এই করোনাকালে : মানুষ মানুষের জন্য

0
আমিরুল আলম খান
যশোরে এক কিশোরী হাসপাতালে আইসোলেশনে থাকা অবস্থায় মারা গেছেন। সকালে তার কক্ষের দরজা খুলে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ঢাকায় একজন মুক্তিযোদ্ধা ১৬ ঘণ্টা ধরে এ্যাম্বুলেন্সে করে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে যখন ভর্তি হতে পেরেছেন ততক্ষণে তিনি চিকিৎসার বাইরে চলে গেছেন। ঢাকার টোলারবাগে এক ব্যাংকার তার পিতার করোনায় মৃত্যুর করুণ কাহিনি বর্ণনা করেছেন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে। কোথাও করোনায় আক্রান্ত মৃতদেহ কবর দিতে দিচ্ছে না এলাকার মানুষ। এসবই পুরনো খবর। এমন অসংখ্য খবর হররোজ আমরা মিডিয়ায় দেখছি, শুনছি। বলা যায় দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে যেন আমাদের গা সওয়া হয়ে যাচ্ছে এসব খবর।
হাসপাতালে রোগী ভর্তি না করার অভিযোগ এন্তার। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল বন্ধ। ডাক্তার- নার্স নেই। তারা কাউকে সেবা দিচ্ছেন না। সরকারি, কিংবা বেসরকারি হাসপাতাল যাই হোক, এখন রোগীশূন্য। তারা হাসপাতল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন এক অজানা আতঙ্কে। করোনা ভীষণ ছোঁয়াছে। এক রোগের চিকিৎসা নিতে এসে করোনায় আক্রান্ত হবার ভয়ে তারা হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশে করোনা রোগী প্রথম শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। তারপর পুরো তিন সপ্তাহ কেটে গেছে। এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত সরকারি হিসেবে করোনা আক্রান্ত রোগী দেশে ৫৩, মৃত পাঁচ জন। কিন্তু সন্দেহ, আরও অনেকে আছেন যারা করোনায় আক্রান্ত; কিন্তু শনাক্ত করা যায় নি।
আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল। অবস্থা দিন দিন খারাপ থেকে খারাপ হয়েছে; আরও পষ্ট করে বললে, খারাপ করা হয়েছে। অন্যান্য সব খাতের মতই স্বাস্থ্য খাত দুর্নীতিতে আকঙঠ ডুবেছে। সরকারি ব্যবস্থাপনা এতই দুর্বল যে, আগে কখনও এমন অরাজক পরিস্থিতি ছিল না। তার ওপর রয়েছে এ খাতে সীমাহীন বাণিজ্যের নানা অভিযোগ।
মূল কথায় ফিরে আসি। যশোরে এক কিশোরীকে শ্বাসকষ্টের জন্য আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল। এগারো বছরের কিশোরী। একে তো প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট; তাতে একা এক ঘরে, সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা। তাও রাতের বেলা। ভাবুন, একবার। কারো পক্ষে কী এ অবস্থা কল্পনা করা যায়! সকালে ঘর খুলে দেখা গেল, কিশোরী মারা গেছেন। দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের বক্তব্য শুধু হাস্যকরই নয়, রীতিমত ঔদ্ধত্যপূর্ণ। অগ্রহণযোগ্য। কী বলেছেন তারা? এই কিশোরী যে করোনায় মারা গেছেন তারা তা মানতে নারাজ। আগে থেকেই তার শ্বাসকষ্ট ছিল। বলা যায় ক্রনিক রোগী। হতেই পারে। প্রশ্নটা এখানেই। শ্বাসকষ্টের রোগীকে কী আইসোলেশনে রাখা হয়? না। চিকিৎসকরা তাকে করোনা আক্রান্ত বলে সন্দেহ করেছিলেন; তাই আইসোলেশনের ব্যবস্থা। কিন্তু আইসোলেশন মানে কী রোগীকে যমের কাছে রেখে পালিয়ে যাওয়া? সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা নয় কেন? একটি ১১ বছর বয়েসী মেয়েকে একটা ঘরে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখা, তাকে দেখাশোনার জন্য দেখা-যাওয়া দূরত্বে কেউ না-থাকা কোন ধরনের চিকিৎসা? হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এসব প্রশ্নের জবাব দিতেই হবে। এটা একজন কিশোরীর রোগে মৃত্যু নয়, এটা হল খুন, ক্লিনিকাল মার্ডার।
স্বীকার করি, ডাক্তার, নার্স, সহকারী সকলের জীবনই সমান গুরুত্বপূর্ণ। মানি, তাদের জীবন রক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করে নি সরকার। কিন্তু যেটুকু সুবিধা ছিল যশোরের চিকিৎসকরা তার সর্বোত্তম ব্যবহার কি করেছেন? এই ঘটনা কি তাদের সীমাহীন গাফিলতি প্রমাণ করে না?
করোনা বিশ্বব্যাপী এক অতিমারী। এর লক্ষণ শুধু জানা গেছে। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহানে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ার পর গত তিন মাসে দুনিয়ার প্রায় সব দেশে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বায়নের এ যুগে এমন মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ দ্রুত ছড়াবে সেটাই স্বাভাবিক। তখন থেকেই বিশ্ববাসীকে সতর্ক করা হচ্ছিল। সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, এ রোগের কোন নিরাময়মূলক ওষুধ এখনও মানুষ জানে না। টিকা আবিষ্কার করতে অন্তত দেড় বছর লেগে যেতে পারে। কিন্তু তার চেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে এর জিন দ্রুত বদলাচ্ছে। গত তিন মাসে করোনাভাইরাস অন্তত ৪০০ বা তারও বেশি বার এর জিন বদলে ফেলেছে। ফলে চিকিৎসা দেয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
প্রথম থেকেই মিডিয়া আতংক ছড়াতে শুরু করে। ফলে, মানুষের মনে করোনা আক্রান্ত রোগীদের প্রতি সহমর্মিতার পরিবর্তে এক ধরনের বিরূপ মনোভাব, শংকা, ভয়, আতংক ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। নিজে আক্রান্ত না হয়ে নিজেকে রক্ষায় নিজেকেই ‘ঘরবন্দি’কে করার একমাত্র নিদান ঘোষণা করা হয়েছে দুনিয়াব্যাপী। দুনীয়ার বেশিরভাগ দেশই এখন লকডাউনে বা অন্য দেশ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। এখন ঘরের মধ্যে ঘর। দেশ বিচ্ছিন্ন, রাজ্যে, প্রদেশে বিচ্চিন্ন। গ্রামে গ্রামে বিচ্ছিন্নতা, বাড়র মধ্যে বিচ্ছিন্নতা, পরিবারের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা!
সমাজের স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বাইরে নিয়ে ফেলেছে বিচ্ছিন্নতা। একা একা বাঁচার এমন নিদান পৃথিবী আগে কখনও করেছে কিনা আল্লাহ মালুম। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। যূথবদ্ধতাই তার বেঁচে থাকার মূল দর্শন। কিন্তু করোনা সেই মৌলিক সমাজ দর্শনের গোঁড়া ধরে টান দিয়েছে।
শারীরিক দূরত্ব যদি অপরিহার্য হয়েই থাকে তবু মানসিক নৈকট্য এ দুর্যোগে সবচেয়ে প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু ঘটে চলেছে ঠিক তার উলটো। মানব সমাজে এমন সমাজ কাঠামো ভাঙার কালাপাহাড়ী নীতি আগে কখনও দেখা যায় নি।
আমার বিশ্বাস, সময় এখনো নিঃশ্বেষ হয়ে যায় নি। মানবিকতার জয়গানই আমাদের মুক্তির একমাত্র পথ। তাই আসুন, আমরা যে যেখানে আছি, যার যতটুকু সাধ্য আছে তাই নিয়ে আমরা অভিন্ন শত্রুর মোকাবেলা করি। সবাই একসাথে বলি, “মানুষ মানুষের জন্য।“
নিশ্চয় আমরা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করব; কিন্তু বিপন্ন মানুষের পাশেও দাঁড়াবো। এভাবেই আমরা অতীতে সকল দুর্যোগ মোকাবেলা করেছি, জয়ী হয়েছি। এবারও পারব। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলি,
“বিপদে মোরে রক্ষা কর, এ নহে মোর প্রার্থনা/
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।/
দুঃখ তাপে, ব্যথিত চিতে নাই বা দিলে সান্ত্বনা,/
দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।।…
আমারে তুমি করিবে ত্রাণ এ নহে মোর প্রার্থনা-/
তরিতে পারি শকতি যেন রয়।।“
আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবের চেয়ারম্যান