সিঙ্গাপুরে আরেক বাংলাদেশি করোনায় আক্রান্ত : চট্টগ্রাম বন্দরে ১৭ চীনা নাবিক ৮ দিন ধরে অবরুদ্ধ

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ চট্টগ্রাম বন্দরের বহিঃনোঙ্গরে একটি জাহাজে আট দিন ধরে অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছেন চীনের ১৭ নাবিক। তারা ঢাকা হয়ে বেইজিং ফিরতে চান। করোনা ভাইরাস ঠেকাতে চীনা নাগরিকদের অন-অ্যারাইভাল ভিসা বন্ধ থাকায় তারা চট্টগ্রামে নামতে পারছেন না। ওদিকে সিঙ্গাপুরে আরেক বাংলাদেশি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর মিলেছে। কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় চীনা নাবিকদের দেশে ফেরার সুযোগ দিতে ঢাকার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে চীনা দূতাবাস। তারা বিষয়টি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নজরে এনেছে। সেগুনবাগিচার দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবেচনায় পাঠিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিবে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। এদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৭ চীনা নাবিকের অন-অ্যরাইভাল ভিসা দেয়ার বিষয়টি ইতিবাচকভাবে চিন্তা করছে সরকার। তবে তারা সর্বশেষ কোথায় ছিলেন?
এ যাত্রায় জাহাজটি নিয়ে কোন কোন দেশ ভ্রমণ করে চট্টগ্রামে পৌঁছেছেন সেই সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য চাওয়া হয়েছে। ৪ঠা ফেব্রুয়ারি জাহাজটি তারা চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করেন। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টাই করে রাখার অলিখিত যে নিয়ম চালু করেছে চীন সরকার বাংলাদেশ হয়ত সেটি পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। সে হিসাবে ১৮ই ফেব্রয়ারি পর তাদের ভিসা ইস্যু এবং জাহাজ থেমে নামার অনুমতি হতে পারে। উল্লেখ্য, চীনের নাবিক এবং নাগরিকরা বরাবরই বাংলাদেশে অন-অ্যারাইভাল ভিসা পেতেন। উহান-ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার সাময়িকভাবে ওই সুবিধা স্থগিত রেখেছে। চীনা দূতাবাসের সঙ্গে আলোচনা করেই ওই সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। উহানের পর কুনমিংয়েও করোনা বিপর্যয়: করোনা ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল উহান পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। গোটা এলাকা যেনো মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছে। বাইরের সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ওই নগরীতে এখনও শত শত বাংলাদেশি অবরুদ্ধ অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। তারা বাসাবাড়ি কিংবা ডরমিটরিতে প্রায় বন্দি জীবন কাটাচ্ছেন। অবশ্য চীনা ত্রাণকর্মীরা তাদের শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পনি পৌছে দিচ্ছেন নিয়মিতভাবে। ওই বাংলাদেশিদের মধ্যে এখনও কেউ আক্রান্ত না হলেও ভাইরাসটি বাতাসে দ্রুত ছড়ানোর কারণে তারাও শঙ্কামুক্ত নন। বেইজিংয়ে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাসের বরাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, উহানের পর চীনের পূর্বাঞ্চলীয় অর্থনৈতিক গেটওয়ে কুনমিং শহরেও করোনা বিপর্যয় নেমে এসেছে। শহরটিতেও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। করোনা আতেঙ্কে শহরের হাসপাতালগুলোতে জ্বর-কাশি আক্রান্ত মানুষের ভিড় বাড়ছে। ভাইরাসটি ঠেকাতে আগাম ব্যবস্থার অংশ হিসাবে কুনমিং শহরের প্রায় সব রাস্তায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। স্বাস্থ্য কর্র্মীরা ওই সব পোস্টে গণহারে যাত্রীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন।
তবে এখনও শহরটিতে উহানের মত জীবানুমুক্তকরণ পাউডার ছিটানো শুরু হয়নি। কুনমিংয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল ঢাককে নিয়মিতভাবে তার এলাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করছেন। সর্বশেষ রিপোর্টে তিনি জানিয়েছেন- কুনমিংয়ে থাকা বেশ ক’জন বাংলাদেশি জ্বর-কশিতে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তারা আক্রান্ত নন মর্মে রিপোর্ট পেয়েছেন। কনসাল জেনালের নিজের চলাফেরায়ও বেশ ক’বার চেকিংয়ের শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। ওদিকে উহান-ভাইরাসের ভয়াবহতা এবং এটি নিয়ন্ত্রণে চীন সরকারের উদ্যোগগুলো বিষয়ে ব্রিফ করতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সময় চেয়েছেন। আজ এ নিয়ে দুইমন্ত্রীর টেলিফোনে আলোচনা হতে পারে। ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্র লি জিমিং একদিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেখানে তিনি চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর তরফে মন্ত্রীর সময় চান। আজ পুরো বিষয় নিয়ে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূতও গণমাধ্যমকে ব্রিফ করবেন বলে জানা গেছে। সিঙ্গাপুরজুড়ে অরেঞ্জ অ্যালার্ট, আক্রান্ত বাংলাদেশি আইসিইতে: সিঙ্গাপুরস্থ বাংলাদেশ মিশন জানিয়েছে, দেশটিতে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত একমাত্র বাংলাদেশিকে আইসিইউতে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তার অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে। তার চিকিৎসার বিষয়টি সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মনিটর করছে। তবে সর্বশেষ যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে জানা গেছে- ওই আক্রান্ত বাংলাদেশি যে ডরমিটরিতে থাকতেন তার সব সদস্যকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে সরকার। তাদের কারও শরীরে করোনার ভাইরাস জীবাণু ছড়িয়েছে কি-না? সেটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে। ওই ডরমিটরির ১৯জন বাসিন্দার মধ্যে ৯জন বাংলাদেশি রয়েছেন। তাদের সম্পূর্ণ আলাদা বা কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে। দূতাবাস ভায়া মিডিয়া তাদের খোঁজ-খবর রাখছে জানিয়ে মিশন জানিয়েছে- অর্থনৈতিক কারণে সিঙ্গাপুরে চীনসহ গোটা দুনিয়ার লোকজন যাতায়াত রয়েছে। কারও যাতায়াতে বিধি নিষেধ (রেড অ্যালার্ট) আরোপ করা না হলেও সিঙ্গাপুর সরকার করোনা সতর্কতায় বেশ আগে থেকেই অরেঞ্জ এলার্ট জারি রেখেছে।
মৃতের সংখ্যা হাজার ছাড়ালো, একদিনে ১০৮ জন: করোনা ভাইরাস সংক্রমণে চীনে নিহতের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে। সোমবার শুধু হুবেই প্রদেশে মারা গেছেন ১০৮ জন। প্রতিদিন এ ভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যার দিক দিয়ে এটা রেকর্ড। এর আগে একদিনে এত মানুষ মারা যাননি। সব মিলিয়ে সোমবার দিনশেষে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০১৬। তবে এদিন নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা শতকরা ২০ ভাগ কমেছে। ওদিকে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় কর্তব্যে অবহেলার কারণে বেশ কিছু সিনিয়র কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেন হুবেই হেলথ কমিশনের পার্টি সেক্রেটারি ও কমিশনের প্রধান। এ ছাড়া পদ হারিয়েছেন আরো অনেক কর্মকর্তা। করোনা ভাইরাস নিয়ে এ পর্যন্ত এটাই সবচেয়ে বড় পদের কোনো কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেয়ার ঘটনা। সরিয়ে দেয়া হয়েছে রেডক্রসের উপ-পরিচালককে। তিনি দাতব্য কাজে ব্যবহারের দান পরিচালনায় কর্তব্যে অবহেলা করেছেন বলে এমন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি।
রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার মতে, হুবেই ও অন্যান্য প্রদেশে শত শত মানুষকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। কারো বিরুদ্ধে তদন্ত করা হয়েছে। কাউকে সতর্ক করা হয়েছে। এসবই করা হয়েছে এই মহামারি চলাকালীন। শুধু যে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে এমন নয়। একই সঙ্গে ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি থেকে তাদের শাস্তি দেয়া হয়েছে। এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন রেডক্রসের উপ-প্রধান ঝাং কিন। তাকে আন্তঃপার্টির তরফ থেকে সিরিয়াস সতর্কতা দেয়া হয়েছে। এ মাসের শুরুর দিকে উহানে পরিসংখ্যা ব্যুরোর উপ-প্রধানকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। মুখের মাস্ক বিতরণে সংশ্লিষ্ট বিধি লঙ্ঘনের জন্য তার বিরুদ্ধে গুরুত্বর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। উহানের হুয়াংগাংয়ের স্বাস্থ্য বিষয়ক কমিশনের প্রধানকেও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে করোনা ভাইরাস মোকাবিলা নিয়ে ক্রমবর্ধমান সমালোচনার মুখে রয়েছে চীন কর্তৃপক্ষ। যে চিকিৎসক প্রথম দিকে করোনা ভাইরাস ইস্যুতে সতর্কতা দিয়েছিলেন, কর্তৃপক্ষ তাকে চাপ প্রয়োগ করে নিষ্পেষণ করেছে। তার মৃত্যুতে জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
বিবিসির রিপোর্ট অনুযায়ী এখন চীনে আক্রান্তের সংখ্যা কমপক্ষে ৪২ হাজার ২০০। এর মধ্যে হুবেই প্রদেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৩১ হাজার ৭২৮। সেখানে মারা গেছেন কমপক্ষে ৯৭৪ জন। মোট মৃত্যুর তিন-চতুর্থাংশ মারা গেছেন হুবেইয়ের রাজধানী উহানে। এই উহান থেকেই করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি। এখানে বসবাস করেন এক কোটি ১০ লাখ মানুষ। কয়েক সপ্তাহ ধরে এই শহরটি অচল হয়ে ভৌতিক রূপ নিয়েছে। ওদিকে করোনা ভাইরাস নিয়ে চীনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাজ করতে সোমবার চীন পৌঁছেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি টিম। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ব্রুস অ্যালিওয়ার্ড। ২০১৪-১৬ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় যখন ইবোলা মহামারি দেখা দেয় তখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হয়ে সেখানে এ বিষয়টি দেখাশোনা করেন তিনি। ওদিকে দেশে এত বড় মহামারির প্রায় দুই মাস পরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সোমবার বেইজিংয়ের স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এসব কর্মকর্তা নতুন করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা দিচ্ছিলেন তখন। এ সময় তিনি স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে মুখে মুখোশ পরেছিলেন। সি জিনপিং বেইজিং সফরে গেলেও করোনা ভাইরাসের যে উৎপত্তিস্থল উহান, সেখানে এখন পর্যন্ত যাননি। বেইজিংয়ে সাক্ষাতের সময় তিনি এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান। বলেছেন, অবশ্যই আমরা এই মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিজয়ী হবো।