সুসংবাদের বার্তাবহ আলবিদা রমজান

0

মহিউদ্দীন মোহাম্মদ : গত হয়েছে মাগফেরাতের দশক। আজ শুক্রবার সিয়াম সাধনার ২১ তম দিন। শুরু হলো নাজাতের দশক। মুমিনের হৃদয়ের অলিন্দে বিদায়ের সুর অনুরণিত এখন। ক্রমাগত প্রান্তসীমার দিকে ধাবমান মাহে রমজান। গেল সন্ধ্যা থেকে রমজানের সার্বিক বরকত হাসিলের উদ্দেশ্যে এলাকার মসজিদে মসজিদে ইতেকাফে বসেছেন বহুমুমিন বান্দা। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি। যার একমাত্র গন্তব্য পবিত্র জান্নাত। আটখানা জান্নাত সুসজ্জিত মুমিন, মুত্তাকিকে সাদর সম্ভাষণ জানাতে। আছে সদর দরোজায় দাঁড়িয়ে রিদওয়ান। এ কারণে এক পরম সৌভাগ্যের রজনী উপহার দেয়া হয়েছে মুসলিম উম্মাহকে। যাকে হাজার মাস অপো উত্তম বলা হয়েছে কোরআনে। এই রজনি তালাশ করতে হবে প্রত্যেককে ইবাদতের মাধ্যমে। এটা সকলে পরিজ্ঞাত, জ্বিন আর মানবমন্ডলিকে একমাত্র সৃষ্টি করা হয়েছে রাব্বুল আলামিনের ইবাদতের জন্য। তাই আসুন ইবাদতে গুজরান হোক আমাদের বাকি কটা রমজান।
আমরা এখানে একুশে রমজান লাইলাতুল কদর তালাশ করা সম্পর্কিত হাদিস উদ্ধৃত করছি। আবু সালামা ইব্ন আব্দুর রহমান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “আমরা লাইলাতুল কদর সম্পর্কে আলোচনা করলাম, অতঃপর আমি আবু সায়িদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট যাই, তিনি আমার একান্ত বন্ধু ছিলেন। আমি তাকে বললাম: চলুন না খেজুর বাগানে যাই! তিনি বের হলেন, গায়ে উলের কালো চাদর। আমি তাকে বললাম: আপনি কি রাসূল [সা.] কে লাইলাতুল কদর সম্পর্কে বলতে শুনেছেন? তিনি বললেন: হ্যাঁ। আমরা রাসূলের [সা.] সাথে রমযানের মধ্যদশক ইতিকাফ করলাম। তিনি একুশের সকালে বের হয়ে আমাদেরকে খুতবা দিলেন। তিনি বললেন: ‘‘ আমি লাইলাতুল কদর দেখেছি, কিন্তু আমি তা ভুলে গেছি অথবা আমাকে তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অতএব তোমরা তা শেষ দশকের প্রত্যেক বেজোড় রাতে তালাশ কর। আমাকে দেখানো হয়েছে আমি মাটি ও পানিতে সেজদা করছি, যে রাসূলের সাথে ইতিকাফ করেছিল সে যেন ফিরে আসে”। তিনি বলেন: আমরা ফিরে গেলাম, কিন্তু আসমানে কোন মেঘ দেখিনি। তিনি বলেন: মেঘ আসলো ও আমাদের উপর বর্ষিত হল, মসজিদের ছাদ টপকে বৃষ্টির পানি পড়ল, যা ছিল খেজুর পাতার। সালাত কায়েম হল, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখলাম পানি ও মাটিতে সেজদা করছেন। তিনি বলেন: আমি তার কপালে পর্যন্ত মাটির দাগ দেখেছি”। আবু সায়িদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত অপর বর্ণনায় আছে, তিনি বলেন: “আমরা রাসূলের [সা.] সাথে মধ্যম দশক ইতিকাফ করেছি, যখন বিশ রমযানের সকাল হল আমরা আমাদের বিছানা-পত্র স্থানান্তর করলাম, অতঃপর রাসূল [সা.] আমাদের নিকট আসলেন, তিনি বললেন: যে ইতিকাফ করছিল সে যেন তার ইতিকাফে ফিরে যায়, কারণ আমি আজ রাতে (লাইলাতুল কদর) দেখেছি, আমি দেখেছি আমি পানি ও মাটিতে সেজদা করছি। যখন তিনি তার ইতিকাফে ফিরে যান, বলেন: আসমান অশান্ত হল, ফলে আমাদের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হল। সে সত্তার কসম, যে তাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছে, সেদিন শেষে আসমান অশান্ত হয়েছিল, তখন মসজিদ ছিল চালাঘর ও মাচার তৈরি, আমি তার নাক ও নাকের ডগায় পানি ও মাটির আলামত দেখেছি”। অপর বর্ণনায় আছে, আবু সায়িদ খুদরি [রা.]‎ বলেন: “রাসূলুলাহ [সা.] রমযানের মধ্যমদশক ইতিকাফ করতেন, যখন তিনি প্রস্থানরত বিশের রাতে সন্ধ্যা করে একুশের রাতে পদার্পণ করতেন, নিজ ঘরে ফিরে যেতেন। যে তার সাথে ইতিকাফ করত সেও ফিরে যেত। তিনি কোন এক রমযান মাসে যে রাতে সাধারণত ইতিকাফ থেকে ফিরে যেতেন সে রাতে ফিরে না গিয়ে কিয়াম (অবস্থান) করলেন, অতঃপর খুতবা প্রদান করলেন, আল্লাহ্্র যা ইচ্ছা ছিল তাই তিনি লোকদের নির্দেশ করলেন। অতঃপর বললেন: “আমি এ দশক ইতিকাফ করতাম, অতঃপর আমার নিকট স্পষ্ট হল যে আমি ইতিকাফ করব এ শেষ দশক, অতএব যে আমার সাথে ইতিকাফ করেছে, সে যেন তার ইতিকাফে বহাল থাকে। আমাকে এ রাত দেখানো হয়েছিল, অতঃপর তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে, তোমরা তা তালাশ কর শেষ দশকে। আর তা তালাশ কর প্রত্যেক বেজোড় রাতে। আমি দেখেছি, আমি পানি ও মাটিতে সেজদা করছি”। সে রাতে আসমান গর্জন করে বৃষ্টি বর্ষণ করল। একুশের রাতে নবী [সা.]এর সালাতের জায়গায় মসজিদ ফোটা ফোটা বৃষ্টির পানি ফেলল। আমার দু’চোখ রাসূলকে [সা.] দেখেছে, আমি তার দিকে দৃষ্টি দিলাম, তিনি সকালের সালাত থেকে ফিরলেন, তখন তার চেহারা মাটি ও পানি ভর্তি ছিল”।
শিক্ষা ও মাসায়েল:
এক. ইলম অন্বেষণের জন্য সফর করা এবং উপর্যুক্ত স্থান ও সময়ে আলেমদের জিজ্ঞাসা করা। দুই. শিকদের কর্তব্য ছাত্রদের সুযোগ দেয়া, যেন তারা সুন্দরভাবে প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে। তিন. নামাজির চেহারায় সেজদার সময় যে ধুলা-মাটি লাগে তা দূর করা উচিত নয়, তবে তা যদি কষ্টের কারণ হয়, সালাতের একাগ্রতা নষ্ট করে, তাহলে মুছতে সমস্যা নেই। মাটিতে সেজদা দেয়া ও সালাত আদায় করা বৈধ। চার. নবী [সা.] মানুষ, তিনি মানুষের ন্যায় ভুলে যান, তবে খোদাতায়ালা তাকে যা পৌঁছানোর নির্দেশ দিয়েছেন তা ব্যতীত, কারণ সে েেত্র আল্লাহ তাকে ভুল থেকে হিফাজত করেন। নবীদের স্বপ্ন সত্য, তারা যেভাবে দেখেন সেভাবে তা ঘটে। পাঁচ. নবীর [সা.] লাইলাতুল কদর দেখার অর্থ তিনি তা জেনেছেন, অথবা তার আলামত দেখেছেন। আবু সায়িদ [রা.] থেকে ইমাম বুখারি বর্ণনা করেন: জিবরিল তাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, লাইলাতুল কদর শেষ দশকে। ছয়. আলেম যদি কোন বিষয় জানার পর ভুলে যায়, তাহলে সাথীদের বলে দেয়া ও তা স্বীকার করা।
সাত. এ হাদিস প্রমাণ করে যে, রমযানে ইতিকাফ করা মোস্তাহাব। তবে প্রথম দশক থেকে মধ্যম দশক উত্তম, আবার মধ্যম দশক থেকে শেষ দশক উত্তম। আট. জনসাধারণের উদ্দেশে ইমামের খুতবা দেয়া ও তাদের জরুরী বিষয় বর্ণনা করা বৈধ।
নয়. এ হাদিস প্রমাণ করে যে, নবী [সা.] উম্মতকে তাদের কল্যাণের বস্তু জানানোর জন্য উদগ্রীব ছিলেন। লাইলাতুল কদর তালাশে তিনি ও তার সাহাবিগণ সচেষ্ট থাকতেন। দশ. রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করার ফযিলত, বরং সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ, যেহেতু নবী [সা.] কখনো তা ত্যাগ করেননি। এগারো. লাইলাতুল কদর শেষ দশকে, বিশেষ করে বেজোড় রাতগুলোতে, আরো বিশেষ একুশের রাত। বারো. সেজদায় কপাল ও নাক স্থির রাখা ওয়াজিব, যেরূপ নবী [সা.] রেখেছেন। তেরো. এ হাদিস প্রমাণ করে যে, নবীর [সা.] যুগে মুসলিমগণ দুনিয়ার সামান্য বস্তু ও সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তাদের মসজিদ ছিল খেজুর পাতার, যখন বৃষ্টি হত, সালাতে থাকাবস্থায় তাদের ওপর বৃষ্টির পানি ঝরে পড়ত। চৌদ্দ. একুশে রমযানের ফযিলত, এটা সম্ভাব্য লাইলাতুল কদরের রাত, অতএব এ রাতে অবহেলা করা মুসলিমদের উচিত নয়।