পাপুলে গরম কুয়েতি পার্লামেন্ট

0

মিজানুর রহমান॥ মানবপাচার চক্রের এশিয়ান নেটওয়ার্কের মূল হোতা বা অভিযুক্ত হিসেবে আটক বাংলাদেশি সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে কুয়েতি পার্লামেন্টে। করোনাকালীন সংক্ষিপ্ত এবং জরুরি ইস্যুগুলোর আলোচনার জন্য আহ্বান করা ওই অধিবেশনে পাপুলকাণ্ড উত্তাপ ছড়িয়েছে। সরকার ও বিরোধী দলের অন্তত ৬ জন সংসদ সদস্য এ নিয়ে পার্লামেন্ট সেশনে বক্তৃতা করেছেন। সবচেয়ে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়েছেন প্রভাবশালী সংসদ সদস্য আবদুল কারিম আল কান্দারি। তবে এমপি ইউসুফ আল ফাদালা ও আবদেল ওয়াহাব আল বাবতেনও কড়া কথা বলেছেন। এমপি কান্দারি বারবার পাপুলকে মাফিয়া বস ও বাঙালি, বলে তিরস্কার করছিলেন। স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেন, একজন বাঙালি মাফিয়া এতোটা আস্কারা কোত্থেকে পেলো? এটা কীভাবে সম্ভব যে ১০০ লোক নিয়োগের অনুমতি সংক্রান্ত ডকুমেন্ট জাল করে হাজার শ্রমিককে কুয়েতে নিয়ে আসতে পারলো? রিমান্ডে পাপুল সব বলেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই বাঙালি অনেকের নাম বলেছে তা দ্রুত প্রকাশ করতে হবে। কুয়েতি নাগরিক যার নামই আসুক না কেন তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে, বিচার করতে হবে। আর পাপুল ইস্যুতে কুয়েতি এমপি বাবতেন রীতিমতো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়কে গ্রিল করেছেন। কড়া ভাষায় বক্তৃতা দেয়া ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি চেয়ে পার্লামেন্টে নোটিশ দেন তিনি। কুয়েতি এমপিরা পার্লামেন্টে প্রায় অভিন্ন সুরে বলেন, বাঙালি মানবপাচারকারীকে যারা সহযোগিতা করেছে তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। কারণ তারা ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য দেশ, জাতি-ধর্ম সব কিছুকে ম্লান করে দিয়েছে। এজন্য তাদের শাস্তি পেতেই হবে।
এদিকে এমপি পাপুল কুয়েতের দুজন বর্তমান এবং সাবেক এক এমপিকে ঘুষ দেয়ার কথা স্বীকার করেছেন মর্মে আগেই খবর বেরিয়েছিল। এ ইস্যুতেও ইঙ্গিতপূর্ণ আলোচনা হয়েছে সংসদ অধিবেশনে। বর্তমান দুই এমপির নাম মূল ধারার গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশ না হলেও তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানাভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। আরব টাইমস ওই দুই নাম পেয়েছে তবে তারা এখনই প্রকাশ করছে না। কারণ হিসাবে তারা বলছে, বাংলাদেশি এমপির দাবির সত্যতা নিশ্চিতে দুর্নীতিদমন কমিশনসহ কুয়েতে একাধিক তদন্ত চলমান রয়েছে। সংবাদ মাধ্যমটি জানিয়েছে, অভিযুক্ত ওই দুই এমপি সদ্য শেষ হওয়া পার্লামেন্ট অধিবেশনে যোগ দেন এবং এ ইস্যুতে আচমকা কথাও বলেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের প্রতিপক্ষরা না-কী পরিকল্পিতভাবে প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে, এমন দাবি করে তারা পাপুলের কাছ থেকে অন্যায় সুবিধা নেয়ার দায় অস্বীকার করেন। অবশ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থাকা কুয়েতের উপ-প্রধানমন্ত্রী আনাস আল সালেহ সংসদে প্রদত্ত বিবৃতিতে ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, ভিসা বাণিজ্যে রাষ্ট্র হিসাবে কুয়েতের নিরাপত্তা বা অস্তিত্ব আজ হুমকির মুখে। এমপি পাপুলের মুখ থেকে যাদের নাম এসেছে তাদের বিষয়ে বিস্তৃত তদন্ত হচ্ছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তারা রেহাই পাবে না। এমপি, মন্ত্রী, বিশিষ্টজন যেই হোন তাদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
দু’জন সরকারি কর্মকর্তা আটক, ৩ জনকে তলব
এদিকে আরব টাইমসের পৃথক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৯ ঘণ্টার টানা জিজ্ঞাসাবাদের শেষ দিনে পাপুল যে দু্ইজন সরকারি কর্মকর্তাকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মোটা অঙ্কের ঘুষ দেয়ার কথা স্বীকার করছিলেন তাদের আটকের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। সিআইডি তাদের আইনের আওতায় আনছে। এদের একজন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বড় পদে রয়েছেন। স্মরণ করা যায়, গত সোমবার আরব টাইমস তাদের এ সংক্রান্ত প্রথম রিপোর্টে জানিয়েছিল- পাপুলকে বাঁচাতে কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা মধ্যস্থতার ভূমিকায় ছিলেন। মূলত পাপুলের অর্থ সরিয়ে নেয়ার কাজটি সহজ করে দিতে তিনি তার হাইলি পেইড এজেন্ট হিসেবে কনসালটেন্সি করছিলেন। তাকে যে অর্থ দেয়া হয়েছে তার দালিলিক প্রমাণও হাতে পেয়েছে সিআইডি।
ওদিকে পৃথক রিপোর্টে কাল আরব টাইমস জানিয়েছে, পাপুলের স্বীকারোক্তিতে লাক্সারি কারসহ মূল্যবান উপহার গ্রহণকারী হিসেবে যে ৩ জন কর্মকর্তার নাম এসেছে তাদের তলবের সিদ্ধান্ত হয়েছে। যার মধ্যে জনশক্তি বিভাগের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তাও রয়েছেন। পাপুলের বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ প্রদানে ব্যর্থতার দায়ে জনশক্তি বিভাগের উচ্চ পদস্থ ওই কর্মকর্তাকে গত মঙ্গলবার সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। কুয়েতের সমাজকল্যাণ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক মন্ত্রণালয় দেখভালে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মরিয়ম আল আকিল এক নোটে ৩ মাসের জন্য তাকে সাসপেন্ড করেন এবং ৫০ শতাংশ বেতন কর্তনের আদেশ দেন। উল্লেখ্য পাপুলকাণ্ডের ৭ জন সিনিয়র কর্মকর্তা (টপ বস) এবং ৩ টি সংস্থায় কর্মরত অন্তত ২১ জন ফেঁসে যাচ্ছেন বলে রিপোর্ট বেরিয়েছে। গত ৬ই জুন রাতে কুয়েতের মুশরেফ এলাকার বাসা থেকে সিআইডি পুলিশ তাকে আটক করে। পরদিন তাকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থাপন করে রিমান্ড চাওয়া হয়। আদালত ১৪ই জুন পর্যন্ত তার রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডে বাংলাদেশি এমপি কিছু কিছু অভিযোগ স্বীকার করলেও তিনি তার ব্যবসায়িক পরিচয়কে সামনে রাখেন। বলেন, আমি ব্যবসা করেছি, এতে ভুলভ্রান্তি হতে পারে। তবে আমি জানাতে চাই ৩৪টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছি। আমার অধীনে ৯ হাজার শ্রমিক কাজ করে কুয়েতে। তাছাড়া তিনি বাংলাদেশের সংসদের একজন সদস্য উল্লেখ করে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। রিমান্ড চলাকালে এমপি পাপুলের আইনজীবীরা দফায় দফায় তার জামিন চেয়েছেন, কিন্তু আদালত তা বরাবরই নাকচ করেছেন। আরব টাইমসের রিপোর্ট মতে, কুয়েতের ইতিহাসে মানবপাচার বিষয়ক সবচেয়ে যুগান্তকারী ও চাঞ্চল্যকর ওই মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগারে থাকতে হচ্ছে। তবে তার যেসব সহযোগী আটক হয়েছেন (দেশি-বিদেশি) জুলাইর মাঝামাঝিতে তাদের বিষয়ে শুনানি হতে পারে। জানা গেছে এমপি পাপুল ইস্যুতে কুয়েত সিটিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের শীর্ষ পর্যায়ের দু’জন কর্মকর্তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তাদের ব্যক্তিগত ব্যাংক একাউন্ট তালাশ করা হচ্ছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদও করা হতে পারে। তবে তারা ডিপ্লোমেটিক ইমিউনিটিপ্রাপ্ত হওয়ায় প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। ফলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ না-কী ঢাকা ফেরত পাঠানো হবে তা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে। পাপুলকাণ্ডে দূতাবাসের দু’জন কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এগুলোকে ‘বিভ্রান্তি’ আখ্যা দিয়ে কমিউনিটির প্রতি একটি রহস্যজনক ভিডিও বার্তা দিয়েছেন রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালাম। তিনি ঢাকায় টেলিফোন করেও দূতাবাসের সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন বলে জানা গেছে।
সূত্র-মা/জ