দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় পতনের আশঙ্কা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ নভেল করোনাভাইরাসের দাপটে বর্তমান বিশ্ব টালমাটাল পরিস্থিতিতে রয়েছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেমেছে রেকর্ড শ্লথতা। এ পরিস্থিতি বিভিন্ন দেশে কয়লার চাহিদা কমিয়ে দিতে পারে। ফলে কমে যেতে পারে জ্বালানি পণ্যটির বৈশ্বিক চাহিদা। এমনকি ২০২০ সালে কয়লার বার্ষিক বৈশ্বিক চাহিদায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সবচেয়ে বড় পতন দেখা দিতে পারে বলে মনে করছে ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ)। খবর ব্লুমবার্গ ও মন্টেল নিউজ।
আইইএর সাম্প্রতিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছর কয়লার বৈশ্বিক চাহিদা আগের বছরের তুলনায় ৮ শতাংশ কমে যেতে পারে। একই কথা জানিয়েছে হংকংভিত্তিক জ্বালানিবিষয়ক প্রতিষ্ঠান নবেল রিসোর্সেস। প্রতিষ্ঠানটির পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২০ সালে কয়লার (সিবোর্ন থার্মাল কোল) বৈশ্বিক আমদানি চাহিদা দাঁড়াতে পারে ৯২ কোটি ৭০ লাখ টনে, আগের বছরের তুলনায় যা ৭ শতাংশ কম।
তবে নভেল করোনাভাইরাসের সঙ্গে আরেকটি বিষয় পণ্যটির আমদানি কমিয়ে আনার পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করতে পারে। তা হলো কয়লার পরিবর্তে বিশ্ববাসীর প্রাকৃতিক গ্যাস ও নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি। মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে পণ্যটির ব্যবহার হ্রাস এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখতে পারে। আইইএর তথ্য অনুযায়ী, এ বছর বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে জ্বালানিটির ব্যবহার ১০ শতাংশ কমে যেতে পারে।
এরই মধ্যে চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে (জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) কয়লার আন্তর্জাতিক আমদানি ও রফতানিতে নিম্নমুখী প্রবণতা পড়তে দেখা গেছে। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে অনেক দেশে লকডাউন চলছে। এতে আন্তর্জাতিক পরিবহন ও বাণিজ্য ব্যবস্থা ব্যাহত হচ্ছে। অন্যান্য পণ্যের মতো আন্তর্জাতিক কয়লা বাণিজ্যেও এর প্রভাব পড়েছে।
এছাড়া চলতি বছর কয়েকটি দেশে কয়লার অভ্যন্তরীণ সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা পণ্যটির আমদানি চাহিদা হ্রাসের পেছনে অন্যতম ভূমিকা রাখতে পারে। নবেল রিসোর্সেসের প্রধান গবেষক রুদ্রিগো একেভেরি বলেন, বিশ্বের শীর্ষ কয়লা আমদানিকারক দেশ চীন। চলতি বছর অভ্যন্তরীণ উত্তোলন ও সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশটি জ্বালানি পণ্যটির আমদানি কমিয়ে দিতে পারে। একই অবস্থা ঘটতে পারে তৃতীয় শীর্ষ কয়লা আমদানিকারক দেশ ভারতের ক্ষেত্রেও। বেশ কয়েক বছর ধরে কয়লায় আমদানি নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ভারত।
আইইএর তথ্য অনুযায়ী, কভিড-১৯ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় বর্তমানে লকডাউন শিথিল রয়েছে চীনে। শিল্প খাতগুলো এরই মধ্যে কার্যক্রমে ফিরেছে। এর পরও চলতি বছর দেশটিতে কয়লার চাহিদা ৫ শতাংশ কমে আসতে পারে।
এছাড়া কভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের আগে থেকেই পরিবেশ ইস্যুতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কয়লার পরিবর্তে কম কার্বন নির্গমনকারী জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার বাড়াচ্ছিল। চলতি বছর পণ্যটি ব্যবহারের প্রবণতা আরো বাড়তে পারে। নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপে জ্বালানি তেলের সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক গ্যাসের দামও রেকর্ড কমে গেছে। এছাড়া গত কয়েক মাস চাহিদায় নিম্নমুখী প্রবণতা ও যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যটির রেকর্ড উত্তোলন বৃদ্ধি বাজারে পণ্যটির উদ্বৃত্ত সরবরাহ বাড়িয়ে তুলেছে। এ পরিস্থিতিতে ২০২০ সালে কয়লার পরিবর্তে প্রাকৃতিক গ্যাসের বৈশ্বিক ব্যবহার বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। বিশেষত ইউরোপের দেশগুলোতে পণ্যটির ব্যবহার রেকর্ড বাড়তে পারে।
আইইএর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ইউরোপে কয়লার চাহিদা ২০১৯ সালের তুলনায় ২০ শতাংশ কমে যেতে পারে। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যটির চাহিদা কমে যেতে পারে ২৫ শতাংশ। এছাড়া গত দুই সপ্তাহের মধ্যে অস্ট্রিয়া ও সুইডেন ঘোষণা দিয়েছে, দেশ দুটি তাদের সর্বশেষ কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। এর আগেই আলবেনিয়া, বেলজিয়াম, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও নরওয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে।
এদিকে ২০ দিন ধরে কয়লা ব্যবহার না করে এ খাতে নতুন রেকর্ড করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি ২০২৫ সালের মধ্যে পণ্যটির ব্যবহার বন্ধ করে দেয়ার লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে যাচ্ছে। একই পথে হাঁটছে জার্মানিও। ২০৩৮ সালের মধ্যে কয়লা ব্যবহার কমিয়ে শূন্যে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে জার্মানির।
আইইএর নির্বাহী পরিচালক ফাতিহ বিরল এ বিষয়ে বলেন, জ্বালানি পণ্যের বর্তমান বাজার পরিস্থিতি একটি ঐতিহাসিক আঘাতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানের বৈশ্বিক আর্থিক ও স্বাস্থ্য খাতের এমন সংকটসময় মুহূর্তে প্রায় সব ধরনের জ্বালানি পণ্যের চাহিদা অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। বিশেষ করে কয়লা, জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদায় রেকর্ড পতন দেখা দিয়েছে।
নবেল রিসোর্সেসের তথ্য অনুযায়ী, উত্তর ইউরোপ, ভূমধ্যসাগরীয় দেশ ও আমেরিকার দেশগুলোতে চলতি বছর কয়লার সম্মিলিত চাহিদা কমে ১৪ কোটি ৮০ লাখ টনে নামতে পারে, আগের বছরের তুলনায় যা ১৩ শতাংশ কম। এছাড়া মধ্য ইউরোপ ও দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোতে পণ্যটির ব্যবহার কমে যথাক্রমে ২ কোটি ৭০ লাখ টন ও ৯০ লাখ টনে নামতে পারে। আগের বছরের তুলনায় যা যথাক্রমে ১ কোটি ৩০ লাখ টন ও ৮০ লাখ টন কম।
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চলতি বছর কয়লার চাহিদা ৬ শতাংশ কমে ৭৭ কোটি ৯০ লাখ টনে নামতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ায় পণ্যটির চাহিদায় ব্যাপক পতন এক্ষেত্রে মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ কয়লা ব্যবহারকারী দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় ২০২০ সালে পণ্যটির চাহিদা আগের বছরের তুলনায় ১ কোটি ১০ লাখ টন কমে ১০ কোটি ১০ লাখ টনে নামতে পারে। এছাড়া চীনে এ বছর ৭০ লাখ টন কমে কয়লার চাহিদা দাঁড়াতে পারে ২১ কোটি টনে।