করোনা: দেশে লাখ ছাড়ানো শনাক্তের সংখ্যা যেসব বার্তা দিচ্ছে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ দেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত করার কথা ঘোষণা করা হয়েছিল গত ৮ মার্চ, আর সেই থেকে ১০৪ দিনে এই ভাইরাসে সংক্রমিতদের শনাক্তের সংখ্যা সব মিলিয়ে এক লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশীদের একটি, ভারতে শনাক্তকৃত আক্রান্তের সংখ্যা এক লক্ষ ছাড়িয়েছে ১০৯ দিনের মাথায়। বাংলাদেশ ও ভারতের মতো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও করোনাভাইরাসে সংক্রমিতদের শনাক্ত করার হার এভাবেই ধীর গতিতে বাড়ছে। সে হিসেবে বাংলাদেশে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা পিক বা সর্বোচ্চ শিখরে যেতে আরও ৪২ দিন থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে আশঙ্কা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। আবার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর পর করোনাভাইরাসের সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থানের স্থায়িত্ব একটা দীর্ঘ সময় ধরে হতে পারে বলেও তারা আশঙ্কা করছেন।
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পড়ার পর প্রথম কয়েকদিন দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ছিল এক অংকের ঘরে। পরে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শনাক্তের সংখ্যাও ক্রমশ বাড়তে থাকে। প্রথম শনাক্ত হওয়ার প্রায় এক মাসের মাথায় ৯ এপ্রিল একদিনে শতাধিক ব্যক্তি করোনাভাইরাস বহন করছেন বলে শনাক্ত হন। এরও প্রায় এক মাসের মাথায় গত ১১ মে একদিনে শনাক্তের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে যায়। এভাবে শনাক্তের মোট সংখ্যা মোট ৫০ হাজার ছাড়ায় গত ২ জুন। অর্থাৎ বাকি ৫০ হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছে শেষের ১৬ দিনে। সামনে দিনগুলোতে এই সংখ্যা আরও বাড়তে থাকবে, আর এভাবে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ক্রমেই সংক্রমণের চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন সাবেক পরিচালক বেনজির আহমেদ বলেন, জুন মাসের প্রথম দিন থেকেই গ্রাফটা খুব খাড়াভাবে ওপরের দিকে উঠছে। এটা সামনের দিনগুলোতে আরও বাড়তে থাকবে। ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসে শনাক্তদের সংখ্যার দিক থেকে প্রথম ২০টি দেশের তালিকায় ঢুকে গেছে বাংলাদেশ। ইতালি বা ব্রাজিলের কয়েকটি শহরে যেভাবে সংক্রমণের বিস্ফোরণ দেখা গিয়েছিল, বাংলাদেশেও কোন একটি জনপদে এমন সংক্রমণের বিস্ফোরণ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন আরেকজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ অনেক ঘনবসতিপূর্ণ। এখানে স্বল্প আয়ের মানুষেরা খুব গাদাগাদি করে থাকেন। এমন পরিবেশে আক্রান্তের সংখ্যায় বিস্ফোরণ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায় – ব্রাজিলে সাও পাওলো বা রিও ডি জেনিরোতে যেমনটা দেখা গেছে। ব্রিটেনে করোনাভাইরাস ছড়ানোর পিক টাইম প্রায় ৪২ দিন ধরে স্থায়ী ছিল। বাংলাদেশে এর চাইতেও বেশি সময় ধরে এই পিক টাইম স্থায়ী হতে পারে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বেনজির আহমেদ। ইউরোপের আরেক দেশ ইতালিতে পিক টাইমের স্থায়িত্ব ছিল আরও কম। সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা যেমন দ্রুত গতিতে বেড়েছে, তেমনি দ্রুত গতিতে সেটা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে আবার বেশ দ্রুত নেমেও এসেছে। দেশটিতে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ৩০ জানুয়ারি। মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার গ্রাফ হু-হু করে উপরের দিকেই উঠতে থাকে। মার্চের শেষের দিকে শনাক্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। এরপর ধীরে ধীরে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমে আসতে থাকে। অর্থাৎ প্রথম কোন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়া থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে ধীরে ধীরে নেমে আসা, ইতালিতে এই পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে দুই মাসের মধ্যে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রথম শনাক্তের পর তিন মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখানে আক্রান্তের সংখ্যা এখনও উর্ধ্বমুখী। বাংলাদেশে আক্রান্তের হার কবে নাগাদ সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছাবে, সেটা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে এই চূড়ান্ত পর্যায় কখন আসবে এবং সেটা কতো সময় ধরে স্থায়ী হবে সেটা নির্ভর করবে, কতো টেস্ট করা হচ্ছে, মানুষ কতোটা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে, সরকার কতোটা কঠোরতা আরোপ করছে এবং নজরদারি করছে – এসবের ওপর। লকডাউনের কড়াকড়ি, যথাযথ আইসোলেশন এবং কোয়ারেন্টিন ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার মাধ্যমে চীন ও ইতালি দ্রুত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দমন করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ সেই নীতি অনুসরণ করলে সংক্রমণের মাত্রা ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, চীন ও ইতালির দেখাদেখি বাংলাদেশ যদি শুরু থেকেই লকডাউনে কড়াকড়ি আরোপের পাশাপাশি কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন সঠিক ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসতো, তাহলে এতদিনে বাংলাদেশ সংক্রমণের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে নীচে নেমে আসা শুরু করতো। তবে এখনও যদি কঠোরভাবে জোনভিত্তিক লকডাউন কার্যকর করা হয়, রোগী শনাক্ত করে তাদের যথাযথ চিকিৎসা দেয়া হয় অর্থাৎ কমিউনিটি থেকে যদি সংক্রমণ কমিয়ে আনা যায়, তাহলে সংক্রমণের বিস্ফোরণ রোধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন মুশতাক হোসেন।
সেক্ষেত্রে এক থেকে দেড় মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত পর্যায় দেখা যেতে পারে বলে তিনি জানান। একই মত বেনজির আহমেদেরও। তিনিও জোর দিয়েছেন জোনভিত্তিক লকডাউন কার্যকর করার ওপরে। সরকার জোনভিত্তিক লকডাউন কার্যকরভাবে সম্পাদন না করলে, আর সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যবিধিগুলো মানতে দায়িত্বশীল না হলে, চূড়ান্ত পর্যায় আসতে আরও দেরি হবে, বলেছেন তিনি। বেনজির আহমেদ আরও বলেন, সংক্রমণের ঝুঁকি হিসেবে যদি এক হাজারটি হটস্পট বা রেড জোন চিহ্নিত করে লকডাউন করা হয় এবং প্রতিটি রেড জোনে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দলের মাধ্যমে কড়াকড়ি আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা হয়, তাহলে ৪২ দিনের মাথায় সর্বোচ্চ সংখ্যাটি দেখা যাবে। না হলে সামনের দিনগুলোয় এই সংখ্যা আরও বাড়বে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন। অন্যদিকে মুশতাক হোসেনের আশঙ্কা হলো, করোনাভাইরাসে সংক্রমণের কার্ভ একবার নেমে যাওয়ার পর সেটা হয়তো আবারও উর্ধ্বমুখী হতে পারে। যেমনটা দেখা গিয়েছিল স্প্যানিশ ফ্লু’র সময়টাতে। ইউরোপে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর ওইসব দেশ থেকে যে যাত্রীরা বাংলাদেশ এসে বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলেন, তাদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে বলে ধারণা করছেন বেনজির আহমেদ। বিদেশ থেকে আসা সেই মানুষেরা সীমিত সংখ্যায় ছিলেন। তাদের কোয়ারেন্টিনের বিষয়টি পুরোপুরি না হোক আংশিক হলেও নিশ্চিত করা গেছে। এরপর সরকার আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়, আর ২৬ মার্চ থেকে ‘সাধারণ ছুটি’ কার্যকর করা হয়। সে সময়ে করোনাভাইরাসের কার্ভ নিচের দিকেই ছিল। কিন্তু যখন থেকে ‘লকডাউন’ শিথিল করা হয়, গার্মেন্টস, দোকানপাট, অফিস আদালত খুলে দেয়ার পাশাপাশি টেস্টের সংখ্যাও বাড়ানো হয়, তখন থেকে সংক্রমণের উর্ধ্বমুখী চিত্র নজরে আসে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এই উর্ধ্বমুখী ধারা দেখে বলছেন, সামনে এটা আরও বাড়বে। বেনজির আহমেদ বলেন, লকডাউন চলা অবস্থায় গার্মেন্টস কারখানাগুলো খুলে দেয়া হয়েছে, ঈদের সময় বিভিন্ন দোকানপাট চালু করা হয়, ঈদকে ঘিরে বিপুল সংখ্যক মানুষ যাতায়াত করেছে। লকডাউনের সেই শিথিলতার প্রভাব এখন দেখা যাচ্ছে। ইতালি ও চীনে দ্রুত চূড়ান্ত পর্যায় দেখতে পাওয়ার একটি বড় কারণ হল ম্যাস টেস্টিং অর্থাৎ গণহারে নমুনা পরীক্ষা। সে কারণে ওই দেশগুলোয় উর্ধ্বমুখী কার্ভ দেখা গেছে বলে জানান বেনজির।
বাংলাদেশে জনসংখ্যার অনুপাতে নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষার সংখ্যা এখনও অনেক কম। সাম্প্রতিক দিনগুলোয় দৈনিক ১৫ হাজার থেকে ১৭ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। শুরুতে এই পরীক্ষার সংখ্যা ছিল কয়েকশো’র মতো। বর্তমানে টেস্টের সংখ্যাও বাড়ানোয় আক্রান্তের এই উর্ধ্বমুখী চিত্র নজরে আসছে বলে মনে করেন বেনজির আহমেদ। তবে ম্যাস টেস্টিং করা হলে প্রকৃত সংখ্যা বেরিয়ে আসতো এবং সেই হিসেবে সংক্রমণের পিক নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা দেয়া সম্ভব হতো বলে তিনি জানিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা ও সক্ষমতার প্রশ্নে ম্যাস টেস্টিং কঠিন বলে মনে করছেন মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে টেস্টিংয়ের যে সক্ষমতা তার ওপর চাপ পড়ছে, তাই যাদের লক্ষণ নেই তাদের সবার টেস্ট করা সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে বিকল্প উপায় খুঁজতে হবে। যেমন এক্স-রে’র মাধ্যমে যদি কারও নিউমোনিয়া পাওয়া যায়, তাহলে তাদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করে চিকিৎসা দিতে হবে।