আম্ফানের তাণ্ডব, নিহত ৮

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ তীব্র ঝড়ো বাতাস আর বৃষ্টি ঝড়িয়ে সাগর থেকে উপকূলে উঠেছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এর মূল চোখ ভারতের দিকে। তবে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা ও সুন্দরবন অংশের ওপর তোপ দাগার পর আম্পানের বাংলাদেশ অংশটি উঠে গেছে স্থলভাগে এটি এখন সাতক্ষীরা খুলনা থেকে কুড়িগ্রাম- জামালপুরের দিকে চলে গেছে। প্রবল শক্তি নিয়ে ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ তাণ্ডব চালিয়েছে সুন্দরবনসহ বাংলাদেশের উপকূলে। সুপার সাইক্লোন আম্ফান কেড়ে নিয়েছে অন্তত ৮ জনের প্রাণ। নিহতদের মধ্যে পটুয়াখালীতে ২, ভোলায় ২, বরগুনায় ১, সাতক্ষীরায় ১, সন্দ্বীপে ১ ও পিরোজপুরে একজন রয়েছে। এছাড়া এর প্রভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক ঘর-বাড়ি ও গাছপালা ভেঙে পড়েছে। কয়েক ফুট বেড়েছে নদনদীর পানি। হুমকির মুখে রয়েছে বেড়িবাধ। ফলে বাধ ভাঙার আতংকে রয়েছেন উপকুলবাসী।
সাতক্ষীরা : বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন জানিয়েছেন, ঝড়ের কেন্দ্রে গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৪৮ কিলোমিটার। সাতক্ষীরায় রাত সাড়ে ৯টায় এমন গতিবেগ থাকলেও পরবর্তীতে এর গতিবেগ কমে এখন ১০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি নেমে এসেছে। আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কেন্দ্র সাতক্ষীরার খুব কাছ দিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ অতিক্রম করছে। সাতক্ষীরা শহরে রাত ৯টা থেকে ঘণ্টায় ১৪৮ কিলোমিটার বেগে ঝড়ো বাতাস বইছিল। তবে পরবর্তীতে রাত ১০টার পর ঝড়ের গতিবেগ কমে যায়। এর গতিবেগ কমে এখন ১০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি নেমে এসেছে। ঝড়টি এখানে এক থেকে দেড় ঘণ্টা অবস্থান করবে। এরপর স্থলভাগের আরও ওপরে উঠে যাবে। আম্পানের প্রভাবে জেলায় দমকা হাওয়া ও ঝড়ো বৃষ্টি হচ্ছে। ঝড়ের কারণ শহর দুপুর থেকেই বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছে। এর আগে সন্ধ্যায় তিনি জানান, ‘বিকাল ৪টা থেকে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের অগ্রভাগ সাতক্ষীরা-সুন্দরবন উপকূলে প্রবেশ করেছে। এটা ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত থাকবে। সাতক্ষীরা শহরে বিকাল ৫টা থেকে ঘণ্টায় ৭৫ কিলোমিটার বেগে ঝড়োবাতাস বইছে। বিকাল পর্যন্ত ৫২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
এদিকে সাগরের নিকটবর্তী এলাকাগুলোতে এরইমধ্যে ৫ থেকে ৭ ফুট জোয়ার হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতর আশঙ্কা করেছে, রাতে উপকূলীয় জেলাগুলোতে নিম্নাঞ্চলগুলোতে জোয়ারের সময় পানি উঠবে অনেক বেশি পরিমাণে। এসব এলাকায় ১৫ ফুট পর্যন্ত জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা আছে। পাশাপাশি ভারী বৃষ্টি হবে প্রায় সারারাতই। এদিকে, সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান জানান, ঝড়ের মধ্যে আম কুড়াতে গিয়ে সদরের কামালনগর এলাকার করিমুন্নেসা নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে সাতক্ষীরা শ্যামনগরের উপকূলীয় অঞ্চল, আশাশুনি ও সাতক্ষীরা সদরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কাঁচাঘর বাড়ি মৎস্যঘের ও ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে। আশাশুনির ৬টি পয়েন্ট ও শ্যামনগরের একটি পয়েন্টে বেঁড়িবাধ ভেঙে বিস্তীর্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এদিকে শহরের কামালনগর এলাকায় আম কুড়াতে যেয়ে গাছ চাপায় এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। গাবুরা এলাকার বাসিন্দা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আম্পানে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে পুরো গাবুরা ইউনিয়ন। আমার বাড়ির অধিকাংশ গাছ পড়ে গেছে। এই ঝড়ে আমাদের কংক্রিটের প্রাচীর পর্যন্ত পড়ে গেছে। সেই বিকাল থেকে ঝড় শুরু হয়েছে একটানা গভীর রাত পর্যন্ত চলছে। শ্যামনগরের গাজী আল ইমরান নামে এক স্বেচ্ছাসেবক বুড়িগোয়ালীনির ইউনিয়নের দাতানিখালি এলাকায় বেড়িবাঁধে ভাঙনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে নদীতে জোয়ার বৃদ্ধির কারণে প্রতাপনগরের কুড়ি কাউনিয়া, সুভদ্রা কাটি, চাকলা, হাজরাখালি পয়েন্টে বেঁড়ি বাধ লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এদিকে আশাশুনি সদরের জেলেখালি পয়েন্টে ভেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে।
অন্যদিকে, পটুয়াখালী সংবাদদাতা জানিয়েছেন, আম্পান ঝড়ে বাতাসের তীব্রতা বেড়েই চলছে। পাশাপাশি গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। এরইমধ্যে গাছ চাপা পড়ে এবং মানুষকে সতর্ক করতে গিয়ে নৌকা ডুবে উপজেলার প্রচারাভিযানে একটি ইউনিটের দলনেতা মারা গেছেন। গলাচিপা থানার ওসি মো. মনিরুল ইসলাম নিশ্চিত করেছেন সন্ধ্যায় গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি এলাকায় ঝড়ে গাছের ডাল ভেঙে এর নিচে চাপা পড়ে রাসেদ নামে ৬ বছরের একটি শিশু। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। অন্যদিকে, কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক নিশ্চিত করেছেন, পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় জন সচেতনতার প্রচার কাজ চালাতে গিয়ে ধানখালীর ছৈলাবুনিয়া এলাকায় খালে নৌকা ডুবে সিপিপি’র দলনেতা শাহআলম নিখোঁজ হন। পরে ডুবুরি দল তার লাশ উদ্ধার করেছে। তিনি জানান, জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে কলাপাড়া, গলাচিপা ও রাঙ্গাবালী উপজেলার অন্তত ১৭টি গ্রাম। এদিকে, পটুয়াখালীতে আম্পানের ক্ষয়-ক্ষতি মনিটরিং করার জন্য জেলা ও উপজেলায় ১০টি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। জেলায় মোট ৭৫২টি আশ্রয় কেন্দ্রে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে ৩২৫টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। পায়রা বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সতর্কাবস্থানে রয়েছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বন্দরের সব কার্যক্রম। পটুয়াখালীতে আম্পান মোকাবিলায় কাজ করছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, জনপ্রতিনিধি, কোস্টগার্ড, ফায়ার কর্মী, আনসার, স্বেচ্ছাসেবী সদস্যসহ সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে, পিরোজপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলা শহরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ১ নম্বর সড়কে দেয়াল চাপা পড়ে এক ব্যক্তি মারা গেছেন। তার নাম শাজাহান মোল্লা (৬০)। রাত সাড়ে আটটায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। মঠবাড়িয়া থানার ওসি মাসুদুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তার গ্রামের বাড়ি গিলাবাদ।
এদিকে, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে ভোলা জেলার ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গাছ চাপায় একজন ও ট্রলার ডুবে আরো একজনের মৃত্যু হয়েছে। এখনও থেমে থেকে দমকা হাওয়া বইয়ে চলছে। পুরো জেলা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বুধবার (২০ মে) চরফ্যাসন উপজেলার দক্ষিণ আইচা এলাকায় গাছ চাপায় ছিদ্দিকুর রহমান নামের ৭৫ বছর বয়সের এক বৃদ্ধ মারা গেছেন বলে নিশ্চিত করেছেন পুলিশ সুপার। অপর দিকে লক্ষ্মীপুরের মঝুচৌধুরীর ঘাট থেকে ৩০ জন যাত্রী নিয়ে ট্রলারযোগে উত্তাল মেঘনা পাড়ি দিয়ে ভোলায় আসার সময় রাজাপুর এলাকায় কূলের কাছাকাছি এসে ঢেউয়ের তোড়ে ট্রলারটি ডুবে যায়। এতে রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি মারা গেছেন। পরে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। তার বাড়ি বোরহানউদ্দিন উপজেলার মনিরাম এলাকায় বলে জানা গেছে। বিষয়টি বোরহানউদ্দিন থানার ওসি নিশ্চিত করেছেন।
অন্যদিকে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় আম্পান বাগেরহাটের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। আম্পানের তাণ্ডবে আতঙ্কে রাত কাটছে উপকূলবাসীর। যতই রাত বাড়ছে ততই বাড়ছে ঝড়ের তীব্রতা। তবে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারের শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের বগী এলাকার বেরিবাঁধ ভেঙে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত ছাড়া আর কোনও ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি । জেলা সদরসহ সবকটি উপজেলা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন রয়েছে। জোয়ার ও বৃষ্টির পানিতে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। ঘূর্ণিঝড় আম্পান থেকে রক্ষা পেতে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের প্রায় ২ লাখ ৬৮ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। এছাড়া প্রায় ২৩ হাজার গবাদি পশু নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বাগেরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( সার্বিক) মো. কামরুল ইসলাম এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, দুর্যোগ মোকাবেলায় জেলায় রেড ক্রিসেন্ট, স্কাউটস, সিপিপির মোট ১১ হাজার ৭০৮ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৮৫টি মেডিক্যাল টিম। এ জেলার জন্য ২০০ মেট্রিক টন চাল, নগত ৩ লাখ টাকা, শিশু খাদ্যের জন্য ২ লাখ টাকা, গো খাদ্যের জন্য ২ লাখ টাকা ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দিয়েছেন।
শুধু উপকূল নয়, দেশের উত্তরপ্রান্তের জেলা পঞ্চগড়েও আম্পানের প্রভাবে রাতে ঝড়ো হাওয়াসহ মাঝে মাঝে বৃষ্টি পড়ছে। সারাদিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও রাত ১০টা থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রাতে বইছে ঝড়ো হাওয়া। করোনাভাইরাসের কারণে এমনিতেই সন্ধ্যার পর থেকে রাস্তাঘাটে লোকজনের উপস্থিতি কম। ঝড় বৃষ্টির কারণে সুনসান নিরবতা নেমে এসেছে। রাতে একাধিকবার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া বইছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া পূর্বাভাস কেন্দ্রের বরাত দিয়ে পঞ্চগড়ের তেতুঁলিয়া প্রথম শ্রেণি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রহিদুল ইসলাম ঘূর্ণিঝড় আম্পান বাংলাদেশে আঘাত হানায় পঞ্চগড়েও এর প্রভাব পড়বে। ভারীবর্ষণের সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার কথাও বলেছেন তিনি। তিনি আরও জানান, বুধবার রাত তো বটেই আগামী বৃহস্পতিবার, শুক্রবার এবং শনিবারও হাল্কাসহ ভারীবর্ষণ হতে পারে। এটা রবিবার পর্যন্তও স্থায়ী হতে পারে। পঞ্চগড় জেলা পরিবেশ পরিষদের সভাপতি ও পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তৌহিদুল বারী বাবু জানান, হিমালয়ের কাছাকাছি পঞ্চগড়ের অবস্থান এজন্যই পঞ্চগড়ে আম্পানের কিছুটা প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হিমালয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে যাওয়ার সময় পঞ্চগড়ে ভারীবর্ষণ হতে পারে। এ সময় পঞ্চগড়ের কৃষকদের বোরো ক্ষেত ও ভুট্টাসহ বেশ কিছু ফল ও ফসলের ক্ষতি হতে পারে। পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন জানান, জেলার পাঁচ উপজেলার কৃষি বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ফলে কোথাও ক্ষয়ক্ষতি হলে তা তাৎক্ষণিক জানানো এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।