কুড়িগ্রামে মধ্যরাতের মোবাইল কোর্ট: রায় ও সাক্ষ্যতে নাটকীয়তা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন ও ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে কল্পিত অপরাধে সাজা দেওয়ার রায় ও সাক্ষ্য নাটকীয়তায় ভরপুর। জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের মন রক্ষার্থে আয়োজিত এই নাটকে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে ভিলেন সাজাতে তার বিরুদ্ধে যে কল্পিত মাদক সেবনের অপরাধ সাজানো হয় সে ঘটনায় সাক্ষী মানা হয় এলাকার দুই ভাইকে। রায় দিতে এত তড়িঘড়ি করা হয় যে একই সাক্ষ্য ওই সহোদরের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বক্তব্যের একটি শব্দ, দাড়ি-কমাও ব্যতিক্রম নেই। এ বিষয়ে সেদিনের মোবাইল কোর্টের বিচারক রিন্টু বিকাশ চাকমার কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘হেল্প করতে পারছি না বলে অত্যন্ত দুঃখিত’।
শুক্রবার (১৩ মার্চ) দিবাগত রাতে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের বাসায় হানা দিয়ে দরজা ভেঙে তুলে নিয়ে জেলা প্রশাসনের মোবাইল কোর্ট। পরে তাকে ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকি দিয়ে কালেমা পড়তে বলেন কুড়িগ্রামের আরডিসি নাজিম উদ্দিন। পরে আবার তাকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়ে বিবস্ত্র করে নির্মম নির্যাতনের পর মোবাইল কোর্ট বসিয়ে আধা বোতল মদ ও ১০০ গ্রাম গাঁজা উদ্ধারের অভিযোগে এক বছরের সাজা ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। জরিমানা অনাদায়ে আরও ১৫ দিনের সাজা দেওয়া হয়। রাতেই তাকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মোবাইল কোর্টের বিচারক ছিলেন কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা। মোবাইল কোর্টে দু’জন সাক্ষী দেখানো হয়। তারা হচ্ছেন মো. আরিফ (৩২) ও আবু বকর ছিদ্দিক (২০)। মোবাইল কোর্টের কাগজপত্র অনুযায়ী দেখা যায় তারা দু’জন সহোদর। তাদের বাবার নাম বাচ্চু মিয়া। কুড়িগ্রাম সদরের ভোকেশনাল মোড়ের বাসিন্দা। তাদের দু’জনের সাক্ষ্য দেখানো হলেও একই বক্তব্য দু’জনের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়। সাক্ষ্যতে দু’জনই বলেছেন, ‘সময় অনুমান ১১টা ৪৫ মিনিট। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলাধীন ভোকেশনাল মোড় সংলগ্ন বড়ুয়া পাড়া স্থানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকালে আমি উপস্থিত ছিলাম। আসামি আরিফুল ইসলামকে আমি চিনি এবং মদ ও গাঁজা সেবনরত অবস্থায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোবাইল কোর্ট ও টাস্কফোর্স পরিচালনাকালে হাতেনাতে ধৃত হয়। আসামি তার কৃতকার্য ও দোষ স্বীকার করে।’
একই বক্তব্য হুবহু দু’জন সাক্ষীর হতে পারে কিনা জানতে চেয়ে ওই কথিত মোবাইল কোর্টের বিচারক রিন্টু বিকাশ চাকমাকে মোবাইলে ফোন করে পরিচয় দিতেই তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘আমি আর কী বলবো।’ একই বক্তব্য দু’জনের নামে কিভাবে হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা আসলে ভালোভাবেই জানেন। আপনাদের সঙ্গে কথা বলা এখন সম্পূর্ণ নিষেধ। কী আর বলবো। আমার সম্পর্কে আপনাদের আরিফুল বলেন, কুড়িগ্রামের লোকজন বলেন ওনাদের কাছে একটু খোঁজ খবর নিয়েন। তাই আপাতত আপনাকে এ বিষয়ে কথা বলে হেল্প করতে পারছি না বলে অত্যন্ত দুঃখিত। আমাদের তো কিছু লিমিটেশন থাকে।’ মোবাইল কোর্টকে মদ ও গাঁজা সরবরাহকারী স্থানীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ইন্সপেক্টর জাহিদুল ইসলামকে ফোন করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সামনে আমার স্যার আছেন। এখন কিছু বলতে পারবো না।’
১৪ মার্চ স্বাক্ষরিত রায়ে যা লিখেছিলেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমা : ‘অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক অপরাধটি স্বীকৃত হওয়ায় তার স্বীকারোক্তি, ঘটনাস্থলে সংঘটিত অপরাধ সংশ্লিষ্ট আলামত ও জব্দ তালিকা মাদকের ক্ষতিকর দিক ও সরকারের মাদকবিরোধী নীতি বিবেচনায় এবং তাৎক্ষণিকভাবে প্রাপ্ত তথ্য প্রমাণ ও দাখিলকৃত অভিযোগ পর্যালোচনা করলাম। ঘটনাস্থলে সংঘটিত অবস্থাগত বিষয়াদি অর্থাৎ জনতার সামনে ধৃত মাদকের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়ে জনতার প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনা করলাম। মাদকের বিরুদ্ধে সকলেই তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আদালতের সামনে সংগঠিত অপরাধ বর্ণিত দোষ স্বীকারোক্তি, প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণাদি, আলামত ও অপরাধের অবস্থাগত তথ্যাদি পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনীত অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে সত্য প্রমাণিত হওয়ায় মাদক সেবনের স্বাস্থ্য দিক সর্বাগ্রে বিবেচনায় নিয়ে তাকে মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ এর ৭(২) বিধানমতে দোষী সাব্যস্ত করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এর ১০(১) (চ) নং ধারা লঙ্ঘনের দায়ে একই আইনের ৩৬ এর উপধারা (১) এর সরণির ২৫ ক্রমিকের ২ নং কলামে বর্ণিত অপরাধের নিমিত্তে ৩ নং কলাম অনুসারে ১ এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করা হলো। অর্থদণ্ড অনাদায়ে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হলো।’ উল্লেখ্য, সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের বাড়িতে মধ্যরাতে হানা এবং তাকে তুলে নেওয়ার ঘটনায় এবার আরডিসি (সিনিয়র সহকারী কমিশনার রাজস্ব) নাজিম উদ্দিন, সহকারী কমিশনার রিন্টু বিকাশ চাকমা ও এসএম রাহাতুল ইসলামকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। রবিবার (১৫ মার্চ) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো প্রজ্ঞাপনে এ কথা জানানো হয়। সিনিয়র সহকারী সচিব কে এম আল-আমীনের স্বাক্ষর করা চিঠিতে এ তথ্য জানানো হয়।