করোনাভাইরাস: চীনে কাঁকড়া রফতানি বন্ধ থাকায় বাগেরহাটের চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত

0

আলী আকবর টুটুল, বাগেরহাট ॥ করোনাভাইরাসের কারণে চীনে কাঁকড়া রফতানি বন্ধ রেখেছে সরকার। ফলে ভরা মৌসুমে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন বাগেরহাটের কাঁকড়া চাষিরা। এদিকে কাঁকড়া রফতানি বন্ধ থাকায় সরকার যেমন রাজস্ব হারাচ্ছে, তেমনি চাষি, ব্যবসায়ী ও রফতানিকারকরাও বিপুল পরিমান আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন। রফতানি নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকলে কাঁকড়া চাষ বন্ধ ছাড়া কোন উপায় থাকবে না জানিয়েছেন চাষিরা। তবে মৎস্য বিভাগ এ ব্যাপারে আতঙ্কিত না হয়ে ধৈর্য ধরার আহবান জানিয়েছে।
দক্ষিণাঞ্চলের বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায় কাঁকড়ার চাষ হয়ে থাকে। বাগেরহাটে সাধারণত শিলা জাতের কাঁকড়ার চাষ হয়। কম জমি ও অল্প সময়ে কাঁকড়া চাষ করা যায়। চিংড়ির তুলনায় কাঁকড়ায় রোগব্যাধিও কম। সব মিলিয়ে অন্যান্য মাছের থেকে কাঁকড়া চাষে ঝুঁকি কম হওয়ায় এক দশক ধরে বাগেরহাটে কয়েক হাজার চাষি এর সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন।
জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাগেরহাটের সাতটি উপজেলায় এক হাজার ৫ শ হেক্টর জমিতে ৩ হাজার ৭৭৮টি কাঁকড়ার খামার রয়েছে। গেল বছর ২ হাজার ৩২ মেট্রিক টন কাঁকড়া উৎপাদন হয়েছে এসব খামার থেকে। এছাড়া ৫ শ ৯৭ মেট্রিক টন কাঁকড়া প্রাকৃতিক উৎস্য থেকে আহরণ করেছেন জেলেরা। এ জেলা থেকে উৎপাদিত কাঁকড়ার ৮০ শতাংশ চীনে রফতানি করা হয়। প্রতিবছর ১৫ ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত সিংহভাগ কাঁকড়া রফতানি হয়ে থাকে। কিন্তু চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় ২৩ জানুয়ারি থেকে কাঁকড়া রফতানি বন্ধ রয়েছে চীনে। যার ফলে স্থানীয় ডিপো মালিকরা কাঁকড়া কেনা বন্ধ করে রেখেছেন। এদিকে খামারে বড় হয়ে যাওয়া পূর্ণবয়স্ক কাঁকড়াগুলো মারা গেলেও ধরতে পারছেন না চাষিরা। কারণ স্থানীয় বাজারে দামি কাঁকড়ার চাহিদা নেই বললেই চলে। তাই চোখের সামনে নিজের মূল্যবান সম্পদ মরে নষ্ট হলেও কিছুই করতে পারছেন না চাষিরা। এদিকে করোনাভাইরাসের কারণে ২৩ জানুয়ারির আগে কিনে রাখা কাঁকড়া মরে পচলেও বিক্রি করতে পারছেন না ডিপো মালিকরা। রফতানিকারকরাও রয়েছেন বিপদে।
কুন্তল ইজারাদার, পিনাক মজুমদার, আব্দুল আজিজসহ বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার কয়েকজন চাষি বলেন, ‘চীনের নববর্ষ উপলক্ষে কাঁকড়ার দাম অনেক বৃদ্ধি পায়। তাই আগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে কাঁকড়া কিনে খামারে মজুদ করেছিলাম। যখন বিক্রির উপযোগী হলো তখনই চীনে রফতানি বন্ধের কারণে ডিপো মালিক ও ব্যবসায়ীরা কাঁকড়া কেনা বন্ধ করে দিলেন। এখন পূর্ণবয়স্ক এই কাঁকড়া কী করব ভেবে পাচ্ছি না। এ অবস্থা চলতে থাকলে কাঁকড়া চাষ বন্ধ করে দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।’ চাষি রুবেল, আলমগীর, অনিমেশ মন্ডল জানান, ‘যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তাতে কাঁকড়া বিক্রি করে লাভ তো দূরে থাক, চালান বাঁচবে না। যে কাঁকড়া ৫শ টাকায় কিনে চাষ করা হয়েছে তা ২শ টাকার কম দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। ঘেরে থাকা পূর্ণবয়স্ক কাঁকড়া মরতে শুরু করেছে। ১৫ দিনের মধ্যে এসব কাঁকড়া বিক্রি না করতে পারলে সব মরে মাটির সাথে মিশে যাবে। ব্যাংক, এনজিও এবং স্থানীয়ভাবে ঋণ করে কাঁকড়া চাষ করি। এ অবস্থা থাকলে পুঁজি হারিয়ে পথে বসতে হবে।’ রামপাল থানা কাঁকড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক স্বপন মন্ডল বলেন, ‘চীনের নববর্ষকে কেন্দ্র করে প্রচুর পরিমান কাঁকড়া কেনা হয়েছিল। কিন্তু রফতানি বন্ধ হওয়ায় অনেক কাঁকড়া মারা যাচ্ছে। এভাবে চললে রামপালের চাষি ও ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে যাবে।’
বাংলাদেশ কাঁকড়া সরবরাহ সমিতির সাধারণ সম্পাদক অজয় দাস বলেন, ‘চীনসহ কয়েকটি দেশে কাঁকড়া রফতানি হয়। এরমধ্যে অধিকাংশ কাঁকড়া যায় চীনে। করোনাভাইরাসের কারণে রফতানি বন্ধ হওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়ছি আমরা। এ নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকলে বাগেরহাট জেলার কাঁকড়া চাষিদের ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হবে। যা এসব চাষি ও ব্যবসায়ী কোনদিন মেটাতে পারবেন না।’ তিনি চীনের বাইরে অন্যান্য দেশে কাঁকড়ার নতুন বাজার সৃষ্টি করে চাষিদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন। বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. খালেদ কনক বলেন, বাগেরহাটে উৎপাদিত কাঁকড়া চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, কোরিয়ায় রফতানি হয়। এর মধ্যে চীনেই রফতানি হয় ৮০ শতাংশ। হঠাৎ করে চীনে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে চাষি ও ব্যবসায়ীরা যেমন বিপাকে পড়েছেন, তেমনি সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা চাষিদের আতঙ্কিত না হয়ে ধৈর্য ধারণের পরামর্শ দিচ্ছি। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে নতুন বাজার সৃষ্টিরও বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে।’