পুড়ছে মসজিদ-ঘরবাড়ি আর দোকানপাট, নীরবে দেখছে পুলিশ

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ গত বুধবার দিল্লিতে সহিংসতা চলমান থাকা অবস্থায় হিন্দুত্ববাদী তাণ্ডব কবলিত এলাকা ঘুরে দেখেছেন হাফিনপোস্ট ইন্ডিয়ার সাংবাদিকেরা। তারা অশোক নগর, গোকুলপুরি ও চান্দ বাগের অন্তত তিনটি মসজিদ ও একটি মাজার পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা সম্পর্কে অবগত হয়েছেন। অশোকনগরে মওলা বখস ছাড়াও পুড়েছে চান্দ মসজিদ। গোকুলপুরিতে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে জামিয়া আরাবিয়া উলুম মসজিদ আর চান্দবাগে একটি মাজার পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দ্য ওয়ার জানিয়েছে, মুস্তফাবাদে চতুর্থ আরেকটি মসজিদ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মসজিদে নয় কেবল, আগুন দেওয়া হয়েছে মুসলিমদের বাড়ি আর দোকানেও। লুট করা হয়েছে সম্পদ। আর এসব ঘটনার প্রতিকার চাইলেও পুলিশের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না কোনও ধরনের সহযোগিতা।
অশোক নগরের মওলা বখস মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন সেখানকার বাসিন্দা নাসিরউদ্দিনের পরিবার। দাদার নামে প্রতিষ্ঠিত এই মসজিদটি ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে যেন পরিবারের কেউ মারা গেছে। ১৯৯০ সালে আমরা প্রথমবারের মতো মসজিদের কাছের একটি জায়গা একজন হিন্দু ব্যবসায়ীকে ভাড়া দেই। প্রতিবেশিদের মধ্যে সদ্ভাব বজায় রাখতেই আমরা তা করেছিলাম’। মওলা বখস মসজিদের সাতটি দোকানেও আগুন দেওয়া হয়েছে। চালানো হয়েছে লুটপাট। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি (সোমবার) সন্ধ্যায় গোকুলপুরির জামিয়া আরাবিয়া মদিনাতুল উলুম মসজিদে সংঘবদ্ধ হামলা চালানো হয়। গোকুলপুরি মেট্রো স্টেশন থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে ওই মসজিদটির অবস্থান। পরদিন সকালে গোকুলপুরি থেকে পালিয়ে যান ব্যবসায়ী করিম খান। জানান, সন্ধ্যায় মসজিদে হামলা চালানোর পর রাতে আবারও ফিরে এসে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তিনি বলেন, “প্রায় ৩০ জনের একটি মিছিল যখন ‘জয় শ্রীরাম’, ‘মুসলমানরা বাইরে আয়’ স্লোগান দিতে দিতে দৌড়ে আসছিল সেই সময়ে আমি পালিয়ে যাই।”
বর্তমানে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে কারদামপুরির একটি মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন করিম। তিনি বলেন, ‘ওই মিছিল আসার আগ পর্যন্ত (হিন্দু) প্রতিবেশিরা আমাদের স্বস্তিতে রেখেছিল আর বলেছিল কিছুই হবে না। কিন্তু যখন তাদেরই দরজায় তালা দেওয়া দেখলাম, তখনই বুঝলাম তারা আর কেউ আসবে না আমাদের রক্ষা করতে’। জামিয়া আরাবিয়া মদিনাতুল উলুম মসজিদটি ১৯৭৮ সালে স্থাপিত হয়। স্থানীয় মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে এটি জান্নাতি মসজিদ নামে পরিচিত। বুধবার সকালে হাফপোস্টের সাংবাদিকেরা সেখানে গিয়ে পুড়ে যাওয়া মসজিদের ধ্বংসাবশেষে মার্বেলের কাজের অবশেষ আর চূড়ার কাছে একটি গেরুয়া পতাকা উড়তে দেখেছেন। করিম খান বলেন, ‘মসজিদ ভেঙে দেওয়ার চেয়ে বড় কষ্ট নেই। এটা খুবই সুন্দর আর ভেতরে এটা খুবই দৃষ্টিনন্দন ছিল’।
বৃহস্পতিবারও চলতে থাকে সহিংসতা। গোকুলপুরি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে অশোক বিহারে বসবাস করেন মোহাম্মদ আকবর কুরেশি। ২৫ ফেব্রুয়ারি তার বাড়ির দরজায় একটি জ্বলন্ত চটের বস্তা ছুড়ে দিয়ে দরজায় লাথি দিতে থাকে হামলাকারীরা। তিনি জানান পরিবারের অন্যরা যখন মেঝেতে লুকিয়ে ছিল। তখন তিনি নিজে দৌড়ে দোতলায় গিয়ে আগুন নেভান। আর হামলাকারীরা তখন পাশেই তার মাংসের দোকানে লুটপাট চালাতে থাকে। কুরেশি যখন পুলিশ ডাকার চেষ্টা করতে থাকেন তখন চান্দ মসজিদে হামলা হয়। তিনি বলেন, ‘আমরা পুলিশকে বার বার ফোন করতে থাকি আর তারা বলতে থাকে দুই মিনিটে আসছি। আবারও ফোন করে তাদের আসতে বলি। তারা বলতে থাকে এই পৌছালাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ আসেনি’। চান্দ মসজিদটি ১৯৮৬ সালে নির্মাণ করা হয়। অশোক নগরে কুরেশির বাড়ির কাছের আরেকটি মসজিদ হলো মওলা বখস মসজিদ। সেটি নির্মাণ করা হয় ১৯৭৪। ওই মসজিদটি ধ্বংসের ভিডিও বর্তমানে ভাইরাল হয়ে পড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, দুটি মসজিদই প্রায় একই সময়ে আক্রান্ত হয়। মসজিটির অভ্যন্তরের দেওয়ালে এখন শুধু কালির দাগ আর ভেতরে পড়ে রয়েছে পুড়ে যাওয়া কোরআন শরিফের ছিড়ে যাওয়া পাতা। অশোক বিহারে মওলা বখস মসজিদের পেছনে বসবাস করেন মোহাম্মদ কামারুদ্দিন। তিনি বলেন, জ্যোতি নগর পুলিশ স্টেশনে যে কতবার ফোন করে সাহায্য চেয়েছেন তা তিনি নিজেই ভুলে গেছেন। কামারুদ্দিন বলেন, সংঘবদ্ধ হামলাকারীরা মওলা বখস মসজিদে হামলা চালানোর পর আশেপাশের দোকান ও মুসলমানদের বাড়িঘরে লুটপাট চালায়। তিনি বলেন, ‘আমি এরকম ভয় পাইনি। আপনি জানেন আপনি মারা যাবেন, মেরে ফেলার ভয়ঙ্করতম, উপায় আপনি চিন্তা করতে পারেন কিন্তু ভেতর থেকে কেউ একজন বলবে বেঁচে থাকতে লড়াই চালিয়ে যাও’। তিনি বলেন, ‘পুলিশকে বহুবার ফোন করেছি কিন্তু সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসেনি’। পুলিশি নীরবতার সুযোগে দাঙ্গাকারীরা বাড়ি পুড়িয়ে দিতে শুরু করলে কামারুদ্দিন ও তার পরিবারের সদস্যরা বাড়ির ছাদ থেকে আরেকটি মুসলিম পরিবারের বাড়ির ছাদে লাফিয়ে পড়ে। এর মধ্যে তাদের এক আত্মীয় জ্যোতি নগর পুলিশ স্টেশনে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। সেখান থেকে একটি জিপ পাঠিয়ে তাদের উদ্ধার করে নেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘পুলিশ বলে যে, আমরা কী করতে পারি? আমরা যখন তাদের বললাম আমাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তখন তারা বলে যে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও যে তোমাদের জীবন বেঁচেছে’।
দাঙ্গাকারীরা কামারুদ্দিনের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়নি। কারণ হিন্দু প্রতিবেশিরা তাদের থামতে বলেছিল। তিনি বলেন, তার প্রতিবেশিরা কখনোই চায়নি তার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হোক। তবে পুড়িয়ে দেওয়া না হলেও বাড়িতে দুই মেয়ের বিয়ের জন্য যোগাড় করা স্বর্ণালঙ্কার, নগদ টাকাসহ মূল্যবান সবকিছু লুট করা হয়েছে। তিনি বলেন প্রায় ১৫ লাখ মালামাল লুট হয়েছে।কামরুদ্দিনরা লুট হওয়া বাড়িতে ফিরেছেন বৃহস্পতিবার বিকেলে। হাফপোস্ট ইন্ডিয়ার প্রতিনিধিরা বুধবার তাদের বাড়িতে যায় তখন তাদের হিন্দু প্রতিবেশিরা চা, স্ন্যাকসের পাশাপাশি সমবেদনা নিয়েও এগিয়ে আসে। আর তার সাদরে গ্রহণ করেন কামারুদ্দিনও। কামারুদ্দিন পরে সাংবাদিকদের নিজের ঘরে নিয়ে যান। সেখানে মেঝেতে ছেড়া কাপড় ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। বাড়ির সব আসবাবপত্রও লুট করা হয়েছে। এক প্রতিবেশি বলেন, হিন্দুরা সাহায্য করতে চাইলেও পারেনি। হামলাকারীরা সংখ্যায় এতো বেশি ও সহিংস ছিলো যে তা সম্ভব হয়নি। কামারুদ্দিন বলেন বিষয়টি তিনি বুঝতে পারেন।
অশোক নগরে মুসলমানদের মালিকানায় থাকা অন্তত সাতটি দোকান ও পাঁচটি বাড়ি লুটপাট করা হয়েছে। সেখানে এখনবো থাকতে চান কিনা জানতে চাইলে কামারুদ্দিন বলেন, ‘ভেঙে পড়েছি। আমার পরিবার এখানে ৪০ বছর ধরে বাস করছে। আর প্রতিবেশিদের সঙ্গেও সদ্ভাব রয়েছে। এই এলাকা ছেড়ে যাওয়ার মানে যে বিদ্বেষীরা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে চায়, তাদের জয়ী হতে দেওয়া। কিন্তু এখানে বাস করার ঝুঁকি নিয়ে পরিবারকে আর কিভাবে বিপদে ফেলবো’? তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশিদের সঙ্গে আমার এখনও কোনও সমস্যা নেই কিন্তু মনে হয় না এভাবে আর ভাবতে পারবো। এখনও জানি না কী করবো’। তিনি বলেন, ‘জানি হামলাকারীদের সংখ্যা অনেক বেশি আর বিপদজনক ছিলো কিন্তু যদি সব হিন্দু বাসিন্দারা বের হয়ে এসে তাদের চলে যেতে বলতো তাহলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারতো’। একই রকম দ্বিধায় আছেন গোকুলপুরি থেকে পালানো করিম খান। তার প্রতিবেশিরা শিখ ধর্মাবলম্বী। তিনি জানান, তার প্রতিবেশিরা মুসলমানদের উদ্ধার করেছে আর তাদের মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় পাঠিয়ে দিয়েছে। তিনি নিজে এক হিন্দু প্রতিবেশির সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন সে তাকে তার বাড়ির পরিস্থিতি জানাতে থাকে। তিনি বলেন, তারপরও ফিরে গেলে আমি ভয়ে থাকবো। প্রতিবেশিদের নিয়ে আমার কোনও সমস্যা নেই কিন্তু আমার মনে হয় না ভবিষ্যতে একইরকমভাবে ভাবতে পারবো। তবে দুই লাখ টাকা হারানো কুরেশি অশোক নগর ছাড়ার কথা ভাবতে পারছেন না। তিনি বলেন, জানি না কবে এই ভয় যাবে কিন্তু এটা আমার বাড়ি। নাসির উদ্দিন নিশ্চিত তার পরিবার আবারও মসজিদটি নির্মাণ করবে। তিনি বলেন, মসজিদটি দিল্লির দাঙ্গার স্মারক হয়ে থাকবে।