মহামারীতে বৈশ্বিক সরবরাহ ৬.৩% কমতে পারে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাজারে নভেল করোনাভাইরাসের তাণ্ডব কেবল চলতি বছর বা আগামী বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। জ্বালানি পণ্যটির বৈশ্বিক বাণিজ্যে ভাইরাসটির প্রভাবের স্থায়িত্ব পেতে পারে দীর্ঘমেয়াদে। নরওয়েভিত্তিক জ্বালানি তেলের বাজার বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান রাইস্টাড এনার্জি সম্প্রতি এ আশঙ্কার কথা জানিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক সরবরাহ প্রত্যাশার তুলনায় ৬ শতাংশের বেশি কমে যেতে পারে। খবর রয়টার্স ও অয়েলপ্রাইসডটকম।
নভেল করোনাভাইরাস সংকটের জের ধরে সম্প্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে অবস্থান করছে। তবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় জ্বালানি কোম্পানিগুলো তাত্ক্ষণিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছে না। সংকট মোকাবেলায় শিল্প খাতটিতে বিনিয়োগে যথেষ্ট বিলম্ব করছে কোম্পানিগুলো। ফলে দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি পণ্যটির বৈশ্বিক সরবরাহ কমে আসতে পারে বলে ধারণা করছে রাইস্টাড এনার্জি।
প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের কোম্পানিগুলো খাতটিতে বিনিয়োগের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে, অনেকে চলমান প্রকল্প থেকে বের হয়ে যাচ্ছে অথবা প্রকল্প চালু করতে দেরি করছে। মূলত নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপের জের ধরে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাজারে আগের সব হিসাব পাল্টে গেছে। ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধে বিশ্বের প্রায় সব দেশ লড়াই করছে। চলছে লকডাউন। গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে বিশ্বের অর্ধেক মানুষ। ফলে পরিবহন ও শিল্প খাতগুলো একেবারে অচলাবস্থায় চলে গেছে। এ পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদা এরই মধ্যে দৈনিক গড়ে তিন কোটি ব্যারেল কমেছে।
এদিকে অপ্রত্যাশিতভাবে চাহিদার দ্রুত পতনে আন্তর্জাতিক বাজার উদ্বৃত্ত জ্বালানি তেলে সয়লাব হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ দেশে দেশে পণ্যটির সংরক্ষণাগারগুলো পূর্ণ হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম কমে ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম কমে শূন্য ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে এমনটা আর ঘটেনি। ফলে খাতটিতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নানা ধরনের জটিলতায় পড়েছে জ্বালানি কোম্পানিগুলো।
এদিকে প্রবাহে আসতে সময় লাগে এমন প্রকল্পের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্বের কারণে আগামী বছরগুলোতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বৈশ্বিক সরবরাহ কমে আসার আশঙ্কা জোরালো হয়েছে। রাইস্টাড এনার্জির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে জ্বালানি পণ্য দুটির বৈশ্বিক সরবরাহ প্রত্যাশার তুলনায় ৫ দশমিক ৬ শতাংশ কমে যেতে পারে। এর অধিকাংশ আসতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের শেল অয়েল (পাথুরে ভূমি থেকে উত্তোলিত জ্বালানি তেল) খাত থেকে।
বিশ্বের অন্যতম বড় জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী কোম্পানি কন্টিনেন্টাল রিসোর্সেস যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটায় তাদের বেশির ভাগ উত্তোলন কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। কোম্পানিটির সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি তেলের বাজারে যে মাইনাস প্রাইসিং চলছে, এ অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি জ্বালানি তেল সরবরাহ করবে না বলে এরই মধ্যে কিছু গ্রাহককে অবহিত করেছে তারা।
সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে রাইস্টাড এনার্জি ধারণা করেছে, রেকর্ড দরপতনের আগে ২০৩০ সাল নাগাদ আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের যে পরিমাণ সরবরাহ হওয়ার কথা ছিল, তার তুলনায় ৬ দশমিক ৩ শতাংশ কমে যেতে পারে।
এছাড়া একই কারণে ১৯ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের নন শেল প্রকল্পগুলোও বিলম্বিত হচ্ছে বলে অনুমান করছে প্রতিষ্ঠানটি, যার অধিকাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস ও গ্যাস কনডেনসেট ফিল্ড উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত। ভৌগোলিকভাবে এ গ্রুপের সবচেয়ে বড় মন্দায় পড়তে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য।
একই পরিস্থিতি বজায় রয়েছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজির ক্ষেত্রেও। জ্বালানি পণ্যটির প্রকল্পগুলো দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নভেল করোনাভাইরাসের আগে ধারণা করা হচ্ছিল, বিদায়ী বছরের পর ২০২০ সালেও এলএনজি খাতে বিনিয়োগ আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পণ্যটির বৈশ্বিক চাহিদার রেকর্ড পতন ঘটেছে, যা পণ্যটির দামে বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। এতে খাতসংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো বিনিয়োগ কমিয়ে আনছে। রাইস্টাডের এনার্জি বিশ্লেষকরা জানিয়েছে, নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপে পড়ে কমপক্ষে সাতটি এলএনজি প্লান্টের প্রকল্পের চূড়ান্ত বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত বিলম্বিত হচ্ছে।
এমনকি আয়ের দিক থেকে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ অয়েল ইন্ডাস্ট্রি কোম্পানি রয়্যাল ডাচ শেল যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত অন্যতম বৃহৎ এলএনজি আমদানি টার্মিনাল লেক চার্লেস এলএনজি প্রকল্প থেকে সম্পূর্ণ প্রস্থানের চেষ্টা করছে।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের শুরু থেকেই এলএনজি খাতে বৈশ্বিক বিনিয়োগ ছিল সব সময়ের সর্বোচ্চে। গত বছরের অক্টোবরের মধ্যেই খাতটিতে বৈশ্বিক বিনিয়োগের পরিমাণ প্রথমবারের মতো ৫ হাজার কোটি ডলার (বিনিয়োগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে) ছাড়িয়ে যায়। এছাড়া ২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে ১৭ হাজার কোটি ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস তরলীকরণে বিনিয়োগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, যা এর আগের সর্বোচ্চ তরলীকরণের চেয়ে ঢের বেশি ছিল। এর আগে ২০০৫ সালে সাত হাজার কোটি ঘনমিটার প্রাকৃতিক গ্যাস তরলীকরণের প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল।