চেতনায় অমর একুশে

0

মহিউদ্দীন মোহাম্মদ ॥ ভাষা সংগ্রামী আব্দুল গফুর তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “যদি ’৪৭ সালে পার্টিশন না হতো তাহলে কিন্তু ভাষা আন্দোলনের প্রশ্ন উঠত না। অথবা লাহোর প্রস্তাব অনুসারে যদি পার্টিশন হতো তাহলে ভাষা আন্দোলন দরকার হতো না। কারণ তাহলে এদিকে এমনিতেই বাংলা হতো। যদি পার্টিশন না হতো, এমনকি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত চিন্তা করতেন, সারা ভারত অখ- এবং এখানে একটাই মাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে, সেটা হবে হিন্দি। এটা রবীন্দ্রনাথ নিজে মনে করতেন। তো সেইখানে বাংলা ভাষাভাষী গোটা ভারতের তুলনায় আর কয়জন! সেটা হতো না। সেই জন্য পার্টিশন হয়েছে বলে এবং লাহোর প্রস্তাব পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয় নাই বলে ভাষা আন্দোলনের সুযোগ আমরা পেয়েছিলাম। অখ- ভারত থাকলে কোন চান্সই ছিল না। আর লাহোর প্রস্তাব যদি পুরোটা বাস্তবায়িত হতো তাহলে পরে ভাষা আন্দোলন প্রয়োজন হতো না। এমনিতেই বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা হতো। ভাষা আন্দোলনের সুযোগটা ইতিহাসের কোন পটভূমিতে আমরা পেলাম সেটা আমাদের স্মরণ করা খুবই প্রয়োজন।” গফুর সাহেবের এ কথা থেকে বোঝা যায় সত্যিই এটা একটা বড়প্রাপ্তি বাংলাদেশীদের জন্য। আর এ গৌরবগাথা এখন বাংলাভাষাভাষীদের কাছে সর্বজনীন হয়ে উঠেছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো একুশে ফেব্রুয়ারি পার হলেই সমাজে বাংলা চর্চার বয়ান থেকে জাতি দূরে সরে যায়। ভাষা সংগ্রামী ও বিশিষ্ট লেখক আহমদ রফিকের একটি নিবন্ধ থেকে আমরা এখন উদ্ধৃতি দেব। তিনি আমাদের ভাষা চর্চার করুণ দশা নিয়ে বলেন- ‘ভাষা আন্দোলন ও স্বশাসনের জন্য লড়াইয়ের মাধ্যমে ভাষিক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বোধ হয় আমাদের মনে এমন ধারণা ও প্রত্যয় নিশ্চিত পেয়েছে যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার পর আমাদের ভাষাবিষয়ক দায়দায়িত্ব সব শেষ। ত্রেবিশেষে এমন ভাবনাও বহমান যে মাতৃভাষা তো মুখের ভাষা, এর আবার চর্চার কী প্রয়োজন। অথচ মুখের ভাষা যখন শিার ভাষা, জীবনাচরণের ভাষা, সংস্কৃতির ভাষা, সাহিত্যের ভাষায় সংশ্লিষ্ট তখন তার শুদ্ধতার বিষয়টি মননশীল বিকাশের দিকগুলো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কে চাইবে অশুদ্ধ ভাষায় লিখতে, পড়তে, মনের ভাব প্রকাশ করতে? কিন্তু আমরা তা করে চলেছি লেখায়, উচ্চারণে, ভাষার ব্যবহারে, কখনো ভুল শব্দের ব্যবহারেও।’ এ সমস্যার গোড়া চিহ্নিত করে তিনি বলেন, ‘মানসম্মত ভাষার চর্চা ও তাতে সার্বিক দতা অর্জনের েেত্র আমাদের পিছুটান অনেক। সে টান বা ত্রুটি যেমন ব্যক্তিক, তেমনি শিক ও শিায়তনিক। শিার নিচের দিকে যেমন দতার অভাব (জ্ঞান ও উচ্চারণ উভয় দিকে), তেমনি উচ্চপর্যায়ে দায়বদ্ধতার অভাব অধিক গুরুত্বপূর্ণ। … বাংলা মাতৃভাষা হওয়া সত্ত্বেও ভাষা বিচারে শিার যে বহু দিক আছে, বহু কিছু আছে এর বিপরীত ধারণা থেকে শিক, শিার্থী ও ভাষা ব্যবহারকারীর মুক্ত থাকার বিষয়টি খুবই জরুরি।’ আমরা মাতৃভাষা শিক্ষা ও যতেœর ব্যাপারে কী পরিমাণ যে গাফেল তা বলার নয়! এজন্য আহমদ বলেন ‘মাতৃভাষার ব্যবহারেও আমাদের বহুবিধ ত্রুটি দেখতে পাওয়া যায়। তা যেমন উচ্চারণে, তেমন নির্ভুল লেখা ও বলার েেত্র। শিক-শিাবিদদের অভিজ্ঞতা তেমন প্রমাণ দেয়। কলেজশিকদের ভাষা ও বানান যদি সংশোধন করতে হয়, তাহলে শিার্থীরা ওই সব শিকের কাছ থেকে কেমন ভাষা শিখবে, তা বলার অপো রাখে না। শিার েেত্র আরেক বড় উপদ্রব ত্রিধারা শিাব্যবস্থা- আরবি মাধ্যমে মাদ্রাসা শিা, বাংলা মাধ্যমে স্কুল-কলেজ শিা ও ইংরেজি মাধ্যমে ব্যাপক শিা, এগুলোকে শেষোক্ত দিক থেকে বিচার করলে উচ্চবর্ণ, মধ্যবর্ণ ও নিম্নবর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা বোধ হয় ভুল হয় না। কারণ এই তিন েেত্র অর্থনৈতিক শ্রেণিগত বৈষম্যও এক ধরনের অবাঞ্ছিত সত্য। যেমন মাদ্রাসা শিায় বাংলা ভাষা উপেতি, তার চেয়ে অনেক বেশি উপেতি ইংরেজি মাধ্যমে শিার েেত্র। কিন্ডারগার্টেন থেকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের পাঠক্রমে। শেষোক্ত েেত্র দু-একটি ব্যতিক্রম ধর্তব্যের মধ্যে নয়। মাদ্রাসা যেমন নিম্নবর্গীয় দরিদ্র শিার্থীর গতি, তেমনি দুর্মূল্য ইংরেজি মাধ্যম শিায়তন থেকে শিা নামক পণ্য কিনতে পারে শুধু বিত্তবান শ্রেণির সন্তানরা। এ দুই ধারার শিাব্যবস্থায়ই শিার্থী তার বাঙালি পরিচিতি সত্ত্বেও বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির গভীর সংশ্লিষ্টতা থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। তাই দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের পরিচয়ের অভাব। বিশেষভাবে যদি একুশের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিশদ বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা হয়। এর প্রধান কারণ পূর্বোক্ত দুই শিাব্যবস্থাতেই পাঠক্রমের ত্রুটি এবং সে েেত্র সরকারি নিয়ন্ত্রণের অভাব। একটি ভাষিক জাতিরাষ্ট্রের পে এ ধরনের ত্রিধা বিভক্ত শিাব্যবস্থা সচল রাখা কোন যুক্তিতে সম্ভব, তা ভাবতে গেলে অবাকই হতে হয়।’ তাই এখন সময় এসেছে বিষয়টি ভাববার। সামগ্রিক কর্মসূচির মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান না হলে ৫২-এর ভাষা শহিদদের সাথে সদাচার করা হবে না নিশ্চয়। তাদের আত্মার শান্তি কামনা যদি করি, সেক্ষেত্রে অবশ্য প্রত্যেকের যতেœর সাথে বাংলা ভাষা চর্চার দিকে মনযোগ দিতে হবে।