মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট সংকট করোনা পরীক্ষায় বড় চ্যালেঞ্জ

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ হবিগঞ্জ জেলায় মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের পদ চারটি। এরমধ্যে একজন ঢাকায় উচ্চশিক্ষার জন্য আছেন, জেলা সদর হাসপাতালের একজন কোভিড পজিটিভ, আরেকজন হোম কোয়ারেন্টিনে। বাকি একজন গৌতম এন্ডো। তিনি হবিগঞ্জ পৌরসভা, হবিগঞ্জ সদর উপজেলা এবং শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলা থেকে করোনা নমুনা সংগ্রহের কাজ করে যাচ্ছেন একাই। শুধু হবিগঞ্জ না, দেশের বিভিন্ন জেলারও একই চিত্র। লম্বা সময় ধরে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নিয়োগ না হওয়ায় করোনা সংকটে সঠিকভাবে নমুনা পরীক্ষা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঠিকভাবে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা নিশ্চিতে আরও অনেক বেশি টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন, সঙ্গে চাই উপযুক্ত প্রশিক্ষণ।
নমুনা সংগ্রহে জটিলতা ও নিজের কাজের ঝুঁকি বিষয়ে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট গৌতম এন্ডো বলেন, ‘সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন চিকিৎসক এবং আরেকজন স্বাস্থ্যকর্মী ইতোমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এরা আমার অফিসের, আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। আমার কালেকশন করা অনেক রিপোর্ট পজিটিভ। নিয়ম অনুযায়ী এখন আমার হোম কোয়ারেন্টিনে যাওয়ার কথা, কিন্তু সেটা করা যাচ্ছে না। কারণ, আমি যদি কোয়ারেন্টিনে চলে যাই, তাহলে নমুনা সংগ্রহ বন্ধ হয়ে যাবে’। ‘বৃদ্ধ মা আর ছোট দুই শিশু সন্তানের সঙ্গে একই বাসায় থাকা যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ আমার জন্য, সেটা অন্তত সবাই বোঝেন এখন, কিন্তু কিছু করার নেই’, যোগ করেন গৌতম। মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টদের স্বল্পতা থাকায় ইপিআই কার্যক্রমে যুক্ত হেলথ টেকনোলজিস্টদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। তবে তাদের কাজ মানসম্মত না জানিয়ে গৌতম বলেন, হবিগঞ্জ জেলার অন্যান্য উপজেলায় ইপিআই কার্যক্রমের হেলথ টেকনোলজিস্টদের দিয়ে (শিশুদের টিকা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত) নমুনা সংগ্রহ করানো হচ্ছে। অথচ তারা কাজ করছেন মাত্র একদিনের প্রশিক্ষণে, তাই সঠিক স্যাম্পল তাদের পক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড-১৯ পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহ করা সঠিক ফলাফলের জন্য অত্যন্ত জরুরি। ঠিকমতো নমুনা সংগ্রহ করা না হলে তার ফলাফল ঠিক আসবে না। আর ফলাফল সঠিক না হলে একজন কোভিড-১৯ পজিটিভের যদি নেগেটিভ ফল আসে, সেটা হবে ভয়াবহ বিষয়। কারণ, তিনি তখন নেগেটিভ ভেবে, যখন অন্য কারও সংস্পর্শে আসবেন, তখন তার থেকে অন্যরা সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বেন। তারা বলছেন, পিসিআর টেস্টে (যে পরীক্ষায় কোভিড-১৯ নির্ণয় হয়) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রথম ধাপ হচ্ছে নমুনা সংগ্রহ। অথচ গত ১০ থেকে ১২ বছরের মতো টেকনোলজিস্ট নিয়োগ হচ্ছে না, তাই সংকট রয়েছে তাদের। যত জায়গায় যত ঝামেলা, তার সবই হচ্ছে নমুনা সংগ্রহ নিয়ে। নমুনা ঠিকমতো আসছে না বলেই ভাইরাস থাকছে না, যার কারণে ফলস পজিটিভ বা ফলস নেগেটিভ আসছে। এটি একটি বিশেষায়িত বিষয়। তাই প্রথমত অনেক বেশি টেকনোলজিস্ট এবং দ্বিতীয়ত প্রশিক্ষিত টেকনোলজিস্ট দরকার।
প্রয়োজনীয় সংখ্যক টেকনোলজিস্ট নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি। এ কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সঠিকভাবে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার জন্য আরও অনেক বেশি টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দিতে হবে। তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণও নিশ্চিত করতে হবে।’ দেশে প্রায় ১৫ হাজারের মতো বেকার ল্যাব টেকনোলজিস্ট রয়েছেন, এই জরুরি সময়ে তাদের কাজে লাগানোর কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একজন চিকিৎসকের বিপরীতে পাঁচ জন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট থাকতে হবে। সে হিসাবে দেশে এখন প্রয়োজন এক লাখের বেশি টেকনোলজিস্ট। কিন্তু বাংলাদেশ মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে টেকনোলজিস্টের পদ রয়েছে মাত্র সাত হাজার ৯২০টি, কর্মরত আছেন পাঁচ হাজার ১৬৫ জন। এরমধ্যে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট (ল্যাবরেটরি) পদ দুই হাজার ১৮২টি। আর কাজ করছেন এক হাজার ৪১৭ জন। কোভিড-১৯-এর হটস্পস্ট নারায়ণগঞ্জের ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল ও ১০০ শয্যাবিশিষ্ট ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে টেকনোলজিস্ট রয়েছেন মাত্র আট জন। এরমধ্যে তিন জন করোনা আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন। পাঁচ জন দিয়ে চলছে নমুনা সংগ্রহের কাজ। জরুরি ভিত্তিতে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টদের শূন্যপদ পূরণ করতে হবে জানিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মুজাহেরুল হক বলেন, একইসঙ্গে নতুন আরও অন্তত পাঁচ হাজার টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।
নেগেটিভ-পজিটিভ-নেগেটিভ
গত ২৬ এপ্রিল দ্য সিটি ব্যাংক কর্মকর্তা মুজতবা শাহরিয়ার মারা যান কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে। জানা যায়, লক্ষণ প্রকাশের পর তিনি দুইবার টেস্ট করালেও ফল ছিল নেগেটিভ। কিন্তু অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তিনি মারা যান। মৃত্যুর পর তৃতীয় ফলাফলে জানা যায় তিনি কোভিড-পজিটিভ ছিলেন। গত ১৩ এপ্রিল একজন চিকিৎসক কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়ে ভর্তি হন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। ২১ এপ্রিল তার আবার পরীক্ষা হলে তাকে ২৩ এপ্রিল নেগেটিভ বলে জানানো হয়। দ্বিতীয়বার ২৫ এপ্রিল তার আবার নমুনা নেওয়া হয়। ২৮ এপ্রিল তাকে জানানো হয় তিনি আবার পজিটিভ। এর কারণ জানতে চাইলে বলা হয়, আগে হয়তো ফলস নেগেটিভ রিপোর্ট এসেছিল। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেন, গত ২৬ এপ্রিল তিনি তার অসুস্থতার কথা রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে (আইইডিসিআর) জানান। পরে তারা ২৯ এপ্রিল নমুনা সংগ্রহ করে। এই কর্মকর্তা বলেন, যে মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট নমুনা সংগ্রহ করতে এসেছিল, ওইদিনই সে প্রথম নমুনা সংগ্রহ করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আমি জানি নমুনা সংগ্রহের জন্য নমুনা কাঠি (সোয়াব স্টিক) এমনভাবে দিতে হয় যতক্ষণ ভেতরে বাধা না পায়। কিন্তু নাকের ভেতরে সে আধা ইঞ্চি বা সর্বোচ্চ এক ইঞ্চির মতো নমুনা কাঠি প্রবেশ করিয়েছিলেন, যেটা সঠিকভাবে নমুনা নিতে পেরেছে বলে আমার অন্তত মনে হয়নি। এদিকে ৭ মে রাতে জ্বর-শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা যান সাংবাদিক আসলাম রহমান। তিনি বেশ কিছু দিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। তার করোনা টেস্ট করা হলেও তাতে নেগেটিভ ফল আসে।
বছরের পর বছর ধরে টেকনোলজিস্ট নিয়োগ না থাকার কারণে সংকট তৈরি হয়েছে, রয়েছে প্রশিক্ষণের অভাব। চিকিৎসক-নার্স যদি জরুরি ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া যায়, তাহলে কয়েক হাজার টেকনোলজিস্টও যেন নিয়োগ দেওয়া হয় এমন দাবি জানিয়েছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান। তিনি বলেন, টেকনোলজিস্টরা এ প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই জরুরি ভিত্তিতে টেকনোলজিস্ট নিয়োগ এবং তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব সেলিম মোল্লা বলেন, সরকার দেশের প্রয়োজনে দুই হাজার চিকিৎসক আর সাড়ে পাঁচ হাজার নার্স নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু টেকনোলজিস্টদের নিয়োগ উপেক্ষিত হওয়া খুবই দুঃখজনক। অবিলম্বে বেকার থাকা ১৫ হাজার টেকনোলজিস্টকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেন। টেকনোলজিস্টদের সংকট বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অফিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, এখন টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দিতে চাইলে বিজ্ঞপ্তি, আবেদন, যাচাই-বাছাই করে পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয় হবে। চাইলেই দ্রুততম সময়ে এ কাজ সম্পন্ন করা যাবে না। তবে টেকনোলজিস্টদের কাজে লাগানো বা নিয়োগের বিষয়ে বিকল্প চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানান তিনি।