করোনাভাইরাসের প্রভাবে যশোরে ব্যবসা-বাণিজ্যে অস্থিরতা

0

শেখ আব্দুল্লাহ হুসাইন ॥ চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ধাক্কা বাংলাদেশেও পড়েছে। বন্ধ হয়ে আছে সে দেশের পণ্য আমদানি। হুমকির মুখে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। ইতোমধ্যে দেশের বাজারে বিভিন্ন চীনা পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এমন অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে বাংলাদেশে বড় সংকট সৃষ্টি বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। সর্বশেষ সোমবার পর্যন্ত নভেল করোনাভাইরাসে চীনে মৃতের সংখ্য ৯শ ছাড়িয়েছে। চীনের বাইরে ২৫ টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এ ভাইরাস।
গত ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে মানুষের দেহে প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। পরবর্তীতে দেশটির অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়লে সে দেশের সরকার সতর্কতা হিসেবে রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল বন্ধ করে দেয়। একই সাথে অফিস-আদালত ব্যাংকসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। স্বাভাবিকভাবে চীনের সাথে সারা বিশে^র আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের নানামাত্রিক সম্পর্ক বিদ্যমান। ব্যবসাবাণিজ্য ও উন্নয়ন কাজে চীন ও বাংলাদেশের নিয়মিত বিনিময় রয়েছে। বর্তমানে চীন থেকে আমদানি-রফতানি বন্ধ থাকায় দেশে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। সারদেশের মত যশোরেও এর অশুভ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। চীনের সংকট সহসা উত্তরণ না হলে যশোরে চীনের তৈরি ইজিবাইক, যন্ত্রপাতি, হার্ডওয়্যার পণ্য, বিভিন্ন কেমিক্যাল, ফল ব্যবসায়ে অচিরেই ধস নেমে আসবে বলে ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন।
যশোরে নতুন উপশহরে ইজিবাইক আমদানিকারক কে.আর ডলফিনের মালিক কাজী রনি জানান, বর্তমানে চীনে এলসি (ঋণপত্র) খোলা বন্ধ আছে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে চীনে সরকারি অফিস, ব্যাংক সব বন্ধ। মজুত যন্ত্রপাতি কমে যাওয়ায় ইজিবাইক প্রতি ২ হাজার টাকা দাম বেড়েছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে সামনে আরও দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর চীনের বর্তমান সঙ্কট যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে ইজিবাইক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ইলেক্ট্রিক ট্রাইসাইকেল ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড স্পেয়ারপার্টস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের যশোর জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ও আমদানিকারক কাজী রনি আরও জানান, ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে আগের এলসি করা চীন থেকে আমদানি করা মালামাল চলে এসেছে, সেগুলো ছাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ব্যাংক বন্ধ থাকায় চীন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়তে পারছে না। বন্দর থেকে ছাড় করতে না পারায় কন্টেইনার প্রতি প্রতিদিন ৪ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে। তিনি জানান, প্রতিনিয়ত গরিব মানুষ স্বল্প মূল্যের আয়ের উৎস হিসেবে ইজিবাইক কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। আমদানি বন্ধ থাকায় যন্ত্রাংশের অনিশ্চয়তার আশঙ্কায় ইজিবাইক বিক্রি অনেক কমে গেছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আমরা চাই চীন সরকার দ্রুত এ সঙ্কট কাটিয়ে উঠুক। কারণ সারা দেশে ৬০ লাখ চীনের ইজিবাইক চলাচল করে। সেই সাথে ৬০ লাখ পরিবার এর ওপর নির্ভরশীল। ইজিবাইক আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে এসব মানুষ বেকার হয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে।
এদিকে, চীন থেকে আমদানি করা ফলের বাজারেও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ২০ কেজির আপেলের কার্টনে ৬ শ টাকা মত বেড়েছে। যশোরে ফলের পাইকারি আড়ত শহরের পুরাতন খুলনা বাস স্ট্যান্ডের শামীম এন্টারপ্রাইজে চায়না ফ্রেশ আপেল, ফুজি আপেল, গোল্ডেন আপেল, লাল আঙ্গুর, নাশপাতি ও লেবু বিক্রি করতে দেখা গেছে। সোমবার চায়না ‘ফ্রেশ আপেল’ (২০ কেজি) কার্টন বিক্রি হয়েছে ২২শ থেকে ২৩শ টাকা, যা গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছে ১৬ শ থেকে ১৭ শ টাকা।
ফল আমদানিকারক শহরের পুরাতন খুলনা বাস স্ট্যান্ডের মেসার্স বাপ্পী এন্টারপ্রাইজের মালিক হাজি বদিউজ্জামান সোমবার জানান, এখন চীনে আপেলের মৌসুম। ভারতে এ সময় আপেল হয় না। ভারতে এখন আঙ্গুর ও কমলালেবুর সিজন। এখনও চীনের মজুত আপেল বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আমদানি যদি এভাবে দীর্ঘমেয়াদে বন্ধ থাকে তাহলে বাজারে দাম বাড়ার পরেও এক সময় আর আপেল পাওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে ভারতের আপেলের জন্য অন্তত দু মাস অপেক্ষা করতে হবে।
যশোর বড় বাজারের জর্দাপট্টির ব্যবসায়ীরা জানালেন, আমদানি বন্ধ থাকায় চায়না স্যাকারিন ও ম্যানথলের দাম প্রচুর বেড়ে গেছে। এসব পণ্য জর্দা তৈরিতে ব্যবহার হয়। জর্দা ব্যবসায়ী ডালিম চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম, পানশাহী রাজু, প্রভাত কুমার জানান, এক সপ্তাহের ব্যবধানে এসব কেমিকেলের দাম অস্বাভাবিকহারে বেড়েছে। তারা জানান, ১০০ পাউন্ড স্যাকারিন কিনতে হয়েছে ৪৮ হাজার টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ২৮ হ্জাার টাকা। ২৫ কেজির এক ড্রাম ম্যানথল কিনেছেন ৮৫ হাজার টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ৬৮ হাজার টাকা। ডালিম চৌধুরী জানান, চায়না থেকে আমদানি বন্ধ থাকায় মজুতকৃত এসব পণ্যের দাম আমদানিকারক ও পাইকারি বিক্রেতারা বাড়িয়ে দিয়েছেন।
শিশুদের খেলনা সামগ্রীর আমদানিকারক শহরের হাজি আব্দুল করিম রোড চুড়িপট্টির খেলনা ঘরের মালিক মো. তবিবুর রহমান রুমু জানান, চীন থেকে আমদানি বন্ধ থাকায় খেলনার দামও বেড়ে গেছে। ঢাকা থেকে পাইকারি বাজারে খেলনা প্রতি ১শ থেকে দেড় শ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। বড় বাজার গোহাটা রোডের হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী সন্ধ্যা হার্ডওয়্যার স্টোরের মালিক নন্দলাল সাহা জানান, বাজারে চায়না স্ক্রু-ড্রাইভার, ছিটকিনি, তালা ও কব্জার চাহিদা বেশি। আমদানি বন্ধ থাকায় এসব পণ্যের দামও বেড়েছে। উল্লেখ্য, ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথমে মানুষের শরীরে নভেল করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এর পরই দ্রুত সে দেশের বিভিন্ন শহরে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত হতে থাকে। সোমবার চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা জানায়, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সে দেশে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৯ শ ছাড়িয়েছে। আর আক্রান্ত হয়েছে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ। চীনের বাইরেও ২৫ টির বেশি দেশে এ ভাইরাস ছড়িয়েছে।