রুয়ারি মাসের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে,’ বলেন লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন এন্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ড. অ্যাডাম কুচারস্কি।
কী কারণে সেকেন্ড ওয়েভ আসতে পারে?
ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে জারি করা হয়েছে লকডাউন। কিন্তু এর ফলে সারা দেশেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে। বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছে, বিঘ্নিত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা, স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াও ঠিক মতো হচ্ছে না। তবে এটাও বাস্তবতা যে লকডাউনের কারণে ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। ‘দৈনন্দিন জীবনে কতো কম বিঘ্ন ঘটিয়ে করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সেটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন,’ বলেন ড. কুচারস্কি। এবিষয়ে কেউই শতভাগ নিশ্চিত নন। আর একারণে লকডাউনের মতো বিধি-নিষেধ ধাপে ধাপে তুলে নেয়া হচ্ছে। এছাড়াও ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে নেয়া হচ্ছে নতুন নতুন ব্যবস্থাও। এসবের মধ্যে রয়েছে কনটাক্ট ট্রেসিং অর্থাৎ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে যারা এসেছেন তাদেরকে খুঁজে বের করে আলাদা করে রাখার ব্যবস্থা এবং মুখে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা।
ড. কুচারস্কি বলেন, ‘সংক্রমণের নিয়ন্ত্রণ একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে নিয়ে আসার আগে বিধি-নিষেধ ‍তুলে নেওয়া হলে যুক্তরাজ্য ও তার প্রতিবেশি দেশগুলোতে সংক্রমণের ঘটনা অনেক বেড়ে যেতে পারে।’ এরকম ঘটনা ঘটেছে জার্মানিতে যেখানে একটি কসাইখানায় প্রকোপ দেখা দেয়ার পর এক হাজারেরও বেশি কর্মীকে আক্রান্ত বলে শনাক্ত করা হয়েছে। এধরনের আক্রান্ত গ্রুপকে যদি খুব দ্রুত শনাক্ত করা যায় তাহলে সেটা বড় কোনো সমস্যা নয়। তখন স্থানীয়ভাবে লকডাউন জারি করে ভাইরাসের বিস্তার ঠেকানো সম্ভব। সেরকম করা না হলে সেকেন্ড ওয়েবের ঘটনা ঘটতে পারে। মহামারীর শুরুর দিকে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সফল দেশ দক্ষিণ কোরিয়াতে নতুন করে সংক্রমণ দেখা দিলে সেখানে পুনরায় কিছু কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করতে হয়েছে।
সেকেন্ড ওয়েভ কি প্রথম দফার মতোই হবে?
যদি সেকেন্ড ওয়েভ আসে তাহলে বুঝতে হবে কোথাও বড় ধরনের ভুল হয়েছে। মহামারীর শুরুর দিকে এক ব্যক্তির মাধ্যমে গড়ে তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর অর্থ ভাইরাসটি খুব দ্রুত ছড়াচ্ছিল। কিন্তু এর পর মানুষের আচরণে কিছু পরিবর্তন ঘটে, তারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাফেরা করতে শুরু করে, ফলে সংক্রমণের এই হারও কমে আসতে শুরু করে। ড. কুচারস্কি বলেন, ‘কোনো দেশই সব বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করে আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে না।’ ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশে, যেখানে ভাইরাসটি এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি, সেসব দেশেও সংক্রমণের হার তিনে পৌঁছায়নি। তবে তাত্ত্বিকভাবে সেকেন্ড ওয়েভ প্রথম ধাপের চেয়েও খারাপ হতে পারে কারণ এখনও বহু মানুষের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ‘যদি আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বাড়তে থাকে, তখন আমরা পুনরায় লকডাউন জারি করতে পারি দ্বিতীয় ঢেউ ঠেকাতে,’ বলেন ড. টিলডেসলি।
সেকেন্ড ওয়েভ কখন হতে পারে?
ড. কুচারস্কি বলেন, বিধি-নিষেধ তুলে নেয়া হলে আগামী কয়েক সপ্তাহে কিম্বা কয়েক মাসে দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণের ঢেউ শুরু হতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ইউরোপে শীত কাল হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। কেউ কেউ বলছেন, শীতকালের দিকে সেকেন্ড ওয়েভের ঘটনা ঘটতেই পারে।
ভাইরাসটি কি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়বে?
সেকেন্ড ওয়েভ প্রথম দফার মতো মারাত্মক হবে না, এর পক্ষে একটি যুক্তি হলো ভাইরাসটি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়বে। ফলে এটি আর মানুষকে সহজে কাবু করে ফেলতে পারবে না। এইচআইভির ক্ষেত্রেও সেরকম হয়েছে। ‘তবে এরকমটাই যে হবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই,’ বলেন নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট প্রফেসর জনাথন বল। ভাইরাসের মধ্যে এধরনের পরিবর্তন ঘটতে অনেক সময় লাগে। করোনাভাইরাস মহামারী শুরু হওয়ার ছয় মাস পরেও পরিষ্কার নয় যে এই ভাইরাসের ঠিক কী ধরনের রুপান্তর ঘটেছে। এটা কতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে বা এটা আগের চেয়ে বর্তমানে কতোটা কম প্রাণঘাতী সেসব বিষয়ও এখনও খুব একটা স্পষ্ট নয়। প্রফেসর বল বলেন, ‘আমি মনে করি ভাইরাসটি এখনও বেশ ভালোই করছে। অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন যাদের মধ্যে উপসর্গও দেখা দিচ্ছে না। তাই করোনাভাইরাস দুর্বল হয়ে পড়েছে এরকমটা ভাবার কোনো কারণ নেই।’
সূত্র : বিবিসি