পুলিশি নির্যাতনের অভিযোগ, যশোরে কলেজছাত্র সঙ্কটাপন্ন

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যশোরে পুলিশের নির্যাতনে সঙ্কটপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ইমরান হোসেন নামে এক কলেজছাত্র। পরিবারের অভিযোগ, পুলিশি নির্যাতনে কিডনি বিকল হয়ে তার জীবনাশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তবে পুলিশ সুপার বলেছেন, তিনি ঘটনাটি শোনার পর পরই তদন্ত শুরু করেছেন। এ বিষয়ে পরস্পরবিরোধী তথ্য পাওয়া গেছে। যদি কোনো পুলিশ সদস্য এমন ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। অপরদিকে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের একজন কলেজছাত্রকে নির্যাতনের কথা অস্বীকার করেছেন।
নির্যাতনের শিকার ইমরান হোসেন (২৩) যশোর সদর উপজেলার হৈবতপুর ইউনিয়নের শাহবাজপুর গ্রামের নিকার আলীর ছেলে। ইমরানের ভাষ্য, তিনি সদর উপজেলার কাজী নজরুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। গত ৩ জুন বুধবার সন্ধ্যায় পাশের সলুয়া বাজার এলাকা থেকে ইজিবাইকযোগে নিজ বাড়ি ফিরছিলেন। এসময় তার সাথে একই এলাকার আরেকটি ছেলে ছিল। পথে আমবটতলাস্থ যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পৌঁছালে স্থানীয় সাজিয়ালি ক্যাম্পের পুলিশ সদস্যরা তাদের গতিরোধ করেন। এরপর তার সাথে থাকা ছেলেটির ব্যাগ তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। এসময় ভয়ে তিনি (ইমরান) দৌঁড় দেন। তখন পুলিশ ধাওয়া করে তাকে ধরে ফেলে এবং বেধড়ক মারপিট করলে তিনি জ্ঞান হারান। পরে আমবটতলার একটি ওষুধের দোকানে নিয়ে পুলিশ তাকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে তার জ্ঞান ফেরে। এরপর পুলিশ তার পকেটে গাঁজা দিয়ে আটকের কথা বলে। এক পুলিশ সদস্য তার (ইমরানের) পিতাকে ফোন দিয়ে তাকে ছাড়তে ২৫ হাজার টাকাও দাবি করেন। পরে ৬ হাজার টাকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এছাড়া মারপিটের ঘটনা কাউকে বললে রিমান্ডে নিয়ে ফের পেটানোর হুমকি দেয় পুলিশ।
ইমরান আরও বলেন, ‘ভয়ে আমি কাউকে কিছু বলিনি। কিন্তু পেটের ব্যথায় মরে যাচ্ছি বলে মনে হচ্ছিল। সহ্য করতে না পেরে মা-বাবাকে নির্যাতনের বিষয়টি জানাই। এরপর তারা আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। এখন যেন আমার পেটের মধ্যে সব ছিঁড়ে যাচ্ছে। কোনো ওষুধ শান্তি দিতে পারছে না। আমি মনে হয় বাঁচবো না।’
ইমরানের মা বুলবুুল বেগম বলেন, ‘এভাবে কেউ কাউকে নির্যাতন করতে পারে? আমার ছেলেটাকে শেষ করে ফেলেছে। ওর চিকিৎসা কীভাবে করাবো? বাঁচবে কি-না জানি না। আমি এ ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের শাস্তি চাই।’ ইমরানের বাবা নিকার আলী বলেন, বুধবার তার ছেলেকে নির্যাতনের পর পুলিশ সাজিয়ালী ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিলো। পরে তাকে খবর দিলে তিনি সেখানে যান। এ সময় পুলিশ তার ছেলেকে ছেড়ে দেওয়ার শর্তে ২৫/৩০ হাজার টাকা দাবি করেন। শেষমেষ তাদের এলাকার মেম্বার শাহাজান আলীর অনুরোধে পুলিশ ৬ হাজার টাকা নিয়ে তার ছেলেকে ছেড়ে দেয়। এ ঘটনার পরদিন ৪ জুন বৃহস্পতিবার সকালে তার ছেলে ফের অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু সেখানে যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়ায় গত ৭ জুন রোববার সন্ধ্যায় ছেলেকে ভর্তি করা হয় কুইন্স হসপিটালে। নিকার আলী বলেন, ‘আমার ছেলেটা লেখাপড়া করে। এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখেন, কোনো খারাপ কাজের সাথে নেই সে। অথচ তাকে ধরে নির্যাতন করা হলো। ডাক্তার বলেছেন, তার অবস্থা খুব খারাপ। আঘাতজনিত কারণে তার কিডনির ওপর রক্ত জমে গেছে বলেও ডাক্তার জানিয়েছেন। আমার ছেলের কখনো কিডনির সমস্যা ছিলো না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি এ ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যায়বিচার চাই।’ ইমরানের চিকিৎসক কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ উবায়দুল কাদির উজ্জ্বল বলেন, ‘ইমরানের দুটি কিডনির ফাংশন খুবই খারাপ। স্বাভাবিক অবস্থায় কিডনির ক্রিটেনিন ১ দশমিক ৪ থাকার কথা। কিন্তু ইমরানের তা ছিল ৮ দশমিক ৮। আজ এটা আরো বেড়েছে। দ্রুত তার ডায়ালাইসিস করতে হবে। তবে বলা যাচ্ছে না, সে রিকভারি করবে কি-না। তার অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন।’
এদিকে ইমরানের পিতা নিকার আলী জানান, সোমবার দুপুরে ডাক্তার তার ছেলের কিডনির ডায়ালাইসিস করেছেন। আবারও ডায়ালাইসিস করতে হবে বলে ডাক্তার তাদের জানিয়েছেন। এ বিষয়ে সাজিয়ালি পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ মুন্সি আনিচুর রহমান বলছেন, ঘটনার দিন সকালে তিনি জরুরি কাজে যশোর কোতয়ালি থানায় গিয়েছিলেন। সেখান থেকে রাত ১২ টার দিকে ক্যাম্পে ফেরেন। এসে জানতে পারেন এএসআই সুমারেশ সাহা, এএসআই সাজদার রহমান ও চার কনস্টেবল ওই কলেজছাত্রকে আটক করেছিল। কিন্তু সে অসুস্থ হওয়ায় প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে তাকে তার বাবার হাতে তুলে দেয়া হয়। ইমরানকে ছাড়তে কোনো টাকা-পয়সার লেনদেন হয়নি বলে দাবি করেন তিনি। যশোর পুলিশ প্রশাসনের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) মুহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়টি তারা শুনেছেন। পুলিশ সুপার মহোদয়ও জানতে পেরেছেন। বিষয়টি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সালাউদ্দিন শিকদার তদন্ত করছেন। তারা আসল ঘটনা জানার চেষ্টা করছেন।’
যশোরের পুলিশ সুপার মোহাম্মাদ আশরাফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি জানার পর তিনি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছেন। ওই ছেলেটি অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িত কি-না সেই খোঁজও নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত যে ইনফরমেশন পাওয়া যাচ্ছে তা হলো, পুলিশের কাছে তথ্য ছিল ওই রাস্তা দিয়ে মাদকদ্রব্য আসবে। সেই অনুযায়ী ওই ছেলে দুটোকে আটক করেছিল পুলিশ। এ সময় ইমরান নামে ছেলেটি দৌঁড়ে পালানোর চেষ্টা করে। পড়ে গিয়ে সে আঘাত পায়। পিছু ধাওয়াকারী পুলিশ সদস্যরা তাকে কাদার মধ্যে থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘করোনাকালে পুলিশ সদস্যদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যত কম সংখ্যক মানুষকে গ্রেফতার করা যায়, ততোই ভালো। এমনকি কোনো ব্যক্তির শরীরের কাছাকাছি যেতেও নিষেধ করা হয়েছে। ছেলেটির কাছে টাকা দাবির কথাও শুনেছি। যদি কোনো পুলিশ সদস্য টাকা লেনদেন বা শারীরিক নির্যাতনে জড়িত বলে প্রমাণিত হন, তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ এ ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের একজন এএসআই সুমারেশ সাহা বলেন, ছেলেটি (ইমরান) ভয়ে দৌড় দিয়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ তার পিছু নেয়নি। পরে তাদের সোর্স রফিকুল এসে তাদের খবর দেয় পাশের শ্যামনগর গ্রামের একটি পুকুর পাড়ে ছেলেটি পড়ে আছে। এ খবর পেয়ে তারা ছেলেটিকে উদ্ধার করে আমবটতলার একজন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। তিনি বলেন, ইমরানের পকেটে ১০ গ্রাম গাঁজা পাওয়া গিয়েছিলো। কিন্তু শাহাজান মেম্বারের অনুরোধে তাকে তার পিতার জিম্মায় ছেড়ে দেয়া হয়। তার পিতার কাছ থেকে কোন টাকা নেয়া হয়নি বলে দাবি করেন তিনি।