যশোরের বড় বাজার : চার মহল্লার সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ যশোর শহরের বড়বাজারে ব্যবসায়ীসহ আশপাশের কয়েকটি এলাকার মানুষ চিহ্নিত দুর্বৃত্তদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। হত্যা, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধের সাথে জড়িত এসব দুর্বৃত্ত। তুচ্ছ ঘটনায় এরা মানুষকে খুন-জখম করতে পিছপা হচ্ছে না। ইতোমধ্যে এই চিহ্নিত দুর্বৃত্তদের হাতে বড় বাজারের দুইজন ব্যবসায়ীসহ ৩ জন খুন হয়েছেন। জখম হয়েছেন আরো কয়েকজন। এসব দুর্বৃত্তকে লালন করছেন একটি মতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের পরিচয়ধারী দুইজন গডফাদার। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে দুর্বৃত্তরা ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে ওঠায় চরম আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বাজারের ব্যবসায়ীরা। কিন্তু একের পর এক অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালিয়ে গেলেও দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় সাধারণ মানুুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানায়, বড় বাজার এবং লোন অফিসপাড়া, বারান্দীপাড়া কদমতলা, খালধার রোড কেন্দ্রীক দুর্বৃত্তদের একাধিক চক্র রয়েছে। এখানে সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ীদের বেশ কয়েকটি চক্র রয়েছে। লোন অফিসপাড়া ও বারান্দীপাড়ার হালের দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী তাদের গডফাদার হিসেবে নিজেদেরকে কুখ্যাত করে তুলেছে। তাদের লাগামহীন দৌরাত্ম্যের ফলে বড় বাজারের ব্যবসায়ীরা যেন অসহায় হয়ে পড়েছেন। বাজারের একজন ব্যবসায়ী জানান, লোন অফিসপাড়া ও বড় বাজার কেন্দ্রীক গডফাদার লালিত সন্ত্রাসীরা কাঁচাবাজার, আলুপট্টি ও চুড়িপট্টি এলাকায় প্রায় সময় অবস্থান করে থাকে। তবে তাদের বেশি আড্ডা দিতে দেখা যায় লোন অফিস পাড়ার পলিপ স্কুল মাঠে। সেখানে মাদক সেবনসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা হয়। ওই স্কুল মাঠে যারা আড্ডা দিয়ে থাকে তাদের মধ্যে রয়েছে, ছোট হৃদয় ওরফে পিচ্চি হৃদয়, শিমুল, রাকিব, পলাশ, আকাশ, অনিক, আজগর, সবুজ প্রমুখ। এই চক্রটি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। সূত্র জানায়, গডফাদারের সেকেন্ড ইন কমান্ড লোন অফিস পাড়ার কালাম কসাইয়ের ছেলে কুখ্যাত ভাগ্নে হৃদয়। বর্তমানে সে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের একটি মামলায় কারাগারে রয়েছে। কিন্তু কারাগারে বসেই সে বড় বাজার এলাকার মাদক ব্যবসা ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে। মাঝে মধ্যে সহযোগী সন্ত্রাসীরা কারাগারে তার সাথে দেখা করতে গেলে সে তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের নানা দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, গত সাড়ে ৩ বছরে বড় বাজারের দুইজন ব্যবসায়ী এবং একজন আড়ত কর্মচারী সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছেন। এছাড়া সন্ত্রাসীদের হাতে আহত হয়েছেন একজন ক্রীড়াবিদসহ দুই ব্যক্তি। উল্লিখিত সন্ত্রাসীরা দুটি হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ওই সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন মাছের আড়ত কর্মচারী শেখ ইমরান হোসেন মুন্না। এর আগে ২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর প্রকাশ্যে মাছ ব্যবসায়ী পাপ্পুকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে একই সন্ত্রাসীরা। এ সময় সন্ত্রাসীদের হাতে আহত হয়েছিলেন পাপ্পুর ভাই দিপু। এছাড়া বছর খানেক আগে কাঁচাবাজারে চাঁদা না দেওয়ায় ভাগ্নে হৃদয়সহ তার সহযোগীরা ক্রীড়াবিদ ও ব্যবসায়ী শেখ মাহফুজুর রহমান নিপুকে ছুরিকাঘাত করেছিল। কিন্তু এ সব ঘটনায় মামলা মোকদ্দমা হলেও কার্যত বাজার এলাকায় নানা অপরাধের সাথে জড়িত দুর্বৃত্তদের দমনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী কঠোর কোন পদক্ষেপে যায় না রহস্যজনক কারণে।
সূত্র জানায়, বড় বাজারে লেবারের লেবাসে সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে বেশ কয়েকজন। মূলত কাঁচাবাজার ও আড়ৎ এলাকায় এসব লেবারের অবস্থান। এই লেবারদের অধিকাংশের আসল বাড়ি আবার ভোলা জেলায়। আবার কোন কোন লেবারের সাথে দুর্বৃত্তদের গোপন যোগাযোগ রয়েছে। এই লেবারদের ৩ জন হচ্ছে রফিক, লাল ও হোসেন আলী। গত ২১ ফেব্রুয়ারি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেবার নামধারী সন্ত্রাসী হোসেন আলী ও তার সহযোগী পলাশ কাঁচাবাজার এলাকায় জাকির হোসেন নামে অপর একজন লেবারকে লোহার হুক দিয়ে মাথাঢ আঘাত করেছিল। শুধু তাই নয়, কাঁচাবাজারের অনেক ব্যবসায়ী লেবার নামধারী সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এরা ক্রেতা-বিক্রেতার সাথে খারাপ ব্যবহার করে থাকে। মারধরও করে। সূত্রটি আরো জানায়, বড় বাজারে রাব্বি নামে একজন দুর্বৃত্ত ইজারাদারের পোষ্য গুণ্ডা হিসেবে পরিচিত। লেবার নামধারী সন্ত্রাসী ও কিশোর গ্যাংয়ের সাথে তারও যোগাযোগ রয়েছে। বাজারের ব্যবসায়ীদের সাথে সে কারণে-অকারণে খারাপ ব্যবহার করে থাকে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
অপর একটি সূত্র জানায়, সন্ত্রাসীদের বারান্দীপাড়া এলাকার অপর গডফাদারের সহযোগীরা পশ্চিম বারান্দীপাড়া, খালধার রোড, কদমতলা, কাঁচাবাজারসহ আশেপাশের কয়েকটি এলাকায় অবস্থান করে থাকে। তার সহযোগীদের মধ্যে রয়েছে চায়না সাগর, সালাম, তালেব, ইসমাইল, শান্তি, তপু, দ্বিপন, ইউসুফ, রিফাদ, দিপু, ইব্রাহীম প্রমুখ। এরা মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত। কাঁচাবাজার এলাকাতেও তারা সন্ত্রাসীমূলক দাপট দেখিয়ে থাকে। গত ২১ ফেব্রুয়ারি চায়না সাগরের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একজন টাইলস মিস্ত্রিকে ছুরিকাঘাত করে। এছাড়া কদমতলায় আরেকটি সন্ত্রাসী চক্র রয়েছে। ২০১৬ সালের ২৬ নভেম্বর কদমতলার ওই সন্ত্রাসী চক্রের হাতে খুন হয়েছিলেন মাছ বাজারের ব্যবসায়ী সুমন হোসেন। গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, সন্ত্রাসীরা এতোই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে বাজারে ব্যবসায়ীদের ব্যবসা করা দায় হয়ে পড়েছে। কোন অপরাধ ঘটানোর পর পরই সন্ত্রাসীদের সাময়িক গা ঢাকা দিতে দেখা যায়। বিভিন্ন বস্তি এলাকায় গিয়ে এরা আত্মগোপন করে থাকে। কেউ কেউ ঘোপ এলাকাতেও আত্মগোপন করে। আবার শহর ও শহরতলীতে স্বজনদের বাড়িতেও আশ্রয় নেয়। সূত্র জানায়, কোন অপরাধ ঘটলে প্রথম প্রথম পুলিশ দুর্বৃত্তদের ধরতে বাজার এলাকায় একটু তৎপরতা দেখায়। পরে পুলিশের তৎপরতা কমে গেলে অপরাধীরা ফের বাজার এলাকায় ফিরে আসে। এভাবে চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু বাজার ও আশেপাশের মানুষ সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না কখনো। এদিকে পুলিশের উর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জানান, বাজার এলাকার সন্ত্রাসীদের দু জন গডফাদারের নাম তাদের হাতে এসেছে। এ বিষয়ে তারা খোঁজখবর নিচ্ছেন। বাজারের অপরাধ দমনে শুধু সন্ত্রাসী নয়, তাদের যারা লালন করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বাজারের ব্যবসায়ীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, বাজারে ইয়াবা ব্যবসাসহ না অপরাধে জড়িতদের সাথে সদর ফাঁড়ি পুলিশের কোন কোন কর্মকর্তার সখ্য রয়েছে। এরা পুলিশের সোর্স হিসেবেও কাজ করে থাকে। এ কারণে ইয়াবা ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়না পুলিশ। যোগাযোগ করা হলে বাজার এলাকার দেখভালের দায়িত্বে থাকা সদর ফাঁড়ি পুলিশের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর তুষার কুমার মন্ডল এ বিষয়ে বলেন, বাজারের কোন মাদক ব্যবসায়ী অথবা মাদকসেবী তাদের সোর্স হিসেবে কাজ করেন না। তাদের কারো সাথে পুলিশের সম্পর্ক নেই বলেও তিনি দাবি করেন। তবে কেউ যদি তাদের সোর্স হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে সেই বিষয়টি তাদের জানা নেই। এদিকে পুলিশের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জানান, বাজার এলাকার সন্ত্রাসীদের দুজন গডফাদারের নাম তাদের হাতে এসেছে। এ বিষয়ে তারা খোঁজখবর নিচ্ছেন। বাজারের অপরাধ দমনে শুধু সন্ত্রাসী নয়, তাদের যারা লালন করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।