সহযোগীরা নজরদারিতে ইউরোপে অর্থ পাচার পাপুলের

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ কুয়েতে আটক বাংলাদেশি সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের এক সপ্তাহের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠিয়েছে দেশটির পাবলিক প্রসিকিউশন। এক আদেশে বলা হয়েছে, রিমান্ডে তিনি কুয়েতে তার অপকর্মের সহযোগী সাবেক এবং বর্তমান যেসব কর্মকর্তার নাম বলেছেন, তাদের গতিবিধি নজরদারিতে রাখতে হবে। একই সঙ্গে কাজী পাপুল এবং তার মানবপাচার, অর্থপাচার ও ভিসা বাণিজ্যের অবৈধ কর্মের সহায়ক স্টাফ বা পার্টনার যারা ধরা পড়েছেন তাদের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আটক রাখতে। ১৪ই জুন পাপুলের প্রাথমিক রিমান্ড শেষ হয়। তার রিমান্ড পরবর্তী আদেশ বিষয়ে কুয়েতি সংবাদ মাধ্যম আরব টাইমস বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে বাংলাদেশের এমপি যে সব তথ্য দিয়েছেন তাতে কুয়েতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং প্রশাসনে অনেক চাঞ্চল্য অপেক্ষা করছে জানিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়- অভিযুক্ত ওই এমপি তার কাজের সুবিধার জন্য কুয়েতি প্রশাসনের বড় ক’জন কর্মকর্তাকে মোটা অঙ্কের ঘুষ এবং উপহার দিয়েছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন অবসরে চলে গেছেন। আরব টাইমস-এর রিপোর্ট মতে, ১১ জন বাংলাদেশি ভিকটিম যাদের প্রত্যেকে পাপুলকে ভিসা এবং কুয়েতে থাকার জন্য অর্থ দিয়েছেন তাদের মুখোমুখি করা হয়েছিল।
একই সঙ্গে আটক তার কোম্পানির একজন পরিচালক যিনি কানাডার নাগরিক এবং একজন মিশরীয় স্টাফকেও পাপুলের মুখোমুুখি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডি। এতে তদন্ত দল পাপুলের অবৈধ পথে বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদ আহরণ এবং তা অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার প্রমাণ পায়। সমপ্রতি কয়েক মিলিয়ন দিনার ইউরোপীয় এবং উপসাগরীয় অঞ্চলে সরিয়ে নেয়ার দালিলিক প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়ে আরব টাইমসের রিপোর্টে বলা হয়- পাপুলের এসব কাজে কুয়েতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মধ্যস্থতার ভূমিকায় ছিলেন। মূলত পাপুলের অর্থ সরিয়ে নেয়ার কাজটি সহজ করে দিতে তিনি তার হাইলি পেইড এজেন্ট হিসেবে কনসালটেন্সি করছিলেন। এদিকে আল কাবাসের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে- গত ফেব্রুয়ারিতেই পাপুল টের পেয়েছিলেন সিআইডি তাকে তাড়া করছে। তিনি তাদের রাডারেই আছেন। যেকোনো মুহূর্তে জালে আটকে পড়তে পারেন। সেই সময়ের অভিযানে তার এক সহযোগী ধরা পড়ার পর তিনি এবং তার অন্য সহযোগী সুযোগ বুঝে কুয়েত সিটি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। আরব টাইমসও বলছে, বেশকিছু দিন তিনি গা-ঢাকা অবস্থায় ছিলেন। কিন্তু এবার তিনি কুয়েতে ঢুকেছিলেন তার কুয়েত সিটির অফিসটি গুটিয়ে নিতে। উপসাগরীয় অন্য একটি দেশে ব্যবসাটা স্থানান্তরের পথে তিনি বেশ অগ্রসরও হয়েছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে সিআইডি তাকে পাকড়াও করে ফেলে। জিজ্ঞাসাবাদের সূচনাতে এমপি পাপুল নিজেকে নির্দোষ দাবি এবং মানবপাচার ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ অস্বীকার করলেও মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদে অপকর্মগুলোর দায় মাথা পেতে নিয়েছেন।
এদিকে বাংলাদেশি এমপিকে গ্রেপ্তার এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদে মানবপাচার, ভিসা বাণিজ্য এবং অর্থ পাচারে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হাজির করতে পারায় সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের চৌকস কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ দিয়ে স্বরাষ্ট্র ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বে থাকা কুয়েতের উপ-প্রধানমন্ত্রী আনাস আল সালেহ এবং কুয়েত সিটির প্রভাবশালী সংসদ সদস্য আবদুল কারিম আল কান্দারি এ নিয়ে টুইট করেছেন এমপি ইউসুফ আল ফাদালা ও আবদেল ওয়াহাব আল বাবতেন। তারা উভয়ে দেশটির দুর্নীতি দমন ডিপার্টমেন্টের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশি এমপি’র কুয়েতি সহযোগী এবং বেনিফিশিয়ারিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। এমপি বাবতেল তার টুইট বার্তায় বলেন, যেসব কুয়েতি কর্মকর্তা অর্থ পেয়ে বাংলাদেশি মানবপাচারকারীকে সহযোগিতা করেছে তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে। কারণ তার বেনিফিশিয়ারি হয়েছে, কিন্তু আমাদের দেশ, জাতি-ধর্ম সব কিছুকে ম্লান করেছেন। এ জন্য তাদের শাস্তি পেতে হবে।
আল-কাবাসের রিপোর্টে একজন নারীর সম্পৃক্ততার তথ্য
সিআইডির বরাতে গত ১২ই ফেব্রুয়ারি এমপি পাপুল লাপাত্তা হওয়ার খবর প্রথম প্রকাশ করেছিল আরবি দৈনিক আল-কাবাস। গতকাল প্রকাশিত পাপুলনামার সর্বশেষ কিস্তিতে তারা একজন নারীকে জিজ্ঞাসাবাদের খবর দিয়েছে। বলা হয়েছে, ওই নারী সহকর্মী তদন্ত টিমকে অনেক চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন। মূলত তিনি পাপুলের ব্যক্তিগত ফাইলপত্র, ট্রানজেকশনের বিষয়গুলো দেখভাল করতেন। ভিনদেশি ওই নারীর তথ্যে পাপুলের সন্দেহজনক অনেক লেনদেনের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে সিআইডি। কুয়েতিরা ফেঁসে যাচ্ছেন: ওদিকে ন্যায় বিচারের স্বার্থে বাংলাদেশি এমপি’র কমান্ডে কাজ করা কুয়েতিরা ফেঁসে যাচ্ছেন বলে খবর প্রকাশ করেছে কুয়েতের সবক’টি সংবাদ মাধ্যম। রোববারের প্রতিবেদনে পাপুলের কাছ থেকে ঘুষ, উপহার বা উপঢৌকন দিয়ে মানবপাচার, মানিলন্ডারিং এবং ভিসা বাণিজ্যে যারা সহযোগী ছিল তাদের ফোকাস করেছে। আরব টাইমস ৭ জন কর্মকর্তা এবং ৩টি সংস্থার তথ্য জড়িত থাকার ইঙ্গিত করেছে। আল-কাবাসও তা-ই বলছে, যেটুকু ট্রান্সলেশনে বোঝা গেছে। তবে দেশটির প্রভাবশালী ৩ জন এমপি এবং খোদ উপ-প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে কথা বলেছেন। তারা সবাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে পাপুলের কুয়েতি সহযোগীদের কাঠগড়ায় দেখতে চেয়েছেন এবং এটি নিশ্চিতে নিজেদের অবস্থান থেকে কাজ করার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। আল-কাবাসের রিপোর্টে দেশটির প্রভাবশালী রাজনীতিকদের সোচ্চার হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, পাপুল বাংলাদেশ তথা এশিয়ান মানবপাচারকারী নেটওয়ার্কের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তিনি কুয়েতে সংবেদনশীল অবস্থানে রয়েছেন। দেশি-বিদেশি পার্টনার নিয়ে কুয়েতে তিনি কোম্পানি করেছেন, যার আড়ালে তার সব অবৈধ বাণিজ্য ছিল। বাংলাদেশে একটি ব্যাংকের পরিচালক তিনি। অর্থ সংগ্রহ এবং পাচারে ওই ব্যাংককে বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন তিনি। কাবাস তার ফেব্রুয়ারির রিপোর্ট এখনো স্ট্যান্ড করে। তখন তারা সিআইডির বরাতে জানিয়েছিল এমপি পাপুল এবং তার দুই সহযোগী মিলে অন্তত ২০ হাজার বাংলাদেশিকে কুয়েতে চাকরির নামে পাচার করেছেন এবং প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তবে ওই অর্থ তিনি কুয়েতে রাখেননি। তার আমেরিকান পার্টনারের মাধ্যমে বড় অংশ অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত ৬ই জুন রাতে কুয়েতের মুশরেফ এলাকার বাসা থেকে সিআইডি পুলিশ তাকে আটক করে। পরদিন তাকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উপস্থাপন করে তার রিমান্ড চাওয়া হয়। আদালত ১৪ই জুন পর্যন্ত তার রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ পর্যন্ত এমপি পাপুলের আইনজীবীরা ৩ দফা তার জামিন চেয়েছেন, কিন্তু আদালত তা বরাবরই নাকচ করেছেন। পাপুলের সহযোগী দূতাবাসের কর্মকর্তারাও নজরদারিতে: এমপি পাপুল ইস্যুতে কুয়েত সিটিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের শীর্ষ পর্যায়ের দু’জন কর্মকর্তাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তারা কূটনীতিক সুবিধাপ্রাপ্ত হওয়ায় গ্রেপ্তার হবেন না। তবে যেকোনো সময় তাদের প্রত্যাহারে ঢাকাকে অনুরোধ করা হতে পারে। কূটনৈতিক শিষ্টাচার তা-ই বলে উল্লেখ করে দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, এমপি পাপুলের অপকর্মের কুয়েতের রাজনীতি এখন উত্তাল। সেই এমপিকে দূতাবাসের কারা সহযোগিতা দিয়েছেন সেটি ঢাকাও জানে। উল্লেখ্য, পাপুল গ্রেপ্তারের পর তার স্ত্রী একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে গণমাধ্যমকে ব্লেম দিয়ে রাষ্ট্রদূত সবই জানেন দাবি করে তার কথার বাইরে গিয়ে ‘বিভ্রান্তি’ না ছড়ানোর রহস্যজনক বার্তা দিয়েছেন। দু’দিন আগে রাষ্ট্রদূত এস এম আবুল কালাম পাপুল ইস্যুতে কোনো আপডেট না জানিয়ে বরং ‘বিভ্রান্তি’ না ছড়াতে কুয়েতস্থ বাংলাদেশ কমিউনিটিকে হুঁশিয়ার করেছেন। বাংলাদেশ ও কুয়েত সরকার উভয়ে বিবৃতিদ্বয় নোটে নিয়েছেন বলে জানা গেছে।