থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করবেন যেভাবে

0

লোকসমাজ ডেস্ক॥ রক্তস্বল্পতাজনিত বংশগত ও জীনগত মারাত্মক রোগ হলো থ্যালাসেমিয়া। তবে এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। আমাদের দেশের জনসংখ্যার ৬-৭ শতাংশ লোক থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। প্রতিবছর নতুন করে ৮-১২ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। তাই আসুন জেনে নেই এ রোগ প্রতিরোধ করার উপায়-
থ্যালাসেমিয়া কী: ১৯৩০ সালে প্রথম ‘থ্যালাসেমিয়া’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। গ্রিক শব্দ ‘Thalassa’ এবং ইংরেজি শব্দ ‘aemia’ সহযোগে থ্যালাসেমিয়া শব্দটি তৈরি। ‘Thalassa’ অর্থ ভূমধ্যসাগরীয় এবং aemia অর্থ ‘রক্তাল্পতা’। ভূমধ্যসাগরের আশেপাশের দেশগুলোতে প্রথম এ রোগ আবিষ্কার হয় বলে এর নামকরণ হয় থ্যালাসেমিয়া। ভূমধ্যসাগর ছাড়া আফ্রিকা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
কারণ: ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জীনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জীন হিমোগ্লোবিনের গ্লোবিন অংশে ত্রুটি সৃষ্টি করে। ফলে লোহিত রক্তকণিকার আয়ু স্বাভাবিক ১২০ দিন থেকে কমে মাত্র ২০-৬০ দিনে নেমে আসে। অপরিপক্ক লোহিত রক্তকণিকার ভাঙনের দরুণ রক্তস্বল্পতা দেখা যায়। বাবা অথবা মা, অথবা বাবা-মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়া জীন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়। বাবা-মা দুজনই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন, তাহলে শিশুর থ্যালাসেমিয়া নিয়ে ভূমিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা ২৫%, বাহক শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা ৫০% আর সুস্থ শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা ২৫%। ভাই-বোনের (চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো) মধ্যে বিয়ে হলে এবং পরিবারে কারো থ্যালাসেমিয়া থাকলে সন্তান-সন্ততির থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত বা বাহক হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
প্রকার: থ্যালাসেমিয়া প্রধানত ২ ধরনের। যথা- আলফা এবং বিটা থ্যালাসেমিয়া। ১৬ নম্বর ক্রোমোসমে উপস্থিত ত্রুটিপূর্ণ আলফা গ্লোবিন চেইন উৎপাদনকারী জীনের ত্রুটির দরুণ আলফা থ্যালাসেমিয়া এবং ১১ নম্বর ক্রোমোসমে উপস্থিত ত্রুটিপূর্ণ বিটা গ্লোবিন চেইন উৎপাদনকারী জীনের ত্রুটির দরুণ বিটা থ্যালাসেমিয়া হয়। আলফা থ্যালাসেমিয়া আবার আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর (হাইড্রপস ফিটালিস) ও আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (হিমোগ্লোবিন-এইচ ডিজিজ/আলফা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট) এ ২ রকম হতে পারে। যেখানে প্রথমটি অনেক মারাত্মক। বিটা থ্যালাসেমিয়া অনুরূপভাবে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর (কুলি’স এনিমিয়া) ও বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (ট্রেইট) ২ রকম হতে পারে। এক্ষেত্রেও প্রথমটিই মারাত্মক বেশি। থ্যালাসেমিয়া বিভিন্ন হিমোগ্লোবিনোপ্যাথির সাথে একইসাথে সহাবস্থান করতে পারে। এদের মধ্যে আমাদের দেশে প্রধানত হিমোগ্লোবিন-ই বিটা থ্যালাসেমিয়া পাওয়া যায়। সামগ্রিকভাবে বিটা থ্যালাসেমিয়া, আলফা থ্যালাসেমিয়া অপেক্ষা বেশি তীব্র ও মারাত্মক।
লক্ষণ: বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে জন্মের ২-৩ বছরের মাঝে লক্ষণ প্রকাশ পায়। প্রথমে অবসাদ অনুভব, দুর্বলতা, শ্বাসকষ্ট, মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, অস্বস্তি প্রভৃতি পরিলক্ষিত হয়। ধীরে ধীরে প্লীহা বড় হয়ে যাওয়া, শরীরে অতিরিক্ত লৌহ জমা হওয়া, সংক্রমণ, অস্বাভাবিক অস্থি, জন্ডিস, গাঢ় রঙের প্রস্রাব, মুখের হাড়ের বিকৃতি, ধীরগতিতে শারীরিক বৃদ্ধি, হৃৎপিণ্ডে সমস্যা ইত্যাদি প্রকাশ পায়।
চিকিৎসা: থ্যালাসেমিয়া মাইনরে (ট্রেইট) সাধারণত কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। তবে থ্যালাসেমিয়া মেজরে নিয়মিত রক্তসঞ্চালন হলো প্রধান চিকিৎসা। তবে বারবার রক্তসঞ্চালনের একটি প্রধান অসুবিধা হলো যকৃতসহ বিবিধ অঙ্গে অতিরিক্ত লৌহ জমে যাওয়া। এ ধরনের জটিলতা প্রতিহতকরণে আয়রন চিলেশন থেরাপি এবং খাদ্যগ্রহণের পর চা পানের অভ্যাসকে উৎসাহিত করা হয়। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন থ্যালাসেমিয়ার একটি কার্যকরী আধুনিক চিকিৎসা কিন্তু ব্যয়সাপেক্ষ। অনেকসময় প্লীহা বেশি বড় হয়ে গেলে সার্জারির মাধ্যমে প্লীহা অপসারণেরও প্রয়োজন পড়তে পারে।
প্রতিরোধ: থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোকল্পে বিবাহপূর্ব রক্ত পরীক্ষার বিষয়টি উৎসাহিত ও বাহকদের মধ্যে বিবাহ নিরুৎসাহিত করতে হবে। সিবিসি ও হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিসের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ার বাহক শনাক্ত করা যায়। গর্ভস্থ সন্তান থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত কি-না জানার জন্য ফিটাল ব্লাড স্যাম্পলিং, অ্যামনিওসেনটেসিস, কোরিওনিক ভিলাস স্যাম্পলিং প্রভৃতি পরীক্ষা করা যায়। তবে এসব পরীক্ষা গর্ভাবস্থার ১৬-১৮ সপ্তাহে করানো উচিত। থ্যালাসেমিয়া নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি বছর ৮ মে ‘বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস’ পালন করা হয়। আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ ও সচেতনতাই পারে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করতে।