‘স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বাজেট চাইতে পারে না, খরচও করতে পারে না’

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ করোনা পরিস্থিতিতে দেশের স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা, ভঙ্গুর চিত্র ক্রমশই বের হয়ে আসছে। রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছে না, বেসরকারি হাসপাতাল রোগী ফেরত দিচ্ছে, করোনার শুরুতে চিকিৎসকদের নকল সুরক্ষা সামগ্রী (এন-৯৫) প্রদানসহ নানা অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম যেন খোলা বইয়ের মতো দেখিয়ে দিচ্ছে দেশের স্বাস্থ্য খাত কতটা দুর্বল, কতটা অনিয়মের আখড়া।
করোনার এই কঠিন সময়কে ছাপিয়ে বৃহস্পতিবার (১১ জুন) জাতীয় সংসদে উপস্থাপন হচ্ছে ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট। আর শুরু থেকেই এবারের বাজেটে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে স্বাস্থ্য খাত। কম বাজেট পাওয়া স্বাস্থ্যখাতে এবারে বেশি বাজেট বরাদ্দের পাশাপাশি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বে স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ পায় বাংলাদেশ। তবে শুধু বরাদ্দ বাড়িয়ে স্বাস্থ্যখাতের কোনও উন্নতি হবে না। কোন খাতে, কোথায়, কীভাবে স্বাস্থ্য বাজেটকে ব্যবহার করা হবে সে বিষয়ে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত লোকের অভাব রয়েছে মন্ত্রণালয়ে। তারা বাজেট চাইতেও পারে না, খরচও করতে পারে না।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বাজেটের বেশিরভাগ খরচ হয় সংশ্লিষ্টদের বেতন-ভাতা ও অবকাঠামো নির্মাণে। অপরদিকে, যোগ্য মানুষের অভাবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের টাকা ফেরত যায়। যোগ্য মানুষের অভাব, স্বাস্থ্যে বাজেট বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও বর্তমান ব্যবস্থাপনার চিত্র না বদলালে সুফল মিলবে না বলেও মন্তব্য তাদের। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের বেশ কিছু টাকা ফেরত যায়, খরচ করার অপরাগতার জন্য। এসব কিছু মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়াতে সবচাইতে কম দেওয়া স্বাস্থ্য বাজেটের সুষম বণ্টন হয় না। একইসঙ্গে স্বাস্থ্য বিভাগে উপযুক্ত-যোগ্য মানুষের অভাব। তারা বোঝে না কোথায় কী করতে হবে, কিভাবে কোথায় খরচ করতে হবে, আর দুর্নীতি যদি কমানো না যায় তাহলে কোনও লাভ নেই। তাই বাজেট বাড়াতে হবে, দুর্নীতি কমাতে হবে, একইসঙ্গে বাজেট খরচ করার সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’
‘স্বাস্থ্যে আমাদের বাজেট এক শতাংশের কম । তারপরও যতটুকু হয় তার প্রোপার ইউটিলাইজেশন হয় না’ মন্তব্য করে জনস্বাস্থ্যবিদ চিন্ময় দাস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাজেট তো বাড়াতেই হবে, তবে কেবল বাজেট বাড়ালেই খুব যে লাভ হবে তাও নয়, এর সঙ্গে দরকার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন। বাজেটে পাওয়া অর্থ ঠিকমতো খরচ করতে জানতে হবে। আমাদের দেশে বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ হয় অনেক কম। তারপরও বাজেটের টাকাও ফেরত যায় কীভাবে?’ অধ্যাপক নজরুল ইসলামের মতোই চিন্ময় দাস বলেন, ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার যে জায়গাগুলোতে যেসব যোগ্য মানুষদের দরকার তারা সেখানে নেই। আর ব্যবস্থাপনার ত্রুটিই এখানে।’ তিনি বলেন, ‘‘দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতোটা ভঙ্গুর অবস্থাতে রয়েছে করোনার সময়ে সেটা সামনে এসেছে। এর মূল কারণ অব্যবস্থাপনা, সিস্টেম যাদের হাতে থাকা দরকার, তাদের হাতে যদি থাকতো তাহলে এর মধ্যেও কাজ করা যেত, এত ‘ভাঙচুর’ হতো না।’’
বিশ্ব ব্যাংকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা বিষয়ক কর্মকর্তা জিয়াউদ্দিন হায়দার বলেন, ‘দ্য ইকোনমিস্টের সবশেষ ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জিডিপির তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম খরচ করা দেশের তালিকায় বাংলাদেশ। আবার জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিকের (এসকাপ) ২০১৮ সালের জরিপে দেখা গেছে, স্বাস্থ্য খাতে জিডিপি অনুপাতে বরাদ্দ পাওয়া এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ৫২টি দেশের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। একইসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশ্বব্যাংক ২০১৯ সালে স্বাস্থ্য খাতের আর্থিক সুরক্ষার বৈশ্বিক প্রতিবেদনে দেখা যায় স্বাস্থ্যসেবায় বিশ্বে সবচেয়ে কম খরচ হয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। এর মধ্যে আবার বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। দেশের চার শতাংশ মানুষ অতিদরিদ্র হয়ে যায় স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত খরচের জন্য। এ থেকেই বোঝা যায় দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কত খারাপ।’ তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির জন্য অনেকগুলো রিফর্ম করতে হবে। এজন্য স্বাস্থ্যের বাজেট বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে তার বাস্তবায়ন এবং লাল ফিতার দৌরাত্ম কমাতে হবে। স্বাস্থ্যখাতের যোগ্য ব্যক্তিদের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে, যেন তারা প্রয়োজন অনুযায়ী টাকা চাইতে পারেন, খরচ করতে পারেন। কিন্তু সেটা হয় না বলেই আজ স্বাস্থ্যের বেহাল দশা।’
দেশের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি দীর্ঘদিনের মন্তব্য করে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ অনেক কম। চলতি বছরে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের বা জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ এবং মোট বাজেট ব্যয়ের ৪ দশমিক ৯ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে, আর মাথাপিছু বরাদ্দ মাত্র ১ হাজার ৫৩৭ টাকা। এত কম টাকা দিয়ে এত বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া সক্ষমতা নেই। সুতরাং বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে এতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ দেওয়ার পরও বাজেট ব্যবহার করার সক্ষমতা, বাস্তবায়নের হার খুবই কম অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের তুলনায়।’ ড. ফাহমিদা বলেন, ‘চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ২৫ থেকে ২৬ শতাংশ তারা বাস্তবায়ন করতে পেরেছে অথচ অন্য মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়নের হার গড়ে ৪৫ শতাংশ। সুতরাং তাদের বাস্তবায়নের সক্ষমতা নাই, আবার যা দেওয়া হয় সেটা গুণগতভাবে ব্যবহার করা হয় না।’ তিনি বলেন, ‘চরম অব্যবস্থাপনা চলছে। আগ্রহ বেশি প্রক্রিউরমেন্ট আর ভৌত অবকাঠামোতে। কারণ ওখানে দুর্নীতির সুযোগ অনেক বেশি। দুর্নীতির একটা চক্র গড়ে উঠেছে স্বাস্থ্য খাতকে কেন্দ্র করেও। যা এ খাতের উন্নয়নের জন্য বাধা।’
বরাদ্দের মূল অংশ চলে যায় বেতন-ভাতাতে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘গত বাজেটে এটা ছিল মূল বাজেটের ৪৭ শতাংশ। তারপর যায় ওষুধ এবং সার্জিক্যাল সাপ্লাইতে যায় ৩০ শতাংশ। এই দুই খাত মিলিয়ে ৭৫ থেকে ৭৭ শতাংশ বাজেট ব্যয় হয়।বাকি ২৫ শতাংশ ব্যয় অন্য উপখাতগুলোতে। একইসঙ্গে স্বাস্থ্যখাতের কোথায় বাজেট দরকার এবং কেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বাজেট চাইতে পারে না—এটা চিহ্নিত করা হয় না। ‘চিহ্নিত করা হয় না নাকি পারে না’—এমন প্রশ্নে অধ্যাপক হামিদ বলেন, ‘চেষ্টা করলে পারা যায়, তবে চেষ্টার অভাবই রয়েছে বলে মনে হয়। আর এসবের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যে কোয়ালিফাইড মানুষ দরকার তার সংখ্যা কম। যে কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বাজেট চাইতেও পারে না, খরচও করতে পারে না। আর দুর্নীতির বিষয় তো আছেই।’ বাজেট কেন খরচ হয় না জানতে চাইলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান বলেন, কিছুটা সময় যায় প্রক্রিয়া মানার জন্য। আবার বাজেটের পর নানা প্রকল্প শুরু করতে সময় লাগে, তখন আর পুরো টাকা খরচ করা সম্ভব হয় না। তাই প্রকল্পগুলো যদি আগেভাগে শুরু করা যায় তাহলেই এটা আর হয় না।