মরণঘাতী করোনা ও পথের পাঁচালি

0
তৈমূর আলম খন্দকার
করোনার কারণে বিশ্বে ভবিষ্যৎ যে অচলাবস্থা ও মন্দা দেখা দেবে তা মোকাবেলার জন্য খাদ্যাভ্যাসের সাথে সাথে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে হবে। প্রতি বাড়িতে এয়ার কন্ডিশনার (এসি), ফ্রিজ, ওভেন থাকার ফ্যাশনের সাথে সাথে প্রতিটি পরিবার বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব আয়েশী ব্যবস্থা মানুষকে ঠাণ্ডা করে রাখছে বটে, কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে করে তুলেছে উষ্ণ। ফলে কৃত্রিম উষ্ণতার কারণে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যক্তি স্বার্থে, কোথাও বনে আগুন লাগিয়ে, কোথাও অহরহ গাছ কেটে পৃথিবীকে অক্সিজেনশূন্য করা হচ্ছে অথচ অক্সিজেনই মানুষ বেঁচে থাকার প্রধান উপাদান। না খেয়ে মানুষ কয়েক দিন বাঁচতে পারে, কিন্তু অক্সিজেন ছাড়া এক মুহূর্তও বাঁচা যায় না। তা ছাড়া এসি বার্স্ট হয়ে মৃত্যুর কিছু ঘটনাও শোনা যায়। এসি যারা নিয়মিত ব্যবহার করেন, তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। কোরবানির গোশত পরবর্তী কোরবানি পর্যন্ত খাওয়ার জন্য সব ধরনের খাদ্যই ফ্রিজিং করা হয়। ফ্রিজে থাকার ফলে খাদ্যের পুষ্টিগুণ কমে যাওয়ায় মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অন্য দিকে, ফ্রিজে থাকা খাদ্য ওভেনে গরম করায় ওভেন থেকে সৃষ্ট রশ্মি নির্গত হওয়ায় ক্যান্সার বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন। এক্স-রে করার সময় যে রে বা রশ্মি বিচ্ছুরিত হয় সে রকম রে থেকেই ওভেনে ঠাণ্ডা খাদ্যগুলো গরম হয়ে থাকে বলে একটি জার্নালে প্রকাশ।
এ মর্মে বিস্তারিত জানতে চাইলে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়ার জন্য অনুরোধ রইল। একজন পরিশ্রমী মানুষের শরীরে যে পরিমাণ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে, এর চেয়ে অনেক কম প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকে তাদের যারা আরাম আয়েশে জীবনযাপন করেন। করোনায় তারাই বেশি কাবু হয়েছেন, যারা আয়েশী জীবনযাপন করেছেন। এ জন্যই করোনা প্রতিরোধে অন্যান্য ব্যবস্থার পাশাপাশি ব্যায়াম করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরামর্শ দিচ্ছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া এত গরম নয় যে, এখানে বৈদ্যুতিক পাখায় শরীর ঠাণ্ডা হয় না। অথচ প্রতিটি অফিসেই এখন এসি এবং মসজিদগুলোতে পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতামূলকভাবে এসি লাগানো হচ্ছে। মানসিকতা হলো, উত্তরপাড়ার মসজিদে এসি থাকলে দক্ষিণপাড়ার মসজিদে এসি না থাকাটা মান-সম্মানের বিষয় (!)
বিজ্ঞানের কারণে মানুষ যেমন শৌখিন হয়েছে, তেমনি শৌখিনতার প্রতিযোগিতায় ব্যক্তি ও পারিবারিক বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এ অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে কোথাও দুর্নীতি, কোথাও চাঁদাবাজি অথবা কোথাও রোজগারের ক্ষেত্রকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রসার করতে হয়েছে। এ কারণেও প্রকৃতি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানবজাতি ভূগর্ভস্থ পানি মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ছাড়াও অপচয় করছে বিধায় পৃথিবীর ভূমি স্তর হুমকির মুখে রয়েছে এবং যেকোনো সময় যেকোনো এলাকা দেবে যেতে পারে। ভূমিকম্পের আভাস এর আগেও অনেকবার ভূ-বিজ্ঞানীদের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে। সূরা আল মুলকের ৩০ নম্বর আয়াতে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লøাহ পাক বলেছেন, ‘তোমরা ভেবে দেখেছ কি? যদি পানি ভূগর্ভে তোমাদের নাগালের বাইরে চলে যায়, তাহলে কে তোমাদের এনে দেবে প্রবহমান পানি?’ অতএব, মানবজাতিকে সব প্রস্তুতি মোকাবেলাসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় যাতে না হয় এ জন্য ‘প্রকৃতিবান্ধব’ জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হওয়া খুবই জরুরি।
পবিত্র কুরআন শরিফের সূরা বাকারায় ২০১ নম্বর আয়াতে আল্লøাহ পাক মানবজাতিকে এ মর্মে প্রার্থনা করার কৌশল শিখিয়েছেন, যা হলো ‘হে আল্লাহ, তুমি আমাকে ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ দান করো।’ এ কথাই আল্লাহ বুঝাতে চেয়েছেন, শুধু পরকাল নয় বরং দুনিয়ার কল্যাণের জন্যও চেষ্টা চরিত্র করতে হবে। আল্লøাহ তায়ালা আরো বলেছেন, পানি থেকে পৃথিবীর সব কিছু সৃষ্টি করেছি। (সূরা ফোরকান, আয়াত ৫৪) পৃথিবীর শক্তির উৎস ‘বিদ্যুৎ’ পানি থেকেই সৃষ্টি করা হয়। অতএব, পানি মানুষের জন্য একটি অপরিহার্য বস্তু। অথচ পানিই মানবজাতির কাছে সবচেয়ে অবহেলিত, মিল ফ্যাক্টরির কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি এবং নদী-নালার পানি এখন যেন অতিরিক্ত দূষণে বিষে রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে মাছসহ জলজসম্পদ হুমকির মুখে। ভারতের একটি প্রদেশে যেকোনো হোটেলে এক গ্লাস পানি চাইলে আধা গ্লাস দেয়া হয়। কারণ মানুষের স্বভাব গ্লাসের পানি অর্ধেক পান করে বাকি অর্ধেক ফেলে দেয়া, যা মূল্যবান পানির অপচয়। আমরা মনে করি, ভারতের ওই নিয়ম পৃথিবীর সর্বত্র চালু হওয়া উচিত। অর্থাৎ, পানির অপচয় বন্ধ হওয়া দরকার। বাংলাদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বোতলজাত পানি সরবরাহ করার পদ্ধতি চালু হয়েছে। অনেক নামী দামি শিক্ষিত লোককে দেখেছি, এক ঢোক পান করে বাকি পানিসহ বোতলটি ফেলে দেন। এ পরিস্থিতিতে বোতলের পানি যতটুকু পান করা দরকার তা পান করে বাকি পানিসহ বোতলটি হাতে করে নিয়ে আসি এবং পরে প্রয়োজন মতো বাকি পানি ব্যবহার করি। এ কারণে পানিকে মূল্য দেই যে, ‘পানির অপর নাম জীবন’ হওয়া সত্ত্বে¡ও ‘পানিই আজ সর্বাধিক অবহেলিত’। মৃত্যু যন্ত্রণাকালে মানুষ আত্মীয়স্বজনের কাছে একটু পানিই কামনা করে থাকে। আল্লাহ তায়ালা স্পষ্টই বলছেন, ‘পান করো, পরিমিত আহার করো, কিন্তু অপচয় করো না।’ অথচ সেই অপচয়ের মধ্যেই মানবজাতি ডুবে আছে এবং যাদের নতুন টাকা-পয়সা হয়েছে তারা অপচয়কে ফ্যাশন মনে করে অভিজাত শ্রেণীর কাতারে ওঠা অন্যায় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।
আগে গ্রামাঞ্চলে হাঁটলে অনেক পুকুরে ‘এলেঞ্জা’ (লাউগাছের ডগার মতো) দেখা যেত, যা খেয়ে মানুষ ঔষধি গাছের উপকার পেত। এখন তো পুকুরই দেখা যায় না, যে পুকুরে মাছ, এলেঞ্জা বা লাল পদ¥ ও শাপলা শোভাবর্ধন করত। শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল। এ ছাড়াও এটি একটি উৎকৃষ্ট সবজি। পদ¥-শাপলা আমাশয় রোগীদের জন্য বিশেষ উপকারী বলে শুনে আসছি। যদিও কিছু পুকুর চোখে পড়ে তাও (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) শরিকদের অন্তর্কলহের কারণে কচুরিপানায় ভরে গিয়ে হাজামজা হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও পরিবারের সদস্য বৃদ্ধি পাওয়ায় পুকুর ভরাট করেই ঘর নির্মাণ করে বসবাস করা হচ্ছে; যদিও Water Body হিসেবে জলাধার বা পুকুর ভরাট করা আইনত অপরাধ। সরকারি নির্দেশ এবং প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে লঙ্ঘন করে ভূমিদস্যুরা রাজধানীর আশপাশেসহ বিভিন্ন জেলায় খাল, বিল, নদী-নালা, জলাভূমি, তিন ফসলি জমি ভরাট করে আবাসন প্রকল্প বানিয়ে পরিবেশকে ভারসাম্যহীন করে তুলছে। অথচ ১৯৯৫ সালের পরিবেশ আইন ও ২০০০ সালের পরিবেশ আদালত আইন মোতাবেক পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা আইনগত অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আবাসন প্রকল্পের নামে তিন ফসলি ধানী জমিগুলোতে শতাধিক ‘সিটি’র সাইনবোর্ড এখন রাজধানীর আশপাশের জেলাগুলোতে দেখা যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্বীকৃত মতেই রাজধানীতে ২৬টি খালের নারায়ণগঞ্জের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় কংশ নামে একটি নদীর কথা শুনেছি, কিন্তু সেখানে কোনো পানি নেই, গড়ে উঠেছে বড় বড় বিল্ডিং। ভূমিদস্যুদের ভয়াল থাবা রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, সোনারগাঁও, কেরানীগঞ্জ, সভার, আশুলিয়া সর্বত্রই প্রসারিত, কিন্তু সরকার, রাজউক, পরিবেশ অধিদফর ও রাষ্ট্র এ সম্পর্কে নির্বাক, নীরব দর্শক। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদ মোতাবেক প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি প্রভৃতির নিরাপত্তা বিধান করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ব্যাংক লুট এবং ভূমি দস্যুতা একই সূত্রে গাঁথা। ভূমি দস্যুরা জানে, এ দেশের প্রশাসনকে টাকা দিয়ে ক্রয় করা যায়, অনায়াসেই তাদের মুখ বন্ধ রাখা সম্ভব। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় [স্মারক নং-পবম-৪/৭/৮৭/২০০০/৫৭২, তাং-২৩/০৭/২০০০] একটি পরিপত্র জারির মাধ্যমে পরিবেশ আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ দায়ের করার জন্য জেলা প্রশাসককে ক্ষমতা অর্পণ করলেও আইন ও সরকারের উক্ত আদেশ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ। ফলে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও খাল, বিল, নদী-নালাসহ তিন ফসলি জমি ভরাটের কাজ জোর কদমে ভূমিদস্যুরা চালিয়ে যাচ্ছে; জনপ্রতিনিধিরা অনেকেই ভূমিদস্যুদের সাথে একাত্ম হওয়ার কারণে ফসলি জমির মালিক ও চাষিরা এখন সম্পূর্ণরূপে অসহায়। এ সব অসহায় মানুষের দীর্ঘ নিঃশ্বাস থেকেই যেন করোনাভাইরাসের উৎপত্তি।
পরিবেশ রক্ষা, পরিবার ও নিজের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সম্পূর্ণরূপে সরকারের ওপর নির্ভর করলে হবে না। কারণ সরকার এক দিকে আইন করে, অন্য দিকে সরকারি ক্ষমতাপ্রাপ্ত লোকেরাই আইন ভঙ্গ করে। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে রাষ্ট্রীয় আইন দু’ভাগে প্রয়োগ হয়। সরকারি দলের জন্য আইনের প্রয়োগ এক রকম, অন্যদের জন্য তা ভিন্নতর। নতুবা একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালককে হত্যার হুমকি বা গুলি করে বিশেষ ব্যবস্থায় সরকারি ঘরানার শিল্পপতি সিকদার গ্রুপের মালিকেরা এয়ারপোর্ট অতিক্রম করাে কিভাবে? রন সিকদারদের এ আত্মবিশ্বাস ছিল যে, কাউকে গুলি করে হত্যা করলে আইন তাদের কাছেই ঘেঁষতে পারবে না এবং সেই আত্মবিশ্বাস থেকে ব্যাংক লুটেরাদের এহেন লম্ফঝম্ফ। বিরোধী ঘরানার বা দলের লোক হলে পাঁচটি এজেন্সি তথা ডিএফআই, এসবি, এনএসআই প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় দফতরের সম্মতি নিয়ে এয়ারপোর্ট অতিক্রম করতে দেয়া হয়। ওমরাসহ বিদেশে যাত্রাকালে ইমিগ্রেশনে আমাকে দেখামাত্রই বহুবার পাসপোর্ট নিয়ে নিয়েছে, অতঃপর ঘণ্টা ২ পরে এজেন্সিগুলোর ক্লিয়ারেন্স এলে প্লেনে উঠতে দেয়া হয়েছে, নতুবা নয়। এখানেই রাষ্ট্রীয় আইন প্রয়োগের নমুনা। এ ঘটনা নতুন নয়, আমিসহ বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের এ ধরনের কাহিনী কয়েকবার জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। অথচ গুরুতর মামলার আসামি বিদেশে চলে যাওয়া সম্পর্কে সরকার কিছুই জানে না বলে সরকারি বক্তব্যে লজ্জিত হওয়া ছাড়া সাধারণ নাগরিকদের কোনো কিছু করার নে।
দেশে বেশি খাদ্যাভাবে রয়েছে ছিন্নমূল যারা বস্তিতে থাকে, আরো রয়েছে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা। ছিন্নমূল মানুষের সম্পদ তাদের দেহ, রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষ্ঠ বণ্টন হয় না বিধায় রিকশাচালকের সন্তান রিকশা চালকই হয়, মুচির ছেলে মুচিই থেকে যায়। ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্নতর কিছু থাকতে পারে, তবে তা খালি চোখে দেখার মতো নয়, অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে দেখতে হবে। করোনা মহামারীতে আশ্চর্য বিষয় এই যে, ডাক্তাররা চেম্বার ফেলে যেন পালিয়ে গেল। অথচ একজন ডাক্তার সৃষ্টি করতে রাষ্ট্রকে অনেক অর্থ ভর্তুকি দিতে হয়। তা ছাড়া একজন সৈনিক যদি মৃত্যুর ঝুঁকি না নিতে পারে তবে সেনাবাহিনীতে নাম লেখাবে কেন? এখন ফেসবুকে যেমন প্রেম হয়, ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন সেভাবে চলছে। অথচ থাইল্যান্ডে, ভারতে দেখেছি যে, ডাক্তারা রোগীর সাথে সময় নিয়ে কথা বলেন, শরীর ধরে ধরে জিজ্ঞাসা করেন কোথায় কেমন লাগে। সরকারের সমালোচনাকে রুটিন ওয়ার্ক না বানানোর জন্য সরকার মুখপাত্র ৪ জুন ২০২০ সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু জনগণ যদি রাষ্ট্রের কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হয় তবে জনগণ বা রাজনৈতিক দলগুলো কার সমালোচনা করবে এ কথাটিও সরকারি মুখপাত্র তার বক্তব্যে পরিষ্কার করলে বিষয়টি জবাবদিহিমূলক হতো। ২৭ মে ২০২০ রাজধানীর ব্যয়বহুল ইউনাইটেড হাসপাতালে পাঁচজন করোনা রোগী আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। রানা প্লাজার ধ্বংসের কারণে ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ভবনের নকশা অনুমোদনের দায়িত্বে নিয়োজিত সাভার পৌরসভার মেয়র ও পৌর ইঞ্জিনিয়ারকে যেখানে কারাবরণ করতে হয়েছে সেখানে ইউনাটেড হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কর্তৃক আইনগত কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি কেন? ক্ষতিগ্রস্তদের পরিবার থেকে থানায় মামলা করা হয়েছে বটে, কিন্তু আইনি অ্যাকশন কতটুকু হচ্ছে তা জনগণের কাছে এখনো পরিস্ফুটিত হয়নি। প্যানেল কোডের ধারা ৩২/৩৩ এবং ৩০৪(ক) মোতাবেক ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ অবশ্যই ফৌজদারি আইনের আওতায় অভিযুক্ত হয়েছেন। ফৌজদারি মামলা ছাড়াও দেওয়ানি ও টর্ট আইনে (LAW OF TORT) ক্ষতিপূরণ মামলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে করা যায়। এ মামলাগুলো রুজু করার দায়িত্ব শোকাহত পরিবারের ওপর না অর্পণ করে রাষ্ট্রের নিজ উদ্যোগে করাই হবে একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্রের কর্তব্য। কারণ বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে মোকদ্দমার বাদি হতে কতটুকু লবণ, তেল, মরিচ, হলুদের প্রয়োজন হয় তা অবশ্যই সরকারপ্রধান অবগত রয়েছেন। সর্বদিক বিবেচনা করে হাইকোর্ট থেকেও স্বউদ্যোগে রুল প্রত্যাশা করছি, ইতঃপূর্বে অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ মামলায় হাইকোর্ট স্বউদ্যোগে রুল ইস্যু করে আদালতের মর্যাদা সমুন্নত রেখেছেন। ল্যাটিন ভাষায় আইনি প্রবাদ (Maxim) ‘Qui facit per alium facit per see’ মোতাবেক ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাওয়ার অপরাধী।
সরকারি হাসপাতালে ডাক্তার না পাওয়ার অভিযোগ, অভিযোগ রয়েছে প্রাইভেট হাসপাতালগুলো কসাইখানায় পরিণত হওয়ার। ৫ মে ২০২০ মিডিয়াতে প্রকাশ যে, আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে করোনা রোগীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকার বিল আদায় করছে। করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট আসার পরও একজন রোগীকে তিন দিন হাসপাতালে রেখে অতিরিক্ত বিল আদায় করেছে, অথচ এ বিল পরিশোধ করার কথা ছিল সরকারের। করোনা পরিস্থিতির উদ্ভব না হলে স্বাস্থ্য বিভাগের দৈন্য দশা বোঝা যেত না। হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে স্বামীর মৃত্যু, একই কারণে হাসপাতালের গেটে মাকে ফেলে রেখে ছেলের পলায়ন প্রভৃতি ঘটনা থেকেই বোঝা যাচ্ছে, রাষ্ট্র থেকে অসহায় জনগণ কতটুকু স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে? ইতোমধ্যে রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি চিকিৎসাধীন হয়েছেন। আল্লাহর কাছে তাদের আশু রোগমুক্তি কামনা করি। পাশাপাশি ডা: জাফর উল্ল্যাহ চৌধুরী যদিও সরকারবিরোধী তথাপি একজন মুক্তিযোদ্ধা ও পরীক্ষিত সমাজ হিতৈষী ব্যক্তি হিসেবে জাফর উল্লাহকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা করানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, তাতে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমর্র্যাদা উজ্জ্বল হবে। বিদ্যুৎ বিভাগের ভুতুড়ে বিলের মতোই ‘মানবতার মন্দির’ বা ‘মানবতার কেন্দ্রস্থল’ হাসপাতালগুলোর ক্ষেত্র বিশেষে এক দিকে সমান্তরাল চেহেরা, অন্য দিকে সরকারের সমালোচনাকে রুটিন ওয়ার্ক না করায় সরকারি মুখপাত্রের প্রচ্ছন্ন অথচ ভদ্রোচিত হুমকির মধ্য দিয়েই জনগণকে করোনা অতিক্রম করতে হচ্ছে। আল্লাহ বলেছেন, ‘রোগাক্রান্ত হলে আপনি (আল্লাহ) আমাদের (মানবজাতিকে) রোগমুক্ত করেন।’ (সূত্র : আশ-হুআবা, আয়াত ৮০) হে পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা, আপনি সদয় হয়ে নিজ উদ্যোগে মানবজাতিকে মরণঘাতী করোনামুক্ত করুন। কারণ করোনা মানবজাতির কর্মফল। এখানে মুক্তিলাভের জন্য আপনার সীমাহীন দয়াই একমাত্র ভরসা, যেমন আপনি (আল্লাহ) যুগে যুগে ধ্বংস থেকে অকৃতজ্ঞ, সীমা লঙ্ঘনকারী মানবজাতিকে ক্ষমা করেছেন।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
[email protected]