এক দশকে যশোরের উত্তরাঞ্চলে আধিপত্য নিয়ে খুন ১৩

0

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চরমপন্থি অধ্যুষিত যশোর সদর উপজেলার উত্তরাঞ্চলে খুনোখুনি বন্ধই হচ্ছে না। আদর্শচ্যুৎ চরমপন্থিরা ভাড়ায় মানুষ হত্যা, চাঁদাবাজি ও মাদক ব্যবসায়সহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। আধিপত্য বিস্তার নিয়েও তারা একে অন্যকে খুন করছে। চরমপন্থিদের কেউ কেউ আবার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারাচ্ছে। গত এক দশকে এভাবে উত্তরাঞ্চলের ১৩ জন চরমপন্থি সন্ত্রাসী খুন হয়েছে। আবার চরমপন্থি ও সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছেন জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাসহ অন্তত ৭ জন। এদিকে এ অঞ্চলের কুখ্যাত জুয়েল সম্প্রতি ডিবি পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর চরমপন্থিদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। অবশ্য তাদের গডফাদার ও আশ্রয়দাতা রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে উত্তরাঞ্চলের চরমপন্থিদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে না বলে সচেতন মহল মনে করছেন। এছাড়া এ অঞ্চলের সন্ত্রাসীদের কাছে রয়েছে অস্ত্রের মজুদ। যা উদ্ধারে দীর্ঘ দিন আইন-শৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর কোন অভিযান চোখে পড়েনি।
২০০৯ সালে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিন পর যশোরে চরমপন্থি সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন ইছালী ইউনিয়ন বিএনপি’র সহ-সভাপতি জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা খলিলুর রহমান। প্রকাশ্য দিবালোকে ইছালী ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামে সন্তানদের সামনে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে চরমপন্থি হাদি, বাছের, আজগর, সোহাগসহ অন্যরা। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের শেল্টারে থাকা বাছের পরে বাঘারপাড়া উপজেলার পুলেরহাটে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে গণপিটুনিতে নিহত হয়। এর কয়েক বছর পর চরমপন্থি হাদি ও সোহাগের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায় ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা এলাকায়। কালীগঞ্জে এনামুল নামে আরো একজন চরমপন্থির লাশ পাওয়া গিয়েছিলো। সে যশোর সদর উপজেলার ইছালী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মোশাররফ হোসেন হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। ২০১৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে যাবার পথে সদর উপজেলার পাঁচবাড়িয়ায় সন্ত্রাসীরা মোশাররফ হোসেনকে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছিলো। তার এই হত্যার পেছনে আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতার হাত ছিলো বলে পরিবারের অভিযোগ। তবে চরমপন্থি সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে তাকে হত্যা করা হয় বলে সিআইডি পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে। ইছালী ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আফজাল হোসেন এই মামলার অর্থদাতা ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে চার্জশিটে আসামি হয়েছেন। এ মামলায় উত্তরাঞ্চলের ডেভিড নামে আরো একজন চরমপন্থি আসামি রয়েছে। ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে সদর উপজেলার হাশিমপুর বাজারে একটি অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের এক নেতার সাথে চরমপন্থি ডেভিডকে দেখা গেছে।
২০১০ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে এক সময় চরমপন্থি সংগঠন বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পৃক্ত থাকা কোহিনুর রহমানের বস্তাবন্দি লাশ ইছালী ঋষিপাড়ার একটি ডোবা থেকে উদ্ধার করা হয়। ডোবায় জাগ দেয়া পাটের নিচে তার এই বস্তাবন্দি লাশ পাওয়া গিয়েছিলো। ১৯ আগস্ট রাতে প্রতিবেশী জালাল তাকে মোবাইল ফোন করে ডেকে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে সে নিখোঁজ ছিলো। কোহিনুর ইছালী পূর্বপাড়ার ইরাদ আলীর ছেলে। তাকে খুনের সাথে সর্বহারা পার্টির এনামুলও জড়িত ছিলো। ২০১৫ সালের ১৬ এপ্রিল সদর উপজেলার আড়পাড়ার খালপাড়ে চরমপন্থি জয়নাল তরফদার ও লিটু তরফদারকে গুলি চালিয়ে এবং কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ চরমপন্থিরা। পরদিন খালপাড়ে তাদের লাশ পাওয়া যায়। জয়লাল তরফদার হাশিমপুর গ্রামের মৃত আব্বাস তরফদারের ছেলে ও লিটু তরফদার একই গ্রামের আবজেল তরফদারের ছেলে। একই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর সদর উপজেলার শর্শুনাদহ গ্রামে প্রকাশ্য দিবালোকে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা মফজেল ওরফে বেড়ে মফজেল ওরফে বুড়ো মফজেলকে গুলি চালিয়ে এবং কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ চরমপন্থিরা। সে সদর উপজেলার মালিয়াট গ্রামের শাহাজান আলীর ছেলে। তালবাড়িয়ার ফোর মার্ডারসহ বেশ কয়েকটি হত্যা মামলা ছিলো তার বিরুদ্ধে। ২০১৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে সদর উপজেলার ঘুরুলিয়া গ্রামে অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মচারী রেজাউল ইসলাম চরমপন্থি সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন। হাশিমপুরের কুখ্যাত চরমপন্থি ও কিলার জুয়েল (সম্প্রতি বন্দুকযুদ্ধে নিহত) এই হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি ছিলো। ২০১৬ সালের ২৯ মার্চ সন্ধ্যারাতে সদর উপজেলার বারীনগর বাজারে সর্বহারা পার্টির ক্যাডারদের হাতে খুন হন কাশিমপুর ইউনিয়ন বিএনপি’র যুগ্ম সম্পাদক ইদ্রিস আলী। তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। বিএনপি নেতা ইদ্রিস আলী হত্যাকান্ডের সাথে কাশিমপুরের কুখ্যাত চরমপন্থি ও পেশাদার কিলার মোখলেছুর রহমান নান্নু, প্রিন্স ও হাশিমপুরের জুয়েলসহ বেশ কয়েকজন জড়িত ছিলো। পরে মোখলেছুর রহমান ভারতে পালিয়ে যায়। সেখানে সে ভারতের সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়। ২০১৫ সালের ২৩ জুলাই রাতে বাঘারপাড়া উপজেলার খাজুরায় জবা নামে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সদর উপজেলার শর্শুনাদহ গ্রামের বাসিন্দা জবাকে চরমপন্থিরা খুন করে বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালে সদর উপজেলার হাশিমপুরের সর্বহারা পার্টির দুর্ধর্ষ ক্যাডার আমিরুল ইসলাম বুলি এবং তার শ্যালিকার ছেলে চরমপন্থি বাবলা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। ২০১৯ সালের ৩০ নভেম্বর হাশিমপুর বাজারে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে এবং ছুরিকাঘাতে সাবেক চরমপন্থি ও বিশেষ আনসার সদস্য হোসেন আলী তরফদারকে হত্যা করে সর্বহারা পার্টির ক্যাডারা। এ ঘটনার ২ মাস পর কিলার জুয়েল হাশিমপুর বাজারের কাছে ডিবি পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র জানায়, উত্তরাঞ্চলে নিষিদ্ধ সংগঠন সর্বহারা পার্টির সন্ত্রাসীদের বর্তমানে একচ্ছত্র আধিপত্য। বর্তমানে ওই এলাকায় রয়েছে দুর্ধর্ষ চরমপন্থি আসকার (বাঘারপাড়ার কৃষ্ণনগর), সদর উপজেলার ফুলবাড়ি গ্রামের আমিরুল ইসলাম মিঠু, রাজাপুর গ্রামের আজগর আলী, হাশিমপুর গ্রামের মুন্না (বন্দুকযুদ্ধে নিহত বুলির ছেলে), আব্দুর রহমান বিশ্বাস, তারক, ডেভিড, পিকুল, আনোয়ার, বার্মিজ, ইছালীর আমিনুর (কোহিনুর হত্যা মামলার আসামি), সোহেল প্রমুখ। এই চরমপন্থিদের বেশ কয়েকজন হোসেন আলী খুনের মামলায় ডিবি পুলিশের হাতে আটক হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। তবে উত্তরাঞ্চলের মূর্তিমান আতঙ্ক জুয়েল ডিবি পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর ওই এলাকার চরমপন্থিদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। গা ঢাকা দিয়েছে অনেক চরমপন্থি। স্থানীয় সূত্রগুলো আরও জানায়, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু এ অঞ্চলে দীর্ঘ দিন অস্ত্র উদ্ধারে আইন-শৃঙ্খলা রা বাহিনীর কোন অভিযান দেখা যায়নি। এলাকার একটি সূত্র জানায়, যশোরের উত্তরাঞ্চলের চরমপন্থিরা বর্তমানে আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতার আশ্রয়ে রয়েছে। রাজনৈতিক ওই নেতাদের মদদে আদর্শচ্যুৎ এসব চরমপন্থি দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ধরে গোটা উত্তরাঞ্চলে চাঁদাবাজি, জমি দখল এবং ভাড়ায় মানুষ হত্যাকান্ডে লিপ্ত রয়েছে। এ কারণে আশ্রয়দাতা রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিলে এলাকায় চরমপন্থিদের দৌরাত্ম্য কিছু কমে আসবে বলে সচেতন মহলের অভিমত।