শেখ হাসিনা মেডিকেলে দুর্নীতি : ছয় চিকিৎসককে দুদকে জিজ্ঞাসাবাদ

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ে অনিয়মের অভিযোগে চিকিৎসকসহ ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল সকাল ১০টা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দুদক জানায়, কেনাকাটার নামে সাড়ে ১৫ কোটি টাকার লুটপাটের অভিযোগ ওঠে হাসপাতালটির অধ্যক্ষ ডা. আবু সুফিয়ানসহ আটজনের বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে ৬জনকে দুদকের তলবের প্রেক্ষিতে গতকাল জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
দুদকের উপপরিচালক শামছুল আলমের নেতৃত্বে একটি দল তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এই ছয় জন হলেন- হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. মো. শাহিন ভূঁইয়া, প্রভাষক পংকজ কান্তি গোস্বামী, বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাক্তার মো. জাহাঙ্গীর খান ও ডা. কুদ্দুস মিয়া, এনাটমি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. প্রাণ কৃষ্ণ বসাক এবং পরিবার পরিকল্পনার উপ-পরিচালক ডা. নাসিমা খানম ইভা। অনুসন্ধান দলের প্রধান জানান, আজ সোমবার শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ ডা. আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সমপ্রতি হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজের বইপত্র ও মালামাল ক্রয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।
এ বিষয়ে গত বছরের ২৪শে নভেম্বর দৈনিক মানবজমিনে প্রথম অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সে অনুসন্ধান বলছে, কলেজটির ২০১৭-১৮ অর্থবছরের একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বইপত্র, সাময়িকী, যন্ত্রপাতি অন্যান্য সরঞ্জমাদি ক্রয়ে প্রকৃত প্রস্তুতকারী, ঠিকাদার, ব্যবসায়ী এবং সরবরাহকারীদের কাছ থেকে দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০১৮ সালের সূচনাতে। ওই বছরের ১৭ই মে প্রয়োজনীয় পণ্যের শিডিউল দাখিল করতে বলা হয়। একই সঙ্গে অধ্যক্ষ (চলতি দায়িত্ব) ডা. মো. আবু সুফিয়ান স্বাক্ষরিত আদেশে বাজার দর মূল্যায়ন এবং টেন্ডার সংক্রান্ত বিষয়ে যাবতীয় পর্যালোচনায় ৩ জন প্রভাষককে দিয়ে একটি কমিটি করা হয়। যার সভাপতি করা হয় ফিজিওলজি বিভাগের প্রভাষক ডা. মো. শাহীন ভূঁইয়াকে। সদস্য ছিলেন বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের প্রভাষক ডা. কুদ্দুস মিয়া এবং ফিজিওলজি বিভাগের প্রভাষক পংকজ কান্তি গোস্বামী। পংকজ গোস্বামীকে কমিটির সদস্য সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু দরপত্র মূল্যায়ন রিপোর্টে ওই কমিটির সদস্যদের কোনো সই ছিল না। কমিটিতে রাখা চিকিৎসকদের দাবি তাদের না জানিয়েই অধ্যক্ষ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই অর্থ বছরে হাসপাতালের মালামাল কেনা বাবদ বরাদ্দ ছিল ১৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। সে মতে টেন্ডার আহ্বান করা হয়। বইপত্র ও মালামাল কেনা হয় ১৫ কোটি ৪৯ লাখ ৭৮ হাজার ৮শ ৫৭ টাকার। ভ্যাট ও আয়কর খাতে সরকারি কোষাগারে জমা হয় ১ কোটি ৬১ লাখ টাকা ৯৭ হাজার ৭শ’ ৪৮ টাকা। ১৩ কোটি ৮৭ লাখ ৮১ হাজার ১শ’ ৯ টাকা মালামাল ক্রয় বাবত ব্যয় দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে ওই মালামালের মূল্য ৫ কোটি টাকার বেশি নয়- এমনটাই বলছে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র। বাকি টাকার পুরোটাই ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে। সূত্র মতে, দরপত্রে মোট ৭টি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এরমধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে উপযুক্ত দরদাতা (রেসপনসিভ) হিসেবে গ্রহণ করে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি। সেখানে বইপত্র ও সাময়িকীর জন্য ৪ কোটি ৫০ লাখ, যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য সরঞ্জামের জন্য ৫ কোটি, কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশের জন্য ১ কোটি ৫০ লাখ, আসবাবপত্রের জন্য ১ কোটি টাকা, এমএসআর’র (মেডিকেল এন্ড সার্জিকেল রিকোয়্যারমেন্ট) জন্য ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা ধরা হয় (ভ্যাট আয়কর সহ) মালামাল কেনা বাবত। মূল্যায়ন কমিটির সিদ্ধান্ত মতে, ঢাকার শ্যামলী এলাকার বিশ্বাস কুঞ্জছোঁয়া ভবনের ‘নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ’ নামক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি মালামাল সরবরাহ করে। প্রতিষ্ঠানটি বইপত্র, যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার, আসবাবপত্র, মেডিকেল ও ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে বিল নিয়েছে ৯ কোটি ৩৭ লাখ ৮৭ হাজার ৪শ’ ৯ টাকা। সরবরাহকৃত মালামালের মধ্যে ৬৭টি লেনেভো ল্যাপটপের (মডেল ১১০ কোর আই ফাইভ, কিঙ জেনারেশন) মূল্য নেয়া হয় ৯৯ লাখ ৪৯ হাজার ৫শ’ টাকা। প্রতিটি মূল্য পড়েছে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫শ’ টাকা। ঢাকার কম্পিউটার সামগ্রী বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ফ্লোরায় একই মডেলের ল্যাপটপ বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৪২ হাজার টাকায়। ৬০ হাজার টাকা মূল্যের এইচপি কালার প্রিন্টার (মডেল জেড প্রো এম ৪৫২এন ডব্লিউ)-এর দাম নেয়া হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৯শ’ টাকা। ৫০ জন বসার জন্য কনফারেন্স টেবিল, এক্সিকিউটিভ চেয়ার ও সাউন্ড সিস্টেমে ব্যয় হয়েছে ৬১ লাখ ২৯ হাজার টাকা। জনপ্রতি চেয়ার-টেবিল ও সাউন্ড সিস্টেমের ব্যয় পড়েছে ১ লাখ ২২ হাজার ৪শ’ টাকা। চেয়ারগুলোতে ‘ইয়ামিন ফার্নিচার’ লেখা থাকলেও টেবিলগুলো কোন প্রতিষ্ঠানের এর কোনো স্টিকার লাগানো নেই। দেশের নামিদামি ফার্নিচার প্রতিষ্ঠান হাতিল ও রিগ্যালে এসব চেয়ারের মূল্য ওই দামের অর্ধেকের চেয়েও কম। এছাড়া বিলের ৬ নম্বরে আবারো কনফারেন্স সিস্টেম নামে ৫০ জনের জন্য (জনপ্রতি ২১ হাজার ৯শ’ টাকা) ১০ লাখ ৯৯ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে। অত্যন্ত সাধারণ মানের ১৫টি বুক সেলফের মূল্য ৬ লাখ ৬০ হাজার, ৫টি স্টিলের আলমিরা ২ লাখ ৮৫ হাজার, ১০টি স্টিলের ফাইল কেবিনেট ৪ হাজার ২২ হাজার, ২৫টি স্টিলের র‌্যাক ১৩ লাখ ৯৭ হাজার টাকা বিল দেয়া হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটি ৬৪৭৫টি বইয়ের জন্য নিয়েছে ৪ কোটি ৪৯ লাখ ৮ হাজার ৬শ’ ৬৪ টাকা। শুধু তাই নয়। মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ১০৪টি প্লাস্টিকের মডেলের মূল্য ১ কোটি ১৪ লাখ ৮৬ হাজার ৩১৩ টাকা নিয়েছে। দেশের বাজারে ‘পেডিয়াটিক সার্জারি’ (২ ভলিয়মের সেট) বইটির দাম ৩৩ হাজার টাকা। নির্ঝরা এন্টারপ্রাইজ দাম নিয়েছে ৭০ হাজার ৫শ’ ৫০ টাকা। রাজধানীর মতিঝিলের মঞ্জুরি ভবনের পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামে আরেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা দরে ৮১টি কার্লজিস প্রিমো স্টার বাইনোকুলার মাইক্রোস্কোপ সরবরাহ করেছে। যার মূল্য নিয়েছে ২ কোটি ৬৩ লাখ ৩শ’ ২৫ টাকা। বাজারে এর মূল্য ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩শ’ টাকা। পুনম ইন্টারন্যাশনাল একই কোম্পানি ও মডেলের এসি’র দাম ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা দরে ৩১টির মূল্য নিয়েছে ৬১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। ওয়ালটনের যে মডেলের ফ্রিজ ৩৯ হাজার ৩শ’ ৯০ টাকা, একই কোম্পানি ও মডেলের ফ্রিজের মূল্য গুনতে হয়েছে ৮৫ হাজার টাকা। এ রকম ৬টি ফ্রিজ কেনা হয়। ল্যাবরেটরিতে ব্যবহারের জন্য ডিজিটাল ওয়েইং (ওজন মাপার যন্ত্র) মেশিন ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা দাম নেয়া হয়েছে। যার বাজার মূল্য ৪০ হাজার টাকা। এছাড়া মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ছবি সংবলিত কাগজে ছাপা চার্ট বাজারে ১শ’ থেকে ৫শ’ টাকায় পাওয়া গেলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রতিটি চার্ট কিনেছে ৭ হাজার ৮শ’ টাকা দরে। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত ইচ্ছায় ২০১৫ সালের ১লা জানুয়ারি হবিগঞ্জ শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজটি অনুমোদন লাভ করে। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ৫১ জন শিক্ষার্থী ভর্তির মাধ্যমে কলেজটির আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।