পঙ্গপাল: কতটা ঝুঁকিতে বাংলাদেশের কৃষি?

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ পঙ্গপাল নিয়ে সতর্ক বাংলাদেশ। আফ্রিকার কয়েকটি দেশের পর পাকিস্তান এবং সম্প্রতি ভারতে আক্রমণ চালানোর পর বাংলাদেশেও আক্রমণের আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে বসে নেই কৃষি মন্ত্রণালয়। পঙ্গপালের আক্রমণ এড়াতে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার থেকে সম্প্রতি ৩০টি দেশে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, ৩০ টি দেশে পঙ্গপাল ছড়িয়ে পড়তে পারে। পাশাপাশি এ সংস্থা থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশকে সতর্ক থাকতে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে পঙ্গপালের আক্রমণ সম্পর্কে সতর্কতা ও প্রস্তুতি গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। চিঠি পাওয়ার পর করণীয় ঠিক করে আগাম প্রস্তুতি নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের কৃষি উদ্ভিদ সেলের নির্দেশনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগসহ সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন পরিকল্পনাসহ কাজ করছে। পঙ্গপাল নিয়ে আক্রান্ত বিভিন্ন দেশের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এছাড়াও জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট শাখার সাথে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।
বাংলাদেশের কৃষি কতটা ঝুঁকিতে? কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, পঙ্গপাল মরু ভুমি থেকে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। বাংলাদেশে পঙ্গপাল আসলে শুষ্ক ও খরা প্রবণ এলাকাগুলোতে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। সেটি মাথায় রেখেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, পঙ্গপাল শুষ্ক আবহাওয়া পছন্দ করে। এদেশের আবহাওয়া আর্দ্র ও শুল্ক। তাই এ দেশে পঙ্গপালের আক্রমণের সম্ভাবনা কম। এরপর যদিও পঙ্গপাল আসে এ বছর নয়, আগামী বছরে বাংলাদেশে আসার সম্ভাবনা আছে। তবে বসে নেই সংশ্লিষ্টরা। পাকিস্তান ও ভারতে পঙ্গপালের আক্রমণে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি দেখে কাজ শুরু করে কৃষি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরেরে একজন কর্মকর্তা বলেন, পঙ্গপাল সম্পর্কে আমাদের কোনও ধারণা নেই। বিগত ৪৯ বছরে দেশে পঙ্গপালের কোনও আক্রমণ হয়নি। ভুট্টায় আর্মি ওয়ার্ম নামে একটি পোকা হয়েছিল। আমরা এটি নিয়ন্ত্রণ করেছি । পঙ্গপাল সম্পর্কে আমাদের প্রাকটিক্যাল কোনও ধারণা নেই। এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে প্রস্তুতি নিচ্ছি। এটি আসলে এটিকেও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। তিনি বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে পাকিস্তান ও ভারতের পর পঙ্গপালের আক্রমণ হতে পারে। আমাদের সতর্কতা এবং প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। তবে এ বছরে তেমন ঝুঁকি নাই, কিন্তু আগামী বছরের জন্য আমাদের সতর্ক হতে হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্ভিদ সেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা গেছে পঙ্গপালের আক্রমণের কোনও সম্ভাবনা নেই। পঙ্গপাল শুষ্ক আবহাওয়ার ও মরুভূমির প্রাণী। সে কারণে বাংলাদেশে পঙ্গ পালের আক্রমণের সম্ভাবনা কম। পাশাপাশি এবিষয়ে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এক বর্গকিলোমিটারে পঙ্গপাল (এক প্রকার ঘাসফড়িং দলবেঁধে চলাফেরা করে তাই পঙ্গপাল বলা হয়) দিনে যে পরিমাণ খাবার খায় তা দিয়ে ৫ হাজার মানুষ এক বছর খেতে পারবে। তারা খাবারের সাথে সাথে প্রজননের কাজটিও করে থাকে।
কৃষি সম্প্রসারণ উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংয়ের পরিচালক এ জেড এম ছাব্বির ইবনে জাহান বলেন, আমাদের আবহাওয়াও পঙ্গপালের বংশ বিস্তারের জন্য উপযোগী নয়। ফলে এই পতঙ্গ নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। তবে পশ্চিমবঙ্গে চলে এলে আমাদের চিন্তার কারণ আছে। এখনও এটি ভারতের পাঞ্জাব ও হরিয়ানা রাজ্যে আছে। তাই এ বিষেয়ে আমরা আপাতত চিন্তা করছি না । তিনি বলেন, পঙ্গপালের উপদ্রব ঠেকাতে এখন পর্যন্ত কোনও কার্যকরি পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। পঙ্গপালের হাত থেকে বাঁচার জন্য বেশিরভাগ সময় উড়োজাহাজে কিংবা বহনযোগ্য যন্ত্রের সাহায্যে কিটনাশক ছিটিয়ে এদের দমন করা হয়। তবে এতে সমস্যা হলো অন্য উপকারী কিটপতঙ্গও মারা যায়।
বিশ্লেষকরা যা বললেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. শেফালী বেগম বলেন, শরীরের হরমোনের পরিবর্তনের ফলে পঙ্গপালের আচরণে পরিবর্তন দেখা দেয় এবং তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বর্ধিত পতঙ্গের খাবারের জন্য তারা দলবেঁধে খাদ্য সংগ্রহ করতে বের হয়। পঙ্গপাল যে স্থান অতিক্রম করে সেখানকার ফসল, উদ্ভিদ এবং ঘাসজাতীয় সবুজ যা কিছু পায় তাই তারা শেষ করে ফেলে। কৃষি সচিব মো. নাসিরুজ্জামান বলেন, পঙ্গপাল শুষ্ক আবহাওয়া পছন্দ করে। এদেশের আবহাওয়া আর্দ্র ও শুল্ক। তাই এ দেশে পঙ্গপালের আক্রমণ সম্ভাবনা কম। পঙ্গপাল একদিকে খায়, অন্যদিকে বংশবিস্তার করে। আর বংশবিস্তারের জন্য বালুময় আবহাওয়া দরকার। সে আবহাওয়া এ দেশে নেই। তাই আমাদের ভয়ের কিছু নেই। আমরা প্রস্তুতি নিয়েছি, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
পঙ্গপাল কী
এরা মূলত ছোট শিংবিশিষ্ট এক প্রকার পতঙ্গ, সাধারণভাবে আমরা যাকে ঘাসফড়িং বলি। ইংরেজিতে লোকাস্ট বলে। স্বভাবে কিছুটা লাজুক প্রকৃতির। এই পতঙ্গ দৈর্ঘ্যে সাধারণত ১ ইঞ্চি হয়। ঘাসফড়িংগুলো যখন দলবেঁধে চলাফেরা করে তখন এদের পঙ্গপাল বলে। জীবনকালের কিছু সময় এরা অন্যান্য পতঙ্গের মতই আলাদা থাকে। কিন্তু কোনো এক সময় এরা দলবেঁধে খাদ্য সংগ্রহে বের হয়। পঙ্গপালের একেক ঝাঁকে কয়েক লাখ থেকে এক হাজার কোটি পতঙ্গ থাকতে পারে। পঙ্গপাল মাঠের ফসল ও গাছের ফলের ক্ষতি করে।
সাধারণত দীর্ঘদিন অনাবৃষ্টির পর যখন বৃষ্টিপাত হয় এবং দ্রুত ফসল বৃদ্ধি পায় তখনই এদের মস্তিষ্কের সেরোটনিন আচরণগত পরিবর্তন ঘটায় এবং তারা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে। পেছনের পায়ে উত্তেজনা বৃদ্ধির ফলে মস্তিষ্কে সেরোটনিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় তাদের রং পরিবর্তন হয়, খাদ্য গ্রহণের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা দলবদ্ধ হয়ে যায়। প্রথমে ছোট ছোট দল গঠিত হয় এবং এক দল আরেক দলের সাথে যুক্ত হয়। এভাবে ভিন্ন ভিন্ন দলের সমন্বয়ে বিরাট পঙ্গপাল গঠিত হয়। পঙ্গপাল তখন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করে এবং জমির ফসলে আক্রমণ করে। শুরুতে তারা বিরাট এলাকাজুড়ে বিস্তৃত থাকে, কিন্তু ধীরে ধীরে আরো বেশি সংঘবদ্ধ হয়ে তারা অল্প জায়গার মধ্যে চলে আসে। তারা সাধারণত চোখে দেখে অন্য দলের প্রতি আকর্ষিত হয়। তবে ঘ্রাণ এবং সূর্যরশ্মির মাধ্যমেও তারা অন্য দল খুঁজে নেয়। সাধারণ ঘাসফড়িং থেকে পঙ্গপালে রূপান্তরিত হওয়ার সময় এদের শরীর সবুজাভ বর্ণ থেকে কিছুটা হলুদ বর্ণ ধারণ করে এবং তার মধ্যে কালো দাগ দেখা যায়। এসময় দ্রুত শারীরিক বর্ধন ঘটে এবং তারা সাধারণ ফড়িংয়ের তুলনায় আকারে বড় হয়।
কেন বিপজ্জনক?
পঙ্গপাল যখন ফসলের ক্ষেতে আক্রমণ করে, তখন তা একজন কৃষকের জন্য রীতিমত দুঃস্বপ্নের বিষয় হয়ে ওঠে। বিরাট পঙ্গপালের সামনের দিকে থাকা কোনো পতঙ্গ যখন কোনো ফসলের উপর বসে, তখন বাকিরাও সেখানে যাত্রা বিরতি দিয়ে খাদ্য গ্রহণ শুরু করে। এভাবে তারা দীর্ঘসময় খাদ্য গ্রহণ এবং বিশ্রামে অতিবাহিত করে। এরপর তারা আবার কিছুদূর উড়ে যায় এবং সেখানকার ফসল শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করে। এভাবে বছরের পর বছর পঙ্গপাল ফসলের জমির উপর আক্রমণ অব্যাহত রাখতে পারে।