দিনে প্রায় ৪০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন করোনায় বিপাকে তালার দুগ্ধ খামারিরা

0

তালা (সাতক্ষীরা) সংবাদদাতা ॥ করোনা ভাইরাসের কারণে দুধ বিক্রি না হওয়ায় সাতক্ষীরার তালা উপজেলার দুগ্ধ খামারিরা বিপাকে পড়েছেন। এ উপজেলায় প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হলেও বিক্রি করতে না পারায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন অনেকেই। প্রতিদিন খামারের দুধ বিক্রি করে চলতো প্রায় দুই হাজার মানুষের সংসার। কিন্তু খামারের এ দুধ বাইরে নিয়ে যেতে না পারায় অর্ধেক দামে এলাকায় বিক্রি করছেন তারা। মাত্র ১০ থেকে ১৫ টাকার মধ্যে বিক্রি করতে হচ্ছে এক লিটার দুধ। অথচ বাইরে পাঠাতে পারলে এ দুধের দাম পেতো ৪৫ থেকে ৬০ টাকা। এ জন্য দুধ বিক্রি নিয়ে তেমন কর্মব্যস্ততাও নেই খামারিদের মাঝে। তবে তালা উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. সঞ্জয় বিশ্বাস বলেছেন, উপজেলায় উৎপাদিত তিন ভাগের একভাগ দুধ অবিক্রিত হচ্ছে। এসব দুধ দিয়ে ঘি, ছানা, মাখন তৈরি করে তা বাজারজাত করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে খামারিদের।
তালার জেয়ালা ঘোষপাড়া প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সভাপতি প্রশান্ত ঘোষ জানান, তাদের খামারসহ এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রতিদিন প্রায় ১৫ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হয়। উৎপাদিত দুধ সাতীরা, খুলনা ও যশোর জেলা শহরে অবস্থিত বিভিন্ন কোম্পানিসহ দোকানে বিক্রি হতো। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে কোন কোম্পানি বা দোকানি দুধ নিচ্ছেন না। একদিন নিলেও চারদিন দুধ নেওয়া বন্ধ রাখছেন। যেটা নিচ্ছেন তার টাকাও বকেয়া পড়ে থাকছে। এ জন্য স্থানীয় বাজারসহ বিভিন্ন গ্রামে দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন খামারিরা।খামারি বিপ্লব ঘোষ জানান, প্রতিদিন সকালে এবং বিকালে সাতীরার বিনেরপোতা, খুলনার ব্র্যাক আড়ং, আঠার মাইল, কাশিমনগর ও জাতপুর প্রাণসহ বিভিন্ন কারখানায় তারা খামারের দুধ বিক্রি করতেন। কিন্তু এখন তারা নিয়মিত দুধ নিচ্ছেন না। আর যা নিচ্ছেন তার টাকাও বকেয়া পড়ে থাকছে।আরেক খামারি জেয়ালা গ্রামের সুজন ঘোষ জানান, তিনি গ্রামে দুধ সংগ্রহ করেন। কিন্তু গত পাঁচদিন দুধ বিক্রি করতে পারেননি। এ জন্য সোমবার সবাইকে দুধ দেবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। করোনার প্রভাব না গেলে তিনি আর দুধ সংগ্রহ করবেন না। তালা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার উত্তরে (তালা ও ডুমুরিয়া) সীমানায় জেয়ালা গ্রাম। এ গ্রামের ঘোষপাড়ায় ১৫০টি পরিবারের প্রায় এক হাজার লোকের বসবাস। এ পাড়ায় মানুষের প্রধান কাজ কৃষি ও গাভী পালন। এখানে রয়েছে ছোট বড় ১৩৭ টি দুগ্ধ খামার। এ দুগ্ধ খামারের আয়ে চলে তাদের সংসার।
সোমবার সকালে জেয়ালা ঘোষপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, খামারে বাঁধা আছে ছোট বড় দেশি-বিদেশি গাভী। কেউ দুধ সংগ্রহ করছেন। কেউ খাবার দিচ্ছেন। কেউ ভাল পাত্রে দুধ রাখার চেষ্টা করছেন। কিভাবে কোথায় বিক্রি করা যায়, তা নিয়ে আলাপ করছেন তারা। তবে করোনা ভাইরাসের কারণে কেউ বাইরে যেতে চাচ্ছেন না। সকলে বাড়িতে আছেন। প্রশাসনের ভয়ে দু একজন বাইরে গেলেও যাচ্ছেন গোপনে। এসব দুগ্ধ খামারিদের ভাষ্যমতে, ‘দুধ তো আর নষ্ট করা যাবে না। যে ভাবে হোক কম দামে হলেও বিক্রি করতে হচ্ছে। দুধ নেওয়া কোম্পানিগুলো এখন দুধ নিচ্ছে না। দুধ নিলেও টাকা দিচ্ছে না। কিভাবে চলবে তাদের খামার, চলবে সংসার।’ খামারি বিপ্লব ঘোষ জানান, তার খামারে সাতটি গাভী রয়েছে। প্রতিদিন একটি গরুর পেছনে তার ২৫০ টাকার মতো খরচ হয়। দুধ বিক্রি করে তার খরচের টাকা উঠতো। বর্তমানে দুধ বিক্রি না হওয়ায় খরচের টাকা উঠছে না। এতে তিনি মহাবিপাকে পড়েছেন। দুধ বহনকারী চালক জুয়েল গাজী জানান, দুধ বহন করে তার সংসার চলতো। কিন্তু করোনার প্রভাবে কেউ সড়কে উঠতে দিচ্ছে না। দুধ কোম্পানিগুলো দুধ তেমন নিচ্ছে না। এজন্য তিনি বাইরে যান না। বেকার সময় কাটছে বাড়িতে।
জেয়ালা ঘোষপাড়ার দিপংকর ঘোষ জানান, তার বাড়িতে ৯ টি গরু রয়েছে। প্রতিদিন তার ২২ থেকে ২৫ কেজি দুধ উৎপাদন হচ্ছে। এ দুধ বিক্রির মধ্য দিয়ে চলতো তার সংসার। কিন্তু দুধ বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে না। এমন বক্তব্য জেয়ালা দুগ্ধ পল্লীর অনেক খামারির। তালা উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. সঞ্জয় বিশ্বাস জানান, এ উপজেলায় প্রতিদিন প্রায় ৪০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হলেও তিনভাগের একভাগ অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে। এছাড়া দুগ্ধপল্লী জেয়ালা ও পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে উৎপাদিত প্রায় ১৫ হাজার লিটার দুধের মধ্যে ৫ হাজার লিটার অবিক্রিত থেকে যাচ্ছে। এসব দুধ দিয়ে ঘি, ছানা, মাখন তৈরি করে তা বাজারজাত করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে খামারিদের। তবে প্রাণ, ডেইরি মিল্ক, আড়ং, মিল্কভিটা প্রভৃতি কোম্পানি খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করছে বলেও জানান তিনি। এছাড়া মিষ্টির দোকানগুলো দুধ নিলে এ সমস্যা অনেকটা কমে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। সাতক্ষীরা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, সাতীরা জেলা গরুর দুধে সমৃদ্ধ। জেলায় প্রতিবছর ১.৯০ লাখ মেট্রিকটন দুধ উৎপাদন হয়। যার মধ্যে এক তৃতীয়াংশ উৎপাদন হয় তালা উপজেলায়। জেলায় ছোট-বড় খামার রয়েছে ২ হাজার ৫০২টি। প্রথমদিকে খামারিদের দুধ অবিক্রিত থাকলেও বর্তমানে একটু স্বাভাবিক হয়েছে। তবে দুধের সদ্ব্যবহার করতে খামারিদের বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি ।