করোনার প্রভাব : দাম বেড়েছে চিকিৎসা যন্ত্রপাতির

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ সাম্প্রতিক সময়ে চীনে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ফলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের উপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। করোনার কারণে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ব্যাহত হওয়ায় দাম বেড়েছে চিকিৎসা সামগ্রি ও যন্ত্রপাতির। পাশাপাশি সরবরাহ বিঘ্নের শঙ্কায় দাম বেড়েছে ওষুধের কাঁচামালের। ফলে অন্যান্য পণ্যের মতো ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে সরকার বিকল্প চিন্তা করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে চীনের প্রভাব আগে থেকেই ছিল। সম্প্রতি করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় এটি আরো বেশি সামনে চলে এসেছে। বর্তমানে ওষুধ তৈরির কাঁচামাল সরবারাহ বন্ধ রয়েছে। ফলে গত কয়েক দিনে ওষুধের দাম আগের তুলনায় বেড়েছে। শুধু তাই নয়, করোনা ভাইরাস থেকে সতর্কতার কারণে কেউ কেউ সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার শুরু করেছেন। সেই পণ্যটি এখন ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে ওষুধ শিল্পের উদ্যোক্তারা জানান, দেশে ওষুধের কাঁচামাল মজুদ রয়েছে তিন-চার মাসের। তাদের মতে, ওষুধের কাঁচামালের সবচেয়ে সস্তা উৎস হলো চীন। দেশটির বিকল্পগুলোর মধ্যে আছে ভারত, ভিয়েতনাম। এছাড়া দাম অনেক বেশি হলেও আছে ইউরোপীয় কোম্পানি।
চীনে করোনা ভাইরাসের প্রভাবে আমদানিনির্ভর কাঁচামালপ্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে দেশের সংশ্লিষ্ট খাতগুলোর উদ্যোক্তাদের মধ্যে। মোট আমদানির ২৬ শতাংশই চীন থেকে আমদানি হয় বলে এ অনিশ্চয়তা এখন আশঙ্কায় রূপ নিয়েছে। আর এটাকে পুঁজি করে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত চীনা সার্জিক্যাল জিনিসপত্রের দাম বাড়াতে কাজ করছে একটি সিন্ডিকেট। চক্রটি ডায়বেটিস মাপার কিটস ও অপারেশনে ব্যবহৃত সার্জিক্যাল আইটেমের দাম দিন দিন বাড়িয়ে বিক্রি করছে। এছাড়া এসব জিনিস-পত্রের দাম বাড়াতে কিছু ব্যবসায়ী ইচ্ছে করেই কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর সত্যতা পাওয়া গেছে রাজধানীর চিকিৎসা সামগ্রীর অন্যতম পাইকারি ও খুচরা বাজার শাহবাগ ও আজিজ মার্কেটে।
সূত্রমতে, ওষুধের কাঁচামালের প্রাপ্যতার বিষয়ে তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। সমপ্রতি দেশের ওষুধ শিল্প মালিকদের সমিতি বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিকে (বিএপিআই) কাঁচামাল মজুদের তথ্য জানাতে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যা অনুসরণে সংগঠনের পক্ষ থেকে সদস্য ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে এপিআই মজুদের হালনাগাদ তথ্য।
বিএপিআই সূত্রমতে, দেশের ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টের (এপিআই) ৯৭ শতাংশ চাহিদা মেটানো হয় আমদানির মাধ্যমে। গত অর্থবছরে দেশে ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় হয় ৬০ কোটি ডলার বা ৫ হাজার কোটি টাকা।
বিএপিআই সেক্রেটারি জেনারেল এম শফিউজ্জামান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জানতে চাওয়া হয়েছে। তাই এপিআইয়ের মজুদের হালনাগাদ নিয়ে আমরা কাজ করছি। শীর্ষ কয়েকটি কোম্পানির কাছ থেকে কিছু ফিডব্যাক পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত তিন বা চার মাসের কাঁচামাল মজুদ আছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। সংগঠনের সদস্য প্রায় ১৭০টি কোম্পানি। যদি পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটে, সর্বোচ্চ তিন মাস পর্যন্ত বাজারে ধারাবাহিকভাবে পণ্য দিতে পারব। তিনি বলেন, বড় কোম্পানিগুলোর কাঁচামালপ্রাপ্তি নিয়ে কোনো সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা এখনো দেখছি না। শাহবাগের ভিআইপি ড্রাগ হাউজ, রাজধানী ফার্মেসি, সিটি মেডিকেল হল, হেরা ফার্মেসি, জেলটিলা ফার্মেসি ও ঢাকা ফার্মা ঘুরে দেখা গেছে, সার্জিক্যাল কাজে ব্যবহৃত মেডিসিন, ডায়াবেটিকস মেশিন, পেশার মাপার মেশিন, শ্বাসকষ্টের নেবুলাইজার মেশিন, হুইল চেয়ার, ক্রেচার, স্লিম বেল্ট, কোমর ব্যাথা কমানোর বেল্ট, সার্জিক্যাল ব্লেড, কেঁচি, নিডেলসহ সব ধরনের পণ্যের দাম এখন ৫০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে।
খুচরা বিক্রেতারা জানান, ইতিমধ্যেই কিছু কিছু সার্জিক্যাল জিনিস-পত্রের দাম আগের চাইতে কয়েক গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর মধ্যে বাজারে চীনা পণ্যের কদর একটু বেশি। একই জিনিসপত্র ভারত থেকে আসছে। তবে ভারতীয় সার্জিক্যাল জিনিসপত্র দাম আগের মতোই আছে। খুচরা বিক্রেতাদের অনেকেই জানান, চীন থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য আসতে ২২ থেকে ২৮ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। তাই বন্ধের আগে জাহাজীকরণ পণ্য ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত আসবে। তারপর থেকে চীনা পণ্য আসা বন্ধ হবে এবং চীন জাহাজীকরণ শুরু করার ২২ থেকে ২৮ দিন পর থেকে স্বাভাবিকভাবে আসতে শুরু করবে। মাঝখানের এই সময়ে চীনা পণ্যের সংকট হতে পারে আশঙ্কা করে বড় আমদানিকারকরা এখনই মজুদ করতে শুরু করেছেন। ফলে পাইকারি মার্কেটে চীনা পণ্যের দাম বেড়ে গেছে, যার প্রভাব পড়ছে খুচরা মার্কেট পর্যন্ত।
তোপখানা রোডে অবস্থিত বিএমএ ভবনের রাজিব ডেন্টাল অ্যান্ড সার্জিক্যালের স্বত্বধিকারী মো. আনোয়ার হোসেন ও গ্যালাক্সি হেলথ কেয়ারের বিক্রেতা দীপন পাল বলেন, চীনে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের পর থেকে চিকিৎসা সামগ্রীর দাম বেড়েই চলেছে। গত এক মাস ধরে চীনের কোন ইকুয়েপমেন্ট বাংলাদেশে ঢুকতে পারে নাই। নতুন কোন এলসিও খোলা যায়নি। ফলে আগের মালামাল বাজারে যা আছে সেগুলোর দাম প্রতি দিন বাড়ছে। আমরা জিনিসপত্র আজ যে দামে বিক্রি করছি, আগামীকাল তার চাইতে বেশি দামে কিনে দোকানে তুলতে হচ্ছে। ফলে আমরা এখন বিপাকে আছি। এভাবে চলতে থাকলে চীনা চিকিৎসা সামগ্রীর ভয়াবহ সংকট দেখা দেবে। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেডি ফেয়ার সার্জিক্যাল ও ভূইয়া সার্জিক্যালের বিক্রয় কর্মীরা জানান, আগে যেসব এলসি করা ছিল, করোনা ভাইরাসের কারণে এখনও সেই সব পণ্য হাতে আসেনি। ফলে স্বল্প দামে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।
ইলেকট্রো মেডিকেল ইক্যুইপমেন্টের আমদানিকারক ও ডিস্ট্রিবিউটর পদ্মা মেডিকেল সার্ভিসের মালিক মো. তৌহিদুল ইসলাম তালুকদার বলেন, করোনা ভাইরাসের আগে প্রতি কার্টন সার্জিক্যাল মাস্ক বিক্রি হতো ১৮০০ থেকে ২২০০ টাকা। তাতে প্রতি পিচের দাম পড়ত ১ থেকে সোয়া টাকা। এখন সেই কার্টনের দাম ৫৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা। ১ টাকার মাস্ক এখন ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, চীন থেকে মাস্ক আসছে না। দেশের কিছু কোম্পানি মাস্ক উৎপাদন করে সরাসরি হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করে। তিনি জানান, কেবল মাস্কই নয়, স্যালাইন সেট, ইউরিন ব্যাগসহ সব ধরনের ডিসপোজাল আইটেমের দাম বেড়ে গেছে। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, চীন থেকে বাংলাদেশ ১২০০ থেকে ১৫০০ পণ্য আমদানি করে। এর মধ্যে শিল্পের কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য বাল্ক আকারে আসে। করোনা ভাইরাসের প্রভাব সবক্ষেত্রেই কম-বেশি পড়ছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়েক বছর আগে প্রতি কেজি রেনিটিডিন ট্যাবলেট তৈরির ভারতীয় কাঁচামালের দাম ছিল ১,৬৫০ ও চীনের ১,৬৮০ টাকা। অবশ্য এটি এখন আমদানি নিষিদ্ধ। এছাড়া ওই সময় অ্যাজিথ্রোমাইসিন ১০,৫০০ থেকে ১১ হাজার টাকা, সেফ্রাডিন ৫,৬০০ টাকা, সিপ্রোফ্লক্সসিন ২,৯০০ টাকা, ওমিপ্রাজল ৮৭০ থেকে ৯০০ টাকা, প্যানটোপ্রাজল ৮,২০০ থেকে ৮,৪০০ টাকা এবং প্যারাসিটামল ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হতো। কিন্তু করোনার অজুহাতে এসব পণ্যের দাম এখন বাড়ানো হয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের ওষুধ শিল্পের বাজারের আকার ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ১৬ শতাংশ হারে বাড়তে থাকা বাজারটি যার ৭০ শতাংশই করে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠান। হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ডিএমডি ও সিইও মুহাম্মদ হালিমুজ্জামান বলেন, সাধারণত ন্যূনতম দুই মাসের মজুদ আমাদের থাকে। বড় প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেরই পর্যাপ্ত মজুদ থাকে। পণ্যের ভিন্নতা অনুযায়ী মজুদের পরিমাণেও ভিন্নতা থাকে। এখন পর্যন্ত কোনো উদ্বেগের পরিস্থিতি নজরে আসেনি। এ মুহূর্তে কোনো সমস্যার শঙ্কা নেই। কিন্তু আগামী মাসগুলোর বিষয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করা যাচ্ছে না।