কেবল সুশৃঙ্খল জাতিই যুদ্ধ জেতে

0
আমিরুল আলম খান
করোনাভাইরাস যখন দুনিয়ার সাড়ে সাত শ’ কোটি মানুষের ঘুম হারাম করে দিয়েছে তখন আশার পথ দেখাচ্ছে কিউবা। দুনিয়ার ৫৯ টি দেশে কিউবান মেডিকেল ব্রিগেড সেবা দিচ্ছে। লাতিন আমেরিকা বটেই, এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ এমন কি উত্তর আমেরিকায় পর্যন্ত রখন কিউবান ডাক্তাররা দিচ্ছেন নিঃস্বার্থ সেবা। যারা গত আধা শতকের বেশি কাল ধরে আমেরিকান সান্রাজ্যবাদের হয়ে এই ছোট্ট দ্বীপের বিপ্লবী মানুষদের কবর খুঁড়েছে সেসব দেশেও এখন কিউবান চিকিৎসা ব্রিগেড কাজ করছে। কিউবার মহান বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো এমন এক বিপ্লবী, মানবদরদি জাতি নির্মাণ করে গেছেন যে জাতি মানবতার সেবায় আপন প্রাণ উৎসর্গ করেই শান্তি পায়। অজেয় কিউবান জনগণ, বিশ্ব মানবতায় তোমাদের এ অবদান বৃথা যাবে না।
চীনে ঠিক তিন মাস আগে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলে বিশ্বব্যাপী আতংক ছড়াতে শুরু করে তাবেদার মিডিয়া মুঘলরা। তাদের দেখানো পথে চলতে শুরু জরে গরিব ও অনুন্নত দেশের মিডিয়াও। সেখানে প্রধান পণ্য হয়ে ওঠে তথ্য-সন্ত্রাস। সে সন্ত্রাস এখনো সমানে চলছে। মিডিয়া হররোজ প্রচার করছে ধনিক শ্রেণীর লোকসানের কেচ্ছা। কিন্তু আড়াল করছে আসল তথ্যই, কীভাবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয় দেখিয়ে কর্পোরেট পূঁজি বিপুল সম্পদ লুণ্ঠনের ফাঁদ পেতেছে। কিন্তু সে কথা আজ থাক। আজ শুধু আলোচনা করি, মানুষের জন্য মানুষেরই তো চরম ত্যাগ স্বীকারের মহৎ কাহিনিতে ভরা মানব জাতির ইতিহাস। ভয় কোনদিন মানুষকে মানুষের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিতে পারে নি। নিজের জীবন বিপন্ন করেই চিরকাল মানুষ আর্তের পাশে দাঁড়িয়েছে, সেবা করেছে। তাহলে করোনাকালে এ আত্মপরতা এমনভাবে সমগ্র মানব জাতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলল কী করে?
এমন অনেক প্রশ্নের জবাব এখুনি পাওয়া যাবে না। এজন্য আমাদের বেশ কিছু কাল অপেক্ষা করতে হবে। আমরা জানি, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নাকের ডগায় কিউবান বিপ্লব সফল হলে তাকে ব্যর্থ করতে ১৯৬৯ সালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছিল। প্রতিবাদে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার পারমাণবিক অস্ত্র ওয়াশিংটনের দিকে তাঁক করে এই বালখিল্য সামরিক শক্তি প্রয়োগের পরিণতি কী হতে পারে তা স্মরণ করিয়ে দেয়। সাম্রাজ্যবাদ লেজ গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু থেমে থাকে নি। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নস্যাৎ করতে তারা কিউবায় জীবাণু অস্ত্র প্রয়োগ করে এবং ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটিয়ে প্রায় ছয় লক্ষ কিউবানকে হত্যা করে। গত অর্ধ শতকের বেশি কাল ধরে কিউবা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার ইউরোপীয় তাবেদারদের নিয়ে অনিঃশ্বেষ অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! এই করোনাকালে সেই কিউবার কাছ থেকেই এসেছে মানবতার এক অসাধারণ সেবার নজির। এ এক নতুন ইতিহাস। এখন ২৯ হাজার কিউবান ডাক্তার নার্স সেবাকর্মী এখন বিশ্বের ৫৯টি দেশে চিকিৎসা সেবা দিয়ে চলেছে।
আমেরিকা কিউবায় জীবাণু আক্রমণ চালিয়ে লক্ষ লক্ষ নিরীহ কিউবানকে হত্যা করলে সোভিয়েত সহযোগিতায় ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। কয়েক লক্ষ চিকিৎসক সেখানে বিশেষজ্ঞ হিসেবে জনগণের সেবার আত্মোৎসর্গীত। আজ সারা পৃথিবী কিউবান চিকিৎসা সেবা নিতে মুখিয়ে থাকে।
২০০৫ সালে কিউবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মহান নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রো এ ব্রিগেড প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৯ সালে কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে বিপ্লবের পর থেকেই সমাজতান্ত্রিক দেশটিকে শেষ করার মরিয়া চেষ্টা করে গেছে আমেরিকা; এখনো করছে। অর্থনৈতিক অবরোধসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করে রাখা হয়েছে। পশ্চিমের উন্নত ধনী দেশগুলোও সমাজতান্ত্রিক কিউবার বিরুদ্ধে সেই পদক্ষেপকেই কার্যত সমর্থন করেছে। বিপরীতে এই ভয়ংকর সংকটের মোকাবিলায় কিউবা দ্বিতীয়বার ভাবেনি। কিউবার হেলথ ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের মহাসচিব সান্তিয়োগে বাদিয়া বলেছেন, ৪৫টি দেশ থেকে করোনাভাইরাস মহামারিতে সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
কিউবার চিকিৎসক দল ইতালিতে মহামারির চিকিৎসার জন্য যাওয়ার ঘটনায় গোটা দুনিয়ায় সাড়া পড়ে যায়। কিউবা অবশ্য আগেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল অন্যতম ধনী ও শক্তিশালী দেশ ব্রিটেনের দিকেও। করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ায় যাত্রীবাহী জাহাজ এম এস ব্রেইমারকে যখন আমেরিকা, বার্বাডোস বা অন্য কোনো দেশ তাদের তটে ভিড়তে দিচ্ছিল না, তখন কিউবাই তাদের বন্দর খুলে দেয়। জাহাজটিতে এক হাজার যাত্রী ছিলেন। তাদের মধ্যে পাক্বচ কন করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। কিউবা যাত্রীদের বন্দরে নামিয়ে চিকিৎসা দেয় এবং সুস্থ হবার পর জাহাজটিকে ইংল্যান্ডের উদ্দেশে পাঠিয়ে দেয়। দেশে দেশে মহামারি বা ভয়ংকর স্বাস্থ্য সংকট, ভূমিকম্পের মতো বিপর্যয়ে কিউবার চিকিৎসকদের ভূমিকা সুবিদিত। সাম্প্রতিক সময়ে হাইতির কলেরা বা পশ্চিম আফ্রিকার ইবোলা মোকাবিলায় তাদের অনবদ্য ভূমিকার কথা সবাই জানে। এ ছাড়া ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়া, জ্যামাইকা, সুরিনাম ও গ্রেনাডাতেও চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছে তারা। কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় গড়ে উঠেছিল কিউবার স্বাস্থ্যব্যবস্থা। বিশ্বে কমিউনিস্ট ব্লক ভেঙে পড়লে তার কিছু ক্ষতি হয়। আমেরিকাসহ পশ্চিমা দুনিয়ার অবরোধেও অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছে। তার মধ্যেও কিউবা চিকিৎসক তৈরি করে গেছে; বিপ্লবী চিকিৎসক, যাঁরা শুধু নিজের কথা ভাবেন না। শুধু নিজের দেশের কথাও ভাবেন না তাঁরা। গোটা দুনিয়াটাকেই নিজের ঘর মনে করার কমিউনিস্ট মতাদর্শের তাগিদে ছুটে চলেন নানা প্রান্তে। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিউবাও। জনস হপকিনসের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ১৭০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। নিজের দেশেও করোনার বিরুদ্ধে লড়ছে কিউবা। তা সামাল দিয়েই চলছে অন্য দেশে রোগমুক্তির লড়াই। মানবতাকে রক্ষা করতে হবে যে। এটাই বৈপ্লবিক কর্তব্য—বিশ্বাস করে কখনো হার না মানা চে গুয়েভারার উত্তরসূরিরা।
বিপরীতে আমরা কী দেখছি? অভিযোগ এন্তার। গতকাল ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের একজন সত্তরোর্ধ প্রবীণ স্ট্রোক করার পর পাশেই নিউরোলজি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তৃপক্ষ সেখানে তাকে ভর্তি করে নি, কোন চিকিৎসা ও দেয় নি। ভাবা যায়! আমাদের দেশে মানুষ ন্যূনতম চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে কোন রোগী নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছে না। বেসরকারি হাসপাতালেও না। নিজেদের নিরাপত্তার কথা বলে বহু ডাক্তার রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পিপিই, গ্লাভস, মাস্ক ইত্যাদির ব্যবস্থা করে নি সরকার। এ অভিযোগ হয়ত আংশিক সত্য। কিন্তু একটি প্রশ্ন কি নাগরিকগণ করতে পারে না? এত বিত্ত বৈভবের মালিক হয়েছেন যারা, তারা কি নিজস্ব উদ্যোগেও পিপিই, গ্লাভস, মাস্ক সংগ্রহ করে চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রাখতে পারতেন না? রাজশাহীর সিনিয়র একজন নার্স ঢাকায় এসেও কাদের অবহেলায় পরীক্ষা থেকে, চিকিৎসা সেবা থেকে, সামান্য সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হলেন? এই কী চিকিৎসকের ধর্ম? এদেশে গরিব মানুষের ট্যাক্সের টাকায় কী আমরা এমন অধার্মিক ডাক্তার তৈরি করেছি? তাদের কি কোনই সামাজিক দায়িত্ব নেই?
এর মধ্যেও মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে ভুরি ভুরি। বহু ডাক্তারই এই করোনাকালে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বহু মানুষ নিজে অভুক্ত থেকে অন্যকে খাওয়াচ্ছেন। অনেক গ্রামে নিজের জমিতে উৎপন্ন সব্জী অন্যকে বিলিয়ে দিচ্ছেন। তাদের প্রতি জাতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে, চিরকাল স্মরণ করবে। আমরা যেন ভুলে না যাই, মানুষের সেবার উপরে কোন এবাদত নেই। আর কেবল সুশৃঙ্খল জাতিই যুদ্ধ জেতে। আসুন, সব বিমূঢ়তাকে জয় করে আপৎকালে মানুষের পাশে দাঁড়াই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া বিধান মেনে চলি। ব্যক্তিগত দূরত্ব মেনে চলি। সাপ্লাই চেইন অব্যাহত রাখি। মুনাফা না করি। সরকারি নির্দেশ মেনে চলি। শৃঙখলা মেনে চলি। অন্যের দুঃখে শামিল হই। আর্তের পাশে দাঁড়াই। সবাইকে সাহস জোগাই। গুজব না ছড়াই। ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংকট মোকাবেলা করি। একাত্তরে পেরেছি, আজও পারব। তাহলে জয় আমাদের সুনিশ্চিত।
আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
[email protected]