করোনা ও তথ্যসন্ত্রাস

0
আমিরুল আলম খান
যত রকমের সন্ত্রাস আছে, তথ্যসন্ত্রাস বোধকরি সবচেয়ে বিপজ্জনক। সাইবার যুগে তা ভয়ংকরতম। দুনিয়ার সাত শ কোটি মানুষ এখন সেই ভয়ংকরতম তথ্যসন্ত্রাসের শিকার। তার অনেকটাই প্রাতিষ্ঠানিক হলেও বেশির ভাগই আবার অপ্রাতিষ্ঠানিক। সে সন্ত্রাসের কোন উৎস খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু ভাইরাসের চেয়ে দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ছে দুনিয়া জুড়ে। মুহূর্তের মধ্যেই দুনিয়ার এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্তে।
তথ্যসন্ত্রাসের হাজার রকমফজ। যারা এসব করছে তার একটা বড় ভাগ স্রেফ মজা করার জন্যই তা করছে। কিছু লোক এতে সামিল হচ্ছে না জেনে, না বুঝে। এরা প্রত্যক্ষভাবে এর উৎপাদক নয়। তারা বাহক। অন্য কারো কাছ থেকে পেয়েই পাগলের মত ছড়াচ্ছে। এ ধরনের সেরা মাধ্যম হয়ে উঠেছে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইউটিউবের মত সাইবার মাধ্যম। কিন্তু একটা অংশ খুব হিসেব কষে তথ্যসন্ত্রাস ছড়ায়। তাদের আছে বিশাল গবেষণা প্রতিষ্ঠান। সেখানে গিজগিজ করছে পণ্ডিতের দল। মোটা মাইনের চাকুরে তারা। নাম আছে সারা দুনিয়ায়, ক্ষমতাও তাদের বিপুল। তারা ব্যবহার করে অনেক উন্নত প্রযুক্তি। আছে বিশাল তথ্যভাণ্ডার। অযুত নিযুত তথ্য তাদের ভাণ্ডারে। আছে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার হাজারও মডেল। ব্যবহার করে সুপার কম্পিউটার। ভিন্ন ভিন্ন মডেল নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন গবেষণা। পিয়ার করার জন্যও রয়েছে জটিল নেটওয়ার্ক। সবশেষে তা ব্যাপক প্রচারের জন্য দুনিয়া জুড়ে প্রচার নেটওয়ার্ক। কিন্তু ভাবখানা, এরা সব সত্যপুত্র যুধিষ্ঠির।
এরা যে সব সময় ভয় ছড়ায় তা কিন্তু নয়। ভয় এবং অভয় দুটোই তাদের দাওয়াই। প্রথমে ভয় ছড়াবে। এমন ভয় যে, মানুষ যাবে সেটিয়ে। যেন অকুল সমুদ্রে পড়েছে। তারপর হাজির হবে উদ্ধারকর্তা হিসেবে। হাজির হবে অভয় বাণী নিয়ে। যেন সাক্ষাত যীশু। সেই যে কথায় আছে, “সাপ হয়ে কাটে, ওঝা হয়ে ঝাড়ে।” ঠিক তাই।
ভাবার কারণ নেই যে, এটাশুধু আধুনিক কালের খেলা। এ খেলা সুপ্রাচীন। বলা যায়, মানুষ যখন যূথবদ্ধ জীবন ব্যবস্থার অবসান করে ক্ষমতা ভাগাভাগি করেছে তখন থেকেই এর শুরু। মানে হল, সমাজে যেদিন মাতব্বরির জন্ম হয়েছে তখন থেকেই শুরু এই সন্ত্রাসের। আমরা তাকে অন্য ভাষায় আরও ভাল করে চিনি। মাস্তানি। গায়ে যার জোর বেশি, যার আছে সাহস, সেই তো বড় মাস্তান। পেশি শক্তি আর সাহস সম্বল করেই মাস্তানির শুরু সেই প্রাচীন কালে। যাদের গা গতরে জোর কম, সাহসও কম তারা গিয়ে শক্তিমানের কাছে হাঁটু গেড়ে আনুগত্য প্রকাশ করে, বাচিয়ে রাখার মিনতি জানায়। সোজা বাংলায়, “জোর যার, মুল্লুক তার।” কিন্তু যদি শক্তি সাহসে দুজন প্রায় সমান সমান হয়ে ওঠে তখনই বিপত্তি। প্রথমে বাকযুদ্ধ, সোজা বাংলায় ঝগড়া। কথার লড়াইয়ে যদি জেতা যায় তো ভাল। না হলে ঠেলাঠেলি, হাতাহাতি, চুলোচুলি, মল্লযুদ্ধ। পরে যোগ হবে লাঠি। হাতাহাতি, চুলোচুলি, মল্লযুদ্ধ, শেষে লাঠালাঠি। তারপর অগুনতি হাতিয়ার বানিয়েছে মানুষ গত কয়েক হাজার বছরে। সেসবে ট্রাম্প, পুতিন, শি পিংদের ভান্ডার কানায় কানায় ভরা।
করোনাকালে রাজায় রাজায় বাকযুদ্ধ যেমন চলছে, তেমনি আমরাও জেনে-না জেনে, বুঝে-না বুঝে সে কাতারে সামিল হয়ে গেছি। কিন্তু সবচেয়ে বেশি তৎপর যারা তাদের চেহারা দেখে দেখে আমরা হয়রান। সেখানেও যুদ্ধটা জমজমাট। শুধু সন্ত্রাস ছড়ালেই তো হবে না! সে জন্য চাই যুতসই শব্দ, ভাষা। তাতেও জমবে না। চাই যাত্রাপালার মত গলা কাপিয়ে, গলা ছেড়ে তার উচ্চারণ। বিদেশি ভাষার মধ্যে আমার কান ইংরেজি আর হিন্দি খানিক বোঝে। তাই বাংলার বয়ানটাই দেয়া ভাল। বলতে গেলে এদিক থেকে ঢাকাইয়া বাঙালরা ঢের পিছিয়ে। ঝগড়া যদি দেখতে, এবং শুনতে চান তাহলে ওপার বাংলার চ্যানেলের বোতাম টেপাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। দেখবেন, কারো আবির্ভাব যেন সাক্ষাৎ ভীম, কেউ বা মাতঙ্গিনী। সে সব মহাবীর রুস্তম বা ঝাঁসির রাণির রণমূর্তি দেখলে আপনার আর মহাভারত কিংবা ইরাক যুদ্ধের ফুটেজ দেখার ইচ্ছে হবে না। যদি ভাবেন, ওসব দৃশ্য দেখবেন না, স্রেফ নিরীহ কালিতে লেখা পড়বেন, তাতেও শান্তি নেই। আনন্দবাজারী কাগজ কিংবা টিভি একই কারখানায়, একই ছাঁচে ঢেলে পয়দা করা। যারা স্টার জলসা ছেড়ে উঠতে চান না তারা এই করোনাকালে দিব্যি বোকাবাক্সে চোখ-কান মেলে দিয়ে গাইতে পারেন, “প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন…।” তাতে রবিরও মান রক্ষে হবে, এ যুগের মহাভারত দর্শনও হবে। সংস্কৃতি আর স্বর্গ একসঙ্গে গলাগলি করবে।
ছেলে, কিংবা মেয়ে, যুবা কিংবা বৃদ্ধ তথ্যসন্ত্রাস উগরে দিতে ওদের জুড়ি খুজে পাবেন না ভূ-ভারতে। তবে হ্যাঁ, কলকাতা আজ যা করবে, কাল ঢাকাও তা করবেই। ওদের ঢাকাইয়া ছা-বাচ্চাও এখন তিড়ংবিড়িং করছে। তা বলে ভাববেন না, জন্ম এদের কলকাতায়। সেটা এসেছে অতলান্তের ওপার থেকে। ইহুদি আঁতুড়ঘরে পয়দা হয়ে সারা দুনিয়া কাঁপাচ্ছে।
রাখ মশাই, তোমার এসব প্যাঁচাল। আমরা মরছি করোনার ভয়ে, তুমি এলে প্যাচাল পাড়তে। এজন্যই বাঙালির উন্নতি হল না, মুক্তিও ধরা দিল না। না ভাই, করোনা নিয়ে কত চেচেমেচিই তো হল। দুনিয়া ঠাই দাড়িয়ে রইল। ভয়ে ঘরের বাইরে যাচ্ছি নে। গেলেই পুলিশের লাঠি খাব। ভয়ে রাতের ঘুম হারাম। তার মধ্যে এসব প্যাঁচাল!
সে কথাটা বলতেই তো এত্ত কথা রে ভাই। ভয় তো মরার? একবার যখন জন্মে এ দুনিয়ায় পা ফেলেছেন, তখন মরণ তো হবেই। তা একটা লিস্টি দিচ্ছি ভাই, মাত্র তিন মাসের হিসেব, এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত। দেখুন তো কোন মরণ আপনার খানিক কম কষ্টের (এবং কম খরচারও)?
১। অনাহারেঃ ২,৪২০,৩৮৪, ১২। ক্যান্সারেঃ ২,০৬৭,৫৮৮, ৩। ধুমপানেঃ ১,২৫৮,৪৯৭, ৪। মদপানেঃ ৬২৯,৬৪৬, ৫। এইডস/এইচআইভিতেঃ ৪২৩,২০৫, ৬। দুর্ঘটনায়ঃ ৩৩৯,৮৩৪, ৭। আত্মহত্যাঃ ২,৬৯,৯৬২, ৮। ম্যালেরিয়ায়ঃ ২,৪৬,৯৩৫, ১০। ফ্লুতেঃ ১,২২,৩৯৮, ১১। সন্তান জন্ম দিতেঃ ৭৭,৮১৩ এবং ১২। করোনায় মৃত্যুঃ ৪৬,৪৯১ জন। (সূত্রঃ ওয়ার্ল্ডওমিটার ডট ইনফো)।
এবার বলুন, দুনিয়াজুড়ে এখনও পর্যন্ত যে মারণ রোগের অবস্থান ১২ নম্বরে তা নিয়ে এত্ত ভয় কেন? বলবেন, মরণকালে কেউ কাছে থাকবে না, মরলে কেউ জানাজা পড়বে না, কবর দিতে আপনজনও কেউ লাশের কাছে ভেড়বে না, জীবনে এর চেয়ে কষ্টের আর কী আছে? কথাটা সত্য বটে, তবে আংশিক। করোনাভাইরাস মৃতদেহে বেঁচে থাকতে পারে না, মৃতদেহ থেকে করোনাভাইরাস ছড়ায়ও না। (সূত্রঃ ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী)। কাজেই ওসব বস্তাপচা তথ্যসন্ত্রাসে কান দিয়ে জীবনটা দুর্বিসহ করার কোন কারণ আছে? তবে হ্যাঁ, সতর্ক থাকুন। ঘরে থাকুন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। সরকারের নির্দেশ মেনে চলুন। রাতে ভাল করে ঘুমান। দোয়া কালাম পড়ুন আর যতখানি সম্ভব দুঃশ্চিন্তা দূরে রাখুন।
তবে যে এত হৈ চৈ? সব প্রশ্নের জবাব পেতে আরো কিছু কাল অপেক্ষা করতে হবে।
আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
[email protected]