করোনা নিয়েও উদাসীনতা

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে নানা মহলের উদাসীন কর্মকান্ডে সৃষ্টি হয়েছে হতাশার। কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে ইতালিসহ আক্রান্ত দেশগুলো থেকে বহু প্রবাসী যাত্রীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া দেশে ঢুকে ছড়িয়ে পড়া তৈরি করছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার। পাশাপাশি কড়া সমালোচনা ও যথেষ্ট সময় পাওয়ার পর কোয়ারেন্টাইনে রাখার পরিবেশ উন্নত না করাকে নিছক উদাসীনতা বলছেন নগরবাসী। সেই সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিশু-কিশোরদের পাঠানো নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে তৈরি হওয়া অসন্তোষেরও তেমন কোনো সুরাহা হচ্ছে না। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একে অপরকে দেখাচ্ছে। পরিষ্কার উদ্যোগ না দেখে অভিভাবকরা নিজেরাই সন্তানদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করেছেন। ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করার ঘোষণা দিচ্ছে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়।
জানা যায়, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই ইতালি থেকে গতকাল দেশে ফিরেছেন ২১০ জন বাংলাদেশি। ১৫২ বাংলাদেশিকে বহনকারী এমিরেটস এয়ারলাইনসের একটি বিমান গতকাল সকালে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। এর আগে ভোররাতে আরও দুটি ফ্লাইটে ৫৮ জন বাংলাদেশি ঢাকায় পৌঁছান। তাদের হজক্যাম্পে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ‘হোম কোয়ারেন্টাইনের’ শর্তে বাড়ি যেতে দেওয়া হয়। অথচ গতকাল জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, দেশের বাইরে থেকে এলে লক্ষণ-উপসর্গ না থাকলেও যদি জীবাণু থাকে, তাহলে সেটি ১৪ দিনের মধ্যে প্রকাশ পাবে। শুধু তা-ই নয়, ইতালি থেকে আসা ফ্লাইটগুলোর বিজনেস ক্লাসের যাত্রীদের কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগও আছে। অবশ্য শনিবার সকালের আগে ইতালি থেকে আসা অন্য ফ্লাইটগুলোর যাত্রীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও তেমনভাবে হয়নি। ৯ মার্চ ইতালি থেকে আসা রংপুরের এক প্রবাসী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, বিমানবন্দর থেকে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই তিনি বেরিয়ে আসেন। শুধু ফরম ফিলাপ করেই তাকে আসতে দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি নিজে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রংপুর না গিয়ে ঢাকার রামপুরার একটি বাসায় হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন। কিন্তু প্রতিদিনই তার সঙ্গে দেখা করতে বিভিন্ন জায়গা থেকে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব আসছেন। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শরীয়তপুরের এক প্রবাসী বলেছেন, ১২ দিন ধরে দেশে এলেও তাকে কেউ পর্যবেক্ষণ করেনি বা সরকারের কোনো বিভাগ থেকে তাকে কোনো পরামর্শও দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, ‘বাড়িতে আসছি, আত্মীয়স্বজন বা ভাইবোনরা তো আসবেনই। তাদের কাছে না গিয়ে বা তাদের সঙ্গে কথা না বলে তো পারি না। এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো বাধা আমি পাই নাই। আজকেই আমার গ্রামের এলাকার থানা পুলিশের একজন কর্মকর্তা আমাকে টেলিফোন করে নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করলেন। তিনি জানতে চাইলে, কত দিন হয়েছে দেশে এসেছেন? আমি বললাম, ১২ দিন হবে। তখন সেই পুলিশ কর্মকর্তা বললেন, আরও দুই-তিন দিন বাড়িতে থাইকেন। এটুকুই।’
সরকারি হিসাবেই দেখা যাচ্ছে, গত প্রায় দুই মাসে চীন-ইতালিসহ ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে সাড়ে পাঁচ লাখের মতো বাংলাদেশি দেশে এসেছেন। তাদের বেশির ভাগ কোনো পরীক্ষা ছাড়াই ঢাকায় বিমানবন্দর পার হয়ে গেছেন। গতকাল ঢাকার হজক্যাম্পে গিয়ে দেখা যায়, বিমানবন্দর থেকে আসা যাত্রীদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকজনের ঝুঁকিমুক্তির পোশাক থাকলেও অনেকেরই নেই। সেখানেই খোলা হাতে ভাত খেতেও দেখা গেল কর্মীদের অনেককে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা : করোনাভাইরাস এ দেশে সংক্রমণের পরও স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ শিক্ষকরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবিতে সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি পালন করেছেন ছাত্র-ছাত্রীরা। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা লক্ষ্য করা গেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, এ সিদ্ধান্ত নেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, স্কুল বন্ধের মতো কোনো কারণ ঘটেনি। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘দেশে স্থানীয় পর্যায়ে করোনার সংক্রমণ হয়নি। বিদেশ থেকে কোনো রোগী আসা বা তার মাধ্যমে যে সংক্রমণ তা রোধ করার চেষ্টা করছি আমরা। যারা আসবেন তাদের কোয়ারেন্টাইন করা হচ্ছে। আশা করছি তাদের মাধ্যমেও সংক্রমণ হবে না। এখন পর্যন্ত স্কুল বন্ধের কোনো কারণ ঘটেনি। প্রয়োজন হলে অবশ্যই বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ গতকাল মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধু ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক জাতীয় স্কুল হকি প্রতিযোগিতায় বক্তব্যকালে এসব কথা বলেন তিনি।
এদিকে করোনাভাইরাস থেকে রক্ষায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধে নির্দেশনা চেয়ে হাই কোর্টে রিট করেছেন আইনজীবী মো. ইউনুছ আলী আকন্দ। শিক্ষা সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সচিব, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে রিটে বিবাদী করা হয়েছে। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনতিবিলম্বে সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল ও মহাসচিব অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক ভূঁইয়া গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা অথবা গ্রীষ্মকালীন ছুটি নির্ধারিত সময়ের আগে কার্যকর করার বিষয়ে নির্দেশনা প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাময়িকভাবে বন্ধ চেয়ে উপাচার্যকে স্মারকলিপি দিয়েছে ঢাবি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। ডাকসুর স্মারকলিপিতে পাঁচটি দাবি তুলে ধরা হয়েছে। তবে উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘সোমবার (আজ) সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অনুষদের ডিন, সব হলের প্রভোস্ট এবং সব বিভাগের চেয়ারম্যানদের নিয়ে আলোচনায় বসব। সেখানেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’ এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের দাবিতে শনিবার রাত থেকে অনশন শুরু করা পাঁচ শিক্ষার্থী প্রশাসনের অনুরোধে অনশন স্থগিত করেছেন। গতকাল বিকালে তাদের অনশন ভাঙান প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানী। এর আগে বিকাল ৪টার দিকে অনশনকারী দুই শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একই ইস্যুতে ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) শিক্ষার্থীরা। শেকৃবি সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন তারা। শেকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মদ বলেন, ‘আমরা আপাতত সব ধরনের পরীক্ষা স্থগিত করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের গণজমায়েত স্থগিত করা হয়েছে। ক্লাস বন্ধে আমরা সরকারি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।’ করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আশঙ্কায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা এবং পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছেন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের দাবিতে গতকাল মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঝুঁকি এড়াতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) বিভিন্ন অনুষদের সব শিক্ষার্থী। এদিকে সরকারের নির্দেশনা পেলেই আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. লুৎফুল হাসান।