দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে করোনার ছোবল : একদিনে ১৪ জন সহ আক্রান্ত ২২, একজনের মৃত্যু

0

সুন্দর সাহা॥ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১০ জেলার মধ্যে যশোরসহ ৮ জেলায় ভয়ানকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে মরণব্যাধী করোনাভাইরাস। খুলনা বিভাগে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১৪ করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে খুলনা জেলায় করোনার উপসর্গ নিয়ে একজন মারা গেছেন। এ নিয়ে খুলনা বিভাগে ২২ করোনা রোগী শনাক্ত হলো।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) জেনোম সেন্টারে পঞ্চম দিনের পরীক্ষায় ৬৫টি নমুনার মধ্যে ১৩টিতে করোনার জীবাণু পাওয়া গেছে। যার মধ্যে নড়াইলের চারজন ডাক্তার ও যশোরের একজন স্বাস্থ্য কর্মীর নমুনাও রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। আর যশোরের সিভিল সার্জনও নিশ্চিত করেন যে, নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলায় নতুন করে চারজন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এদিকে, করোনার জীবাণু পাওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়ার পর গতকাল সকাল থেকে লোহাগড়া উপজেলাকে লকডাউনের আওতায় এনেছেন নড়াইল জেলা প্রশাসক। এদিকে, খুলনায় করোনার উপসর্গ নিয়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা সাসপেক্টটেড আইসোলেশন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার রাত ২টার দিকে তার মৃত্যু হয়। গতকাল বুধবার সকালে খুমেক হাসপাতালের সাসপেক্টটেড আইসোলেশন ইউনিটের ফোকাল পার্সন ডা. শৈলেন্দ্রনাথ বিশ্বাস তার মৃত্যুর তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন। খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক রাশিদা সুলতানাও খুলনায় করোনার উপসর্গ নিয়ে এক ব্যক্তির মৃত্যু তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোম সেন্টারের সহকারী পরিচালক প্রফেসর ড. ইকবাল কবীর জাহিদ জানান, মঙ্গলবার এখানে দক্ষিণ-পশ্চিমের সাত জেলার সন্দেহভাজন রোগীদের ৬৯টি নমুনা আসে। তার মধ্যে ৬৫টি নমুনা পরীক্ষার ফল নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর ১৩টিই পজেটিভ। বাকি ৫২টি ছিল নেগেটিভ। তিনি জানান, ১৩টি পজেটিভ নমুনার মধ্যে যশোর জেলার চারটি, কুষ্টিয়ার দুটি, মেহেরপুরের একটি, মাগুরার একটি এবং নড়াইলের পাঁচটি রয়েছে। নড়াইলের পাঁচটি নমুনার মধ্যে চারটিই চিকিৎসকের। এর মধ্য দিয়ে খুলনা বিভাগের প্রায় সব জেলা করোনা আক্রান্তের আওতায় এসেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নড়াইলের এই চার চিকিৎসক লোহাগড়ায় একই হাসপাতালে কর্মরত। আর যশোরের যে চার করোনা রোগী শনাক্ত হলেন, তাদের মধ্যে একজন শার্শার, একজন সদরের চুড়ামনকাটি ও বাকি ২ জন চৌগাছা অঞ্চলের বাসিন্দা। চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বলছেন, নতুন আক্রান্তদের মধ্যে তার এলাকার দুইজন রয়েছেন বলে তিনি প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছেন। যাদের একজন ৮ম শ্রেণীর ছাত্র ও অপরজন গৃহবধু (৪৮)। কুষ্টিয়ায় প্রথমবারের মতো করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত দুজন ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে। এরা দুজনই পুরুষ। কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন এইচএম আনোয়ারুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। আক্রান্তরা হলেন—কুষ্টিয়ার শহর এবং অন্যজন কুমারখালীর কয়া ইউনিয়নের। সিভিল সার্জন জানান, কুষ্টিয়া থেকে পাঠানো নমুনার মধ্যে দুই জনের রেজাল্ট পজেটিভ এসেছে বলে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনাভাইরাস পরীক্ষার ল্যাব থেকে জানানো হয়েছে। তারা এখন পর্যন্ত বাড়িতেই আছেন। তবে তাদের বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হবে নাকি হাসপাতালের আইসোলেশনে নেওয়া হবে, সেটা পরে জানানো হবে বলে জানান জেলার এই সিভিল সার্জন।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত শুক্রবার থেকে করোনা সন্দেহভাজন রোগীদের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। প্রথম চার দিনের নমুনাগুলোতে একটিও পজেটিভ রিপোর্ট আসেনি। পঞ্চম দিনে হঠাৎ করে ১৩ করোনা রোগী শনাক্ত হলেন। এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) ও জেনোম সেন্টারের পরিচালক প্রফেসর ড. মো. আনোয়ার হোসেন বুধবার সকালে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ কোন গুচ্ছ (ক্লাস্টার) থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে রিপোটর্রে ফলাফল। কালেকশনে যদি ত্রিটি না থাকে, তাহলে ফলাফল অ্যাকিউরেট হওয়ার কথা।’
তিনি জানান, মঙ্গলবার নতুন কিট দিয়ে নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এদিন সরকারের পক্ষ থেকে ৪৮০টি কিট পায় যবিপ্রবি। এর আগে শুক্রবার নমুনা পরীক্ষার শুরুতে ৪০০টি কিট সরবরাহ করা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়টিকে।
তাহলে কি প্রথম দফায় আসা কিট ত্রুটিপূর্ণ ছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে ভিসি ড. আনোয়ার বলেন, ‘না, তা বলা যাবে না। ত্রুটিপূর্ণ কোনো কিটে পজেটিভ বা নেগেটিভ- কোনো রিপোর্টই পাওয়া যায় না। তা সত্তেও সন্দেহ দূর করার জন্য আমরা প্রথম চার দিনের নমুনাগুলোর মধ্যে থেকে র‌্যান্ডমলি রিচেক করবো।’
পঞ্চম দিনের পরীক্ষার ফলাফল চূড়ান্ত হয় মঙ্গলবার দিনগত রাত তিনটার দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি জানিয়েছেন, ফলাফল হাতে পাওয়ার পর পরই তা ই- মেইল ও অন্য মাধ্যমে আইইডিসিআর এবং স্ব স্ব জেলার সিভিল সার্জনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। গতকাল বুধবার সকালে যোগাযোগ করা হলে যশোরের সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন এই জেলায় নতুন করে চারজনের করোনাভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার কথা নিশ্চিত করেন। তারা করোনা শনাক্ত রোগীরা এলাকার লোক, তাও করেন সিএস। প্রসঙ্গত, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মঙ্গলবার পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা, যশোর, খুলনা, নড়াইল এবং বাগেরহাটে একজন করে করোনা রোগীর সন্ধান মেলে। আর খুলনার এক মৃত ব্যক্তির শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া যায় মঙ্গলবারই। গতকাল যবিপ্রবি থেকে পাওয়া ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, এই অঞ্চলের নড়াইল ও যশোরে করোনাভাইরাস বেশ ছড়িয়েছে। এছাড়া কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মাগুরা এতোদিন করোনামুক্ত মনে করা হলেও এখন সেখানে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি আছেন, তা নিশ্চিত হলো। এই বিভাগের ঝিনাইদহ ও সাতক্ষীরা জেলায় এখনও কোন করোনা আক্রান্তের খবর মেলেনি।
যবিপ্রবির উপাচার্য জানিয়েছেন, সরকার এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আরএনএ আইসোলেশন কিট সরবরাহ করেনি। এখনো পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোম সেন্টারের আরএনএ আইসোলেশন কিট পরীক্ষার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। যেহেতু এখানে জেনোম সেন্টার রয়েছে, তাই রিএজেন্টও থাকে। দ্রুত আরএনএ আইসোলেশন কিট সরবরাহের দাবি জানিয়ে ভিসি প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, না হলে এখানে করোনা পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এদিকে, খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক রাশিদা সুলতানা জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় বিভাগের খুলনায় একজন, যশোরে ৪ জন, মাগুরায় একজন, নড়াইলে ৫ জন, কুষ্টিয়ায় ২ জন ও মেহেরপুরে একজন করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে খুলনায় একজন মারা গেছে। পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টায় এ বিভাগে ৫৩৩ জনকে কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দু’জন রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে। আর ৫৭০ জনকে কোয়ারেন্টিন থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, গত ১০ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত খুলনা বিভাগে মোট ২২ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নড়াইলে সর্বোচ্চ ৬ জন, খুলনায় ৫ জন (একজন মৃত), যশোরে ৫ জন, কুষ্টিয়ায় দু’জন, চুয়াডাঙ্গায় একজন, বাগেরহাটে একজন, মাগুরায় একজন ও মেহেরপুরে একজন। এছাড়া এ বিভাগে এ পর্যন্ত ২২ হাজার ৬৩৪ জনকে কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একহাজার ৫১ জনকে রাখা হয় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে। আর কোয়ারেন্টিন থেকে ১৫ হাজার ৭৭২ জনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ১৪৩ জনকে আইসোলেশনে রাখা হয়। এর মধ্যে ১১৬ জনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।