কত টাকা কেউ জানে না

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ ক্যাসিনোকান্ডে অন্যতম দুই হোতা এনামুন হক এনু ও রূপন ভূঁইয়ার কত টাকা, বাড়ি, গাড়ি আর ফ্ল্যাট কেউ জানে না। একের পর এক ক্যাসিনো ব্রাদার্সের টাকার পাহাড় আর সম্পদ বেরিয়ে আসায় বিস্মিত খোদ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। এনু-রূপনের নতুন আরও ভল্টের খোঁজে গোয়েন্দারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি এনু-রূপনেরই এমন সম্পদ থাকে, তাহলে তাদের গডফাদাররা কত টাকার মালিক? প্রশ্ন উঠেছে, পুরান ঢাকার সূত্রাপুর ও নারিন্দার দুটি বাসা থেকে উদ্ধারকৃত সম্পদ শুধুই কি এনু-রূপনের? গত সোমবার রাতে নারিন্দার ‘মমতাজ ভিলা’ থেকে উদ্ধারকৃত বিপুল পরিমাণ টাকার সঙ্গে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ‘ক্যাসিনো চিপস্্’ নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের। র‌্যাবের গোয়েন্দা এবং আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাশেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেখুন! ক্যাসিনো থেকে আমরা দৃষ্টি সরাইনি। এর প্রমাণ দেশবাসী এবারও পেয়েছে। এর সঙ্গে যে-ই জড়িত থাকুক, তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। তবে এর আগে প্রাপ্ত তথ্যগুলো দফায় দফায় যাচাই-বাছাই করে নিচ্ছি।’ তদন্তসংশ্লিষ্টদের কাছে তথ্য এসেছে, পুরান ঢাকার আরেকটি বাসায় এনু-রূপনের আরও অন্তত তিন-চারটি ভল্ট রয়েছে। অত্যাধুনিক ওই ভল্টগুলো ইলেকট্রনিক চিপস্্ ও পাসওয়ার্ড-সংবলিত। অত্যন্ত সুরক্ষিত এসব ভল্টে রক্ষিত আছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। তবে ওই তথ্যের বিষয়টি নিশ্চিত হতে বেশ কয়েকটি বাসায় এরই মধ্যে বিভিন্ন কৌশলে রেকি সম্পন্ন হয়েছে। তবে বাসা নিশ্চিত হতে চেষ্টার কোনো কমতি রাখা হচ্ছে না বলে নিশ্চিত করেছেন একাধিক কর্মকর্তা। তাদের ধারণা, ওই বাসায় রক্ষিত ভল্টগুলোয় সম্পদের পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। সূত্র বলছেন, ১৮ সেপ্টেম্বর একযোগে রাজধানীর ফকিরাপুল ইয়ংমেন্স ক্লাব, শাহজাহানপুর মুক্তিযোদ্ধা চিত্তবিনোদন ক্লাব ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবে র‌্যাব-৩-এর একাধিক টিম অভিযান শুরু করে। ওই সুযোগে অন্য ক্লাবগুলো রক্ষিত বিপুল পরিমাণ অর্থ সরিয়ে ফেলে। এ সুযোগটি কোনোভাবেই হাতছাড়া করেনি ওয়ান্ডারার্স ক্লাব কর্তৃপক্ষ। প্রায় ৪ ঘণ্টা পর ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে র‌্যাব সদস্যরা অভিযানে গেলে নগদ মাত্র ১০ লাখ টাকা ও ক্যাসিনোর কিছু সরঞ্জাম উদ্ধার করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর এনু ও রূপনের সূত্রাপুর মুরগিটোলা মোড়ের বাসায় এবং তাদের দুই কর্মচারীর বাসায় অভিযান চালায় র‌্যাব। ওই অভিযানে এনু-রূপন ও তাদের দুই সহযোগীর বাসা থেকে ৫টি সিন্দুকভর্তি ৫ কোটির বেশি টাকা, ৮ কেজি সোনা (৭০০ ভরি) ও ৬টি আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় গেন্ডারিয়া, সূত্রাপুর ও ওয়ারী থানায় মোট ৭টি মামলা হয়। তখনই বেরিয়ে আসে ক্যাসিনো ব্রাদার্সের লুক্কায়িত সম্পদের একটি অংশ। চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা থেকে তাদের গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। রিমান্ডে তারা ২০০০ সালের পর থেকে ১০০ ফ্ল্যাট ও ২২টি বাড়ির মালিক হওয়ার কথা স্বীকার করেছে। ঢাকাতেই তাদের ছোট ছোট মাপের ৭০টি জায়গা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে তাদের ৪ বিঘার জমিরও সন্ধান মিলেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘যেহেতু নারিন্দার বাসা থেকে ২৬ কোটি টাকা, বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রার সঙ্গে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনো চিপস্ উদ্ধার হয়েছে, তাই এ দায় ক্লাব কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। ক্লাবের ক্যাসিনোর সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, ভাগ পেতেন তাদেরও পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ তারা আরও বলেন, ‘শুরুতে মাত্র দুটি ক্লাবে একযোগে অভিযান চালানোর কারণে ক্যাসিনো চলে এমন অন্য ক্লাবের কর্ণধাররা ক্যাসিনোসামগ্রী সরিয়ে ফেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। নারিন্দার বাসার চিত্র আমাদের অন্য ক্লাবগুলোর বিষয়টি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।’ গতকাল সরেজমিনে নারিন্দা কাঁচাবাজার এলাকায় গিয়ে শোনা যায় সবার মুখে মুখে ক্যাসিনো ব্রাদার্সের কথা। তাদের অনেকেরই প্রশ্নÑ এ দুই ভাই কীভাবে এলাকায় এত সম্পদের মালিক হলেন, কীভাবেই বা তারা দিনের আলোয় এতসব সিন্দুক বাসায় নিয়ে এলেন? তাদের অনেকেই আবার সিআইডি আর দুদকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের বিশ্বাস, এ দুই ভাইয়ের হেফাজতে আরও অনেকের গুপ্তধন রয়েছে। এলাকাবাসীর তথ্যানুযায়ী, ১৯৮৫ সাল থেকেই এনামুল ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ও রূপন আরামবাগ ক্লাবে জুয়া খেলতেন। একটা সময় তারা জুয়ার বোর্ডের মালিক বনে যান। সেখান থেকে আসতে থাকে কাঁচা টাকা। সে টাকাতেই ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক ফ্ল্যাট ও বাড়ি কেনা শুরু করেন তারা। গত ছয় থেকে সাত বছরে পুরান ঢাকায় বাড়ি কিনেছেন কমপক্ষে ১২টি। ফ্ল্যাট কিনেছেন ৬টি। পুরনো বাড়িসহ কেনা জমিতে গড়ে তুলেছেন নতুন নতুন ভবন। এ দুই ভাইয়ের মূল পেশা ছিল জুয়া। আর বাড়ি কেনা ছিল তাদের নেশা। স্থানীয়রা জানান, ২০১৮ সালে এনু গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদ নেন, আর রূপন পান যুগ্মসাধারণ সম্পাদকের পদ। তাদের পরিবারের পাঁচ সদস্য, ঘনিষ্ঠজনসহ মোট ১৭ জন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগে পদ পান। তারা সরকারি দলের এসব পদ-পদবি জুয়া ও ক্যাসিনো কারবার নির্বিঘ্নে চালানোর ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলেন বলে স্থানীয় লোকজন জানান।
এদিকে, ক্যাসিনোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠায় ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সভাপতি মোল্লা কাওসার স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি পদ হারান। তবে এখন পর্যন্ত ক্লাবের সভাপতি হিসেবে মোল্লা কাওসার ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন জয়গোপাল। গতকাল দুপুরে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে গেলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্লাব কর্মকর্তা বলেন, ‘একসময় ঐতিহ্যবাহী এ ক্লাবের ফুটবল টিমের অধিনায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। স্বাধীনতার পরও ’৯০-এর দশক পর্যন্ত ফুটবল, ক্রিকেটসহ সব খেলায় আধিপত্য বজায় রেখেছে এ ক্লাবটি। তবে ’৯০-এর দশকের শেষ দিক ’৯৮ সাল থেকে অবস্থান হারাতে থাকে ক্লাবটি। ফুটবল, ক্রিকেট খেলার পরিবেশ দখল করে নেয় জুয়া আর হাউজি। দ্বিতীয় তলা ভবনের নিচতলা দখলে নেয় জুয়া, হাউজি আর সর্বশেষ ক্যাসিনো। ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে ম্যানেজ করে ক্রীড়ামোদী নন, এমন ব্যক্তিরাই নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেন ক্লাবটিকে।’ প্রসঙ্গত, গত সোমবার গভীর রাতে পুরান ঢাকার লালমোহন সাহা স্ট্রিটের ১১৯/১ নম্বর মমতাজ ভিলার দুটি ফ্ল্যাটে ক্যাসিনো ব্রাদার্সের আরও ৫ সিন্দুকের খোঁজ পেয়েছে র‌্যাব। সিন্দুকগুলো থেকে র‌্যাব নগদ ২৬ কোটি ৫৫ লাখ ৬০০ টাকা জব্দ ছাড়াও সোয়া ৫ কোটি টাকার এফডিআরের বই, ১ কেজি সোনা, ৯ হাজার ২০০ ইউএস ডলার, ১৭৪ মালয়েশিয়ান রিংগিত, ৩৫০ ভারতীয় রুপি, ১ হাজার ৫৯৫ চাইনিজ ইউয়ান, ১১ হাজার ৫৬০ থাই বাথ ও ১০০ দিরহাম জব্দ করে।