অন্য রোগ যেন অভিশাপ , করোনার পরীক্ষা ছাড়া হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ নেই

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ১৩ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন রাজধানীর ওয়ারীর একজন বাসিন্দা। ওইদিনই তার পরীক্ষার নমুনা নেয়া হয় কিন্তু পরীক্ষার নমুনার ফল আসে ১৭ এপ্রিল বিকাল ৩ টায়। সরকারের রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআরের) থেকে টেলিফোনে মৃত্যুবরণ করা ব্যক্তির পরিবারকে করোনায় পজিটিভের তথ্য জানানো হয়। নমুনা পরীক্ষার ফল আসতেই ৫ দিন লেগে যায়। এর মধ্যে ওই ব্যাক্তির পরিবার স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে দাফন করে ফেলেন। যিনি মৃত ব্যক্তির গোসল করিয়েছেন এবং জানাযায় উপস্থিত ছিলেন তাদেরকে চিহ্নিত করে পরীক্ষা করা হয়নি।
একইভাবে রাজধানীর বাড্ডায় গত ১৫ এপ্রিল মারা যান একজন বয়স্ক ব্যক্তি। মৃত ব্যক্তির করোনা নমুনা পরীক্ষায় পজিটিভ এসেছে। কিন্তু নমুনা পরীক্ষার ফল পরিবারটি জানতে পেরেছে মৃত্যুর তিন দিন পর। পরিবার সূত্রে জানা গেছে, তারা নমুনা পরীক্ষার ফল পাওয়ার পর সংস্পর্শে থাকাদের কারোরই করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হয়নি। পরিবারের লোকজন পরীক্ষা করাতে চাইলেও কোনভাবেই পারেননি তারা। আইইডিসিআর থেকে বলেছে হোমকোয়ারেন্টিনে থাকতে। এটা ছিল করোনা পজিটিভ রোগীদের পরীক্ষার চিত্র। অপরদিকে করোনার এই সময়ে অন্য কোনো রোগ মানুষের জন্য যেন অভিশাপ। উপসর্গ থাকা রোগীদেরই করোনা টেস্ট ও রিপোর্ট পাওয়া যখন বিলম্বিত হচ্ছে, তখন নেগেটিভ সনদ ছাড়া অনেক হাসপাতালে অন্য রোগীদের ভর্তির সুযোগ নেই। এ জন্য অবশ্যই লাগবে করোনা টেস্ট রেজাল্ট। আর এই নিয়ে অন্যান্য রোগে আক্রান্ত রোগীদের পড়তে হচ্ছে নানা বিড়ম্বনায়। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লক্ষণ না থাকলে অন্য রোগীদের করোনা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক না। সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নীতিমালা মেনে চিকিৎসা দেয়ার পরামর্শ তাদের। এছাড়া আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের তূলনামূলকভাবে সহজে শনাক্ত (কন্টাক্ট ট্রেসিং) করা সম্ভব। তাদের পরীক্ষার আওতায় আনা গেলে সংক্রমণের ঝুঁকি কমে আসবে। এ ছাড়া এসব এলাকায় কারও মধ্যে লক্ষণ-উপসর্গ দেখা দিলে তাদেরও পরীক্ষার আওতায় আনার সুযোগ তৈরি হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হচ্ছে না। তাই দ্রæত আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসাদের নমুনা পরীক্ষা করা দরকার। ক্যান্সার আক্রান্ত একজন রোগীর কেমোথেরাপির সিডিউল ছিলো গত ২ এপ্রিল। কিন্তু সময়মতো বাধ সাধলেন চিকিৎসক। সাফ কথা, করোনা নেগেটিভ সনদ ছাড়া হাসপাতালেই ভর্তির সুযোগ নেই। রোগীর ছেলে বলেন, আমার মা ক্যান্সার পেসেন্ট হওয়া স্বত্বেও তাকে কেমো দিতে পারছি না কারণ চিকিৎসক এবং হাসপাতাল চাচ্ছে করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট।
কেমোথেরাপি যখন রোগীর বাঁচা-মরার প্রশ্ন, তখন চিকিৎসকের শর্ত পূরণে ছুটতে হলো করোনা পরীক্ষার ল্যাবে। ততোদিনে অবশ্য পেরিয়ে গেছে তিন সপ্তাহ। দীর্ঘদিনের কিডনী রোগী রেজওয়ান উল্লাহর ডায়ালাইসিস দরকার হয় সপ্তাহে দুবার। কিন্তু রোগ-চিকিৎসক আলাদা হলেও শর্ত অভিন্ন। যে হাসপাতালে তার নিয়মিত ডায়ালাইসিস হয় তাদের চাওয়া করোনা নেগেটিভ সনদ দেখাতে হবে। করোনার সময়ে এমন সংকটে করোনা ছাড়া অন্য কোনো রোগও যেন অভিশাপ। চিকিৎসা চাইলে জটিলতা। আবার শর্ত পূরণের পথও বেশ কঠিন। উপসর্গ থাকা রোগীদেরই যেখানে করোনা টেস্ট করে কুলানো যাচ্ছে না, সেখানে অন্য চিকিৎসার জন্য করোনা টেস্টের দাবি খানিকটা বিলাসী ভাবনাই বটে। তাই করোনার টেস্ট নিয়ে চলছে এক ধরণের হ-য-ব-র-ল অবস্থা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে গড়ে ৮০ জনের কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের পরীক্ষা হচ্ছে। মোট জনসংখ্যার অনুপাতে যা একেবারেই কম। বেশি শনাক্ত হয়েছে বিশ্বের এমন দেশগুলোতে পরীক্ষার হার প্রতি ১০ লাখে ১০ হাজারের ওপর। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে আসছে। যদিও এখন তাও আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে।
সূত্র মতে, দেশে যে হারে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে সেই হারে পরীক্ষা করে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সনাক্ত করা হচ্ছে না। এমনকি যে ১৯টি ল্যাবে পরীক্ষা হচ্ছে, সেই ল্যাবগুলোর সর্বোচ্চ সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে পরীক্ষা এবং নমুনা সংগ্রহ পদ্ধতিতে দুর্বলতা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে বর্তমানে যে পদ্ধতি (পিসিআর) ব্যবহার করে শনাক্তকরণের পরীক্ষা করা হচ্ছে, সেটিও বেশ জটিল। এই পরীক্ষা করার মতো দক্ষ টেকনিশিয়ানেরও সংকট রয়েছে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে অনেকে নমুনা দিতে চাচ্ছেন না, পরীক্ষা কম হওয়ার এটা বড় কারণ। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিনের মতে, ক্যান্সার বা অন্যান্য অসংক্রামক রোগে যারা ভুগছেন বা আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের চিকিৎসা নিয়ে একটা সঙ্কট চলছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। খুবই সিরিয়াস, মাঝারি পর্যায়ে নাকি প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এই সময়ে এর উপর নির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে হবে কার চিকিৎসা জরুরী কারটা একটু পরে দিলেও চলবে।
শহীদ সোহরাওয়াদী মেডিকেল কলেজের ভাইরলোজি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ইতোমধ্যে সনাক্ত রোগীদের সংস্পর্শে যারা এসেছে তাদের সবাইকে পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। দ্রæত সব রোগী চিহ্নত করে তাদের আইসোলেশন (সঙ্গ নিরোধ) করতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, লক্ষণ ও উপসর্গ না থাকলে অন্য রোগীদের করোনা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক না। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে আন্তর্জাতিক নীতিমালা মেনে চিকিৎসা দেয়ার পরামর্শ তার। ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, কোন রোগীর ইতিহাস যদি করোনা আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসার কোন নজির না থাকে এবং রোগীর চিকিৎসা জরুরী হয় তাহলে চিকিৎসক অবশ্যই দেখবেন। তবে চিকিৎসকেরও অধিকার আছে রোগী না দেখার। তিনি বলেন, সব দায়িত্ব হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার। সরকারি-বেসরকারি সবক্ষেত্রেই হাসপাতাল চিকিৎসকের সুরক্ষা দিবে উল্লেখ করেন এই ভাইরোলজিষ্ট।
প্রফেসর সাইফ উল্লাহ মুন্সি বলেন, পরীক্ষা বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে। তাবে শুধু একটা পদ্ধতির ওপর নির্ভর না করে পরীক্ষার পদ্ধতি বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সেরোলজিক্যাল টেস্ট এর ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, এন্টিবডি ও এন্টিজেন পদ্ধতিতে দ্রুত সময়ে বিপুল পরীক্ষা করা সম্ভব। আমেরিকা ও কোরিয়াতেও এই ধরণের পরীক্ষা হয়েছে। আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের করোনা পরীক্ষার সংখ্যা আরও বাড়ানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা। তিনি বলেন, কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের নমুনা আরও বেশি করে পাঠাতে বলা হয়েছে। সামগ্রীক বিষয়ে অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, পরীক্ষা আরও বাড়বে, আমরা সেই চেষ্টা করছি। অধিদফতরের তত্ত¡াবধানে ইতিমধ্যে ২০টি ল্যাবে পরীক্ষা চালু হয়েছে। আরও ৮টি ল্যাব প্রস্তুত করা হচ্ছে। সবমিলিয়ে ২৮টি ল্যাব নিয়মিত করোনা পরীক্ষা করা হবে। এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে আরও ৩০টি ল্যাবের তালিকা করা হয়েছে। এগুলো ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। স্থানীয় পযায়ে আর বেশি পরীক্ষা করতে উপজেলা পযায়ে নমুনা সংগ্রহরে উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে ল্যাব পরিচালনায় দেশে বিশেষজ্ঞের ঘাটতি রয়েছে বলেও মন্তব্য করনে তিনি।
উল্লেখ্য, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে আইইডিসিআর দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা শুরু করে। শুরুতে বিদেশফেরত এবং তাঁদের সংস্পর্শে না এলে পরীক্ষা করা হয়নি। গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হন। ৩০ মার্চ থেকে পরীক্ষাকেন্দ্রের আওতা বাড়ানো শুরু হয়। বতমানে রাজধানীতে ১০টি ল্যাবে এবং অন্যান্য বিভাগের ৯টিসহ মোট ১৯টি ল্যাবে করোনা পরীক্ষা হচ্ছে। এসব ল্যাবে প্রায় ৩০টির মতো পিসিআর মেশিন রয়েছে। এই মেশিনগুলো দিনে দুই শিফট ব্যবহার করলে দৈনিক সাড়ে ৫ হাজার পরীক্ষা করা সম্ভব। কিন্তু পরিকল্পনা, নমুনা সংগ্রহ এবং ল্যাব বিশেষজ্ঞের ঘটিতের কারনে সেটি করা সম্ভব হচ্ছে না।