নীলক্ষেতে মিলছে গবেষণাপত্র

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ সত্যিই কি নীলক্ষেতের দোকানে দোকানে মিলছে গবেষণাপত্র? এখানকার গবেষণাপত্র দিয়েই কি কেউ কেউ নিচ্ছেন পিএইচডি ডিগ্রি? আবার কেউ তৈরি করছেন মৌলিক গবেষণাপত্র? এমন প্রশ্ন মাথায় নিয়েই গত তিন দিন অনুসন্ধান চালানো হয় নীলক্ষেতের কম্পিউটার দোকানগুলোতে। আর এ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ভয়ঙ্কর সব তথ্য। খবর ছিলো বছরের পর বছর এখানে বিক্রি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক গবেষণাপত্র। কেউ কেউ পিএইচডি’র মতো গবেষণা পত্রও কিনে নিচ্ছেন এখান থেকে। অনুসন্ধানে দেখা যায় দোকানগুলোতে রয়েছে পিএইচডি’র নানা গবেষণা। কেউ একাধিক গবেষণা কিনে নিয়ে কাটছাঁট করে তৈরি করছেন মৌলিক গবেষণা পত্র। তিন দিনে কথা হয় ৩৫ জন শিক্ষার্থী ও কমপক্ষে দশটি কম্পিউটার দোকানির সঙ্গে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ জন, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮ জন।
আর বাকি ১৭ জনের মধ্যে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ড্যাফোডিল, স্টেট ও ইউল্যাব এবং লালমাটিয়া মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী রয়েছেন। এসব শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিবিএ, এমবিএ ও আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলো বেশি। তাদের ভাষ্য, ডিপার্টমেন্টের দুইএকজন ছাড়া সবাই এসব জাল গবেষনার ওপর নির্ভরশীল। দামে কম ও পরিশ্রম কম হওয়ার কেউ আর নিজ থেকে গবেষণা করতে চান না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফিন্যান্স বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন , থিসিস পেপার ধরার সাধ্য শিক্ষকদের নেই। তারা ধরবে কিভাবে? তাদের নিজেদের গবেষণাপত্রও তো বেশির ভাগ জাল। আর ৫০ টাকা বা একশ টাকা দিয়ে গবেষণা পত্র পেলে কে কেউ পরিশ্রম করবে? জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন , আমাদের গবেষণার সময় ছিলো ছয় মাস। আমরা কেউই মাঠে যাইনি। কোনোরকম একটা প্রস্তাবনা জমা দিয়েছি। এরপর এখানে এসে এক ঘন্টার মধ্যে আমার কাজ হয়ে গেছে। সুপারভাইজার দেখানোর পর যদি এদিক সেদিক করতে বলে, সফট কপি নিয়েই যাচ্ছি। করে ফেলবো।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলিক জ্ঞানচর্চা শেখানোর জন্য স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গবেষণার কোর্স থাকে। মৌলিক বিষয় নির্বাচন থেকে মাঠে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা এবং গবেষণা প্রতিবেদন লেখার কাজটি শিক্ষার্থী করেন একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে। একজন শিক্ষার্থী এসব গবেষণা করতে ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সময় পান। কিন্তু নীলক্ষেতে আসলে এসব গবেষণা মিলে সহজেই। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মৌলিক গবেষণাপত্র চুরি করে নতুন থিসিসের রূপ দেয়া হয়। পরে শিক্ষার্থীর জাল গবেষণা পত্র তৈরি করতে সহযোগিতা করেন নীলক্ষেতের কম্পিউটার ও ফটোকপি দোকানগুলো।এসব দোকানে টাকা দিলেই মিলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিস ও রিসার্চ মনোগ্রাফ। অনার্স শেষ বর্ষে এসে গবেষণা প্রবন্ধ হিসেবে এসব ব্যবহার করছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এখানে ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০ বা ১০০০ টাকার মধ্যেই মিলে গবেষণা পত্র। চাইলে প্রিন্ট ও সফট দু’টি কপিই পাওয়া যায়। তেমনি একটি নীলক্ষেতের এফএস প্রিন্টিং প্রেস। পরিচয় গোপন করে এখানে থিসিসের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়। বিষয় বলার পর কম্পিউটার থেকে একটি লিস্ট বের করেন তিনি। কম্পিউটারের ওই লিস্টে দেখা যায়, প্রায় সাড়ে তিন’শ গবেষাপত্র আছে তার কাছে। ব্যাংকিং ব্যাবস্থাপনা নিয়ে একটি গবেষপত্র চাইলে ,ওই দোকানি এই ধরনের ১২টি গবেষণা খুঁজে পান। দোকানের মালিক ফয়সালের কাছে জানতে চাওয়া হয় এতো গবেষাপত্র কিভাবে সংগ্রহ করেছেন? ফয়সাল জানান, বিভিন্ন সময় অনেক শিক্ষার্থী তাদের মৌলিক গবেষনা এখানে প্রিন্ট দিতে আসলে সেটা কৌশলে তারা রেখে দেন। পরে প্রিন্ট বা সফট কপি বিক্রি করেন। মার্কেটের পরের গলিতে নূর মাল্টিকালার দোকানে কথা হয় দোকান মালিক শরীফ মাহমুদের সঙ্গে। তার কাছেও ‘প্রিজনার্স রাইট’স ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি গবেষণা পত্র কিনতে চাওয়া হয়। শরীফ মাহমুদ মূহুর্তের মধ্যেই বের করে দেন এই শিরোনামে একটি গবেষণা পত্র। তবে তিনি সফট কপি দিতে চাননি। বলেন ,এটাই আমাদের ব্যাবসা। আইন বিভাগের থিসিস খুব কম আসে। এগুলো খুব দুর্লব । তাই এটা প্রিন্ট দিয়ে দিতে পারবো । এক হাজার টাকা দিলে মেইলে ও প্রিন্ট করে দিবো। মার্কেটিং এর একটি থিসিস তিনি ৫০ টাকায় সফট কপি মেইল করতে রাজি হন। তার কম্পিউটারেও প্রায় হাজার খানেক গবেষণা পত্র দেখা গেছে। একই মার্কেটে আরো একটি দোকার এমএস এন্টারপ্রাইজ। তার কাছে গিয়ে ‘ভারতীয় সিরিয়ালে প্রভাব বাংলাদেশেও’ শিরোনামে গবেষণাপত্র চাওয়া হয়। দোকানি দশ মিনিট ধরে প্রায় ৯’শ গবেষণাপত্রে লিষ্ট থেকে এই গবেষনাটি বের করে দেন। গবেষনাটির জন্য তিনি দাম চান ৩শ টাকা। প্রিন্ট দিলে চার’শ টাকার মধ্যেই দিতে রাজি হন। জামাল আহাম্মেদ বলেন ,আমার কাছে হাজার হাজার গবেষনাপত্র আছে। অর্ডার দিলেও ম্যানেজ করে দিতে পারবো। শুধু টাকাটা একটু বাড়িয়ে দিতে হবে।
ভিন্ন ভিন্ন কায়দায় আরো প্রায় দশটি কম্পিউটার ও ফটোকপি দোকানে ঘুরে পাওয়া গেছে একই চিত্র। কথা বলে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরই এর প্রধান ক্রেতা। তবে ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই এখানে বেশি আসে। নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেটের দোকানগুলোতে প্রকাশ্যে ‘এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিস, মনোগ্রাফ তৈরি ও প্রিন্ট করা হয়’ লেখা সাইনবোর্ড দেখা যায়। দোকানিরা শিক্ষার্থীদের রিতিমতো ডাকতে থাকেন থিসিস নেয়ার জন্য। আল হেলাল কম্পিউটার ও ফটোকপি দোকানের মালিক মো. আল হেলাল বলেন, এখানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসে । বিশ মিনিটের মধ্যেই তারা মাস ছয়েকের কাজটা করে নিয়ে যেতে পারে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, নীলক্ষেতের ৩৫টি দোকানে নিয়মিত গবেষনা বেচাকেনা করা হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাদের থিসিস, মনোগ্রাফ নীলক্ষেতের এই দোকানগুলোতে প্রিন্ট ও বাঁধাই করাতে আসলে কৌশলে একটি কপি কম্পিউটারে রেখে দেন তারা। পরে সেটাই অন্য কোন শিক্ষার্থীর কাছে বিক্রি করেন। তবে প্রকাশ্যে থিসিস বিক্রিকারীদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেনা সংশ্লিষ্টরা। ফটোকপির দোকানে সহজলভ্য হওয়ায় অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ে গবেষণা জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার উপর এর বিরুপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলেও দাবি করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এ ধরনের রেডিমেড থিসিস মনোগ্রাফ শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক সৃষ্টিশীলতাকে নিরুৎসাহিত করছে। এ ছাড়া এর ফলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মৌলিক কোনও গবেষণা প্রবন্ধও আসছে না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা গবেষণাপত্র চুরি ধরার জন্য বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করেন। তবে শিক্ষার্থী ও দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে যে বিষয়গুলো কেন্দ্র করে গবেষণাপত্র চুরি ধরা হয় , সেগুলোকে খুঁজে বের করে এগুলোকে কমানো হয়। ফলে তারা এসব ধরতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরে উপাচার্য অধ্যাপক ড.মো.আখতারুজ্জামান বলেন, এটা ফৌজদারি অপরাধ। যারা ক্রয় করছে এবং বিক্রয় করে তারা সমান অপরাধী। তাদের আমরা আইনের আওয়তায় নিয়ে আসবো। কোন কোন দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে আমরা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিবো।