চীন ফেরত শিক্ষার্থীদের বয়ানে করোনার ভয়াবহতা

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ মরণ ভাইরাস করোনায় কাঁপছে চীন। আতঙ্ক পুরো বিশ্বজুড়ে। করোনা ছড়িয়ে পড়া চীনে আছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও গবেষক। তারা সেখানকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করছেন। করোনা ছড়িয়ে পড়ায় তাদের অনেকে দেশে ফিরে আসছেন। যারা এখনও সেখানে আছেন তারা দেশে ফেরার চেষ্টা করছেন। গতকালও এমন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী দেশে ফিরেছেন ইউনান থেকে। চায়না ইস্টার্নের একটি ফ্লাইটে দুপুরে তারা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান। বিমানবন্দরেই কথা হয় তাদের কয়েকজনের সঙ্গে। চীন ফেরত এসব শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, পুরো চীন জুড়েই এখন করোনা আতঙ্ক। রাস্তাঘাটে মানুষ বের হচ্ছে না প্রয়োজন ছাড়া। বিদেশি শিক্ষার্থীদের রাখা হয়েছে ডরমেটরিতে। বের হতে দেয়া হয় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। পানি, খাবারসহ নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। চীনা কর্তৃপক্ষ নিয়মিত যোগাযোগ রাখলেও অনেকটা বন্দি অবস্থায় থাকতে হয়। সঙ্গে আছে করোনার বিস্তৃতি বাড়ার আতঙ্ক। এ কারণে তারা সুযোগ করে চলে এসেছেন দেশে।
নড়াইলের বাসিন্দা মো. জুয়েল শেখ। লেখাপড়া করেন চীনের কুনমিং সিটির ইউনান ইউনিভার্সিটিতে। চীনে করোনা ভাইরাসের ভয়াবহত বেড়ে যাওয়ায় তিনি গতকাল চায়না ইষ্টার্ন ফ্লাইটে ঢাকায় এসেছেন। বিমানবন্দরে তিনি মানবজমিনকে বলেন, তিনি যে অঞ্চল থেকে ফিরেছেন সেখানকার সবগুলো মার্কেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও ২/১ টি বড় সুপার শপ খোলা রাখা হয়েছে। যানবাহন পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে ট্যাক্সি নিয়ে বের হওয়া যায়। এছাড়া অন্যান্য দেশের সঙ্গে চীনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আগে প্রতিদিন যেরকম ফ্লাইট চীন থেকে বাংলাদেশে আসতো। এখন সেরকম আসে না। সপ্তাহে তিনটি আসে। চীনে এত জনসংখ্যা অথচ এখন ঘরের বাইরে গেলে মানুষের দেখা মেলে না। আমি যে প্রদেশে ছিলাম সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা কম। কিন্তু কড়া সতর্কতা। আমাদের এখানে বড় বড় ২/১টা মার্কেট খোলা থাকে। ডরমেটরি থেকে আমাদের ৪০/৪৫ মিনিট করে সময় দেয়া হচ্ছে। এই সময়ের ভেতরে বাজার করে নিয়ে আসতে হয়। তাদের বেধে দেয়া সময় অতিক্রম করলে আর ঢুকতে দেয়া হয় না। আর ঢুকতে দেয়া হলে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, নতুন বছর উপলক্ষে ছুটি পেয়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম তালি লিচিয়ান সিটিতে। বন্ধুর বাসায় ঘুরতে গিয়ে আমিও আটকা পড়েছিলাম। যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। পরে অনেক কষ্ট করে মেট্রোরেলে কুনমিং সিটিতে ফিরে এসেছি। দেশে ফেরার কোনো চিন্তা ছিল না। তবে ক্রমেই আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়ছে, মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। আর পরিবারের লোকজনের চাপে বাধ্য হয়ে নিজে থেকেই ফিরে এসেছি।
বাড্ডার ওয়ালিউল্লাহ। থাকেন ইউনানে। পিএইচডি করছেন কুনমিং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিতে। করোনা ভাইরাস আতঙ্কে গতকাল ফিরে এসেছেন দেশে। বিমানবন্দরে জানালেন চীনের বর্তমান পরিস্থিতিতির নানা তথ্য। তিনি বলেন, আমি যে এলাকায় থাকতাম ওই এলাকায় ১৩৭ জনের মত চীনা নাগরিক আক্রান্ত হয়েছেন। সুস্থ হয়েছেন সাতজন। বিদেশি কেউ আক্রান্ত হওয়ার খবর পাইনি। এখানে ৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশী ৭০০ জন শিক্ষার্থী পড়ালেখা করেন। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে ৬০০ জনের মত দেশে ফিরে এসেছেন। সেখানে খুব সতর্কতার মধ্যে থাকতে হয়। দিনে দুইবার করে বের হওয়ার অনুমতি দেয়া হত। এখন সেটি কমিয়ে একবার করা হয়েছে। এক ঘণ্টার জন্য বের হতে দেয়া হয়। বাজার করার জন্য যাতে বাইরে যেতে না হয় সেজন্য বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যাণ্টিন খুলে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দুই দিন আগে বাইরে না যাওয়ার জন্য তারা একটা নোটিশ দিয়ে অনুরোধ করেছে। কারণ এটি অনেক বেশি ছড়িয়ে গেছে। বড় সুপারশপ ও মেডিসিনের দোকান শুধু খোলা আছে। যানবাহনের মধ্যে প্রাইভেট গাড়ি ও রাইড শেয়ারিং কোম্পানির কিছু বাইক চলছে। অ্যাপসে কল করলে তারা বাসায় চলে আসে। তবে পাবলিক সার্ভিসগুলো পুরোপুরি বন্ধ। মেট্রোরেলও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সতর্কতার জন্য রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল খুব কম। নতুন করে নিয়ম করে দেয়া হয়েছে আবাসিক এলাকাগুলো থেকে কোনদিন কতজন বের হতে পারবে। হসপিটাল ও জনবহুল এলাকাগুলো এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, তারা বিদেশিদের খুব বেশি খোঁজ খবর নিচ্ছে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের যারা দেখাশুনা করেন তারা প্রত্যেকদিন দুইবার করে শরীরের তাপমাত্রা মেপে যান। কখনও আমরা যাই আবার কখনও তারা আমাদের রুমে এসে পরীক্ষা করেন। সুস্থ্য আছি বলে প্রত্যেকদিন আমাদেরকে দুইবার স্বাক্ষর দিতে হয়। আমরা রুমের মধ্যে আছি না বাইরে আছি সে খবর নেয়া হয়। প্রতিদিনের খাবার, পানি আছে কিনা জানতে চাওয়া হয়। এছাড়া চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম উইচ্যাটে আলাদা আলাদা গ্রুপ করে দেয়া হয়েছে। কিছু গ্রুপে শুধু বিদেশী শিক্ষার্থীরা আছে। ফিভার নামে একটি গ্রুপ আছে যেখানে চিকিৎসকরা আছেন। সবমিলিয়ে চিকিৎসকরা ২৪ ঘণ্টা সার্ভিস দিচ্ছেন। তিনি বলেন, তারা বিদেশিদের অসাধারণ কেয়ার নিচ্ছেন। ছুটির জন্য পানি বন্ধ ছিল। আমাদের যেন বাইরে থেকে পানি কিনতে না হয় সেজন্য তারা অফিসে পানি স্টক করে রেখেছে। পানি শেষ হলে নিজেরা নিচতলায় গিয়ে নিয়ে আসতে হয়। ওয়ালিউল্লাহ বলেন, চীন থেকে যারা থাইল্যান্ড ও কুয়ালালামপুর হয়ে বাংলাদেশে আসতে চান তাদের ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। কুনমিং থেকে বাংলাদেশের ফ্লাইট চালু ছিল। সেটি শনিবার শেষ। এই রুটে আগামী ২৯ তারিখে ফ্লাইট আছে। তার আগের সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। একই ফ্লাইটের যাত্রী ঢাকার বাড্ডার হায়দার উল্লাহ বলেন, আমি কুনমিং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিতে মাস্টার্স করছি। প্রায় আড়াই বছর ধরে আমি সেখানে আছি। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে চীন সরকার প্রতিদিন সকাল, বিকাল ও রাতে জীবাণুনাশক ওষুধ দিয়ে পুরো সিটি পরিষ্কার করছে। প্রতিটা বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা চেকআপ করছে কেউ আক্রান্ত হয়েছে কিনা। আমার ফিরে আসার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ভাইরাসের কারণে ফিরে এসেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়েছে। কবে খুলবে তার কোনো ঠিক নাই। পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার নাই। সুপার শপে গেলে আজকে চাল পাওয়া গেলে কালকে পাওয়া যাচ্ছে না। পরের দিন আবার পাওয়া যাচ্ছে। আগে সবকিছু রিজার্ভ থাকতো। এখন রিজার্ভ বলতে কিছু নাই। গত এক সপ্তাহ ধরে আমি কোনো মাছ খোঁজে পাইনি। তিনি বলেন, বলতে গেলে আমরা সেখানে জেলখানায় বন্দি ছিলাম। চাইলেই বের হওয়া যায় না। আর সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করতে হয়। ১টা মাস্ক বেশি ব্যবহার করা যায় না। তবে মাস্কের দাম স্বাভাবিক আছে। কিন্তু মাস্ক খোঁজে পাওয়া যায় না। সব স্টক শেষ হয়ে গেছে তাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাদের জন্য মাস্কের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
উজ্জল হোসেন নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, কুনমিং শহরে এতটা আতঙ্ক ছিল না। কয়েকদিন ধরে আতঙ্কটা বেড়ে গেছে। আমাদের ভার্সিটি থেকে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া বের হতে দেয় না। খাবারের সংকট আছে। কারণ কেন্টিন সবসময় খোলা থাকে না আবার বাইরে গিয়ে খাবার পাওয়া যায় না। অনেক সময় ৭/৮ কিলোমিটার হেঁটে গিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। নড়াইলের আবু মূসা জানান, ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা ভাষা ও কালচারের ওপর সাড়ে তিন বছর ধরে লেখাপড়া করছেন। মূলত আতঙ্কের কারণেই দেশে ফিরে এসেছেন। দিনে দিনে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েই শুধু শতাধিক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আছে। তিনি বলেন, ঢাকা বিমানবন্দরে আসার পর আমাদের কয়েকটি ফরম পুরণ করতে হয়েছে। এছাড়া কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখেছে শরীরে জ্বর বা কাশি আছে কিনা। তিনি বলেন, চীনে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা আতঙ্কের কারণে দেশে ফিরে আসছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসত্রে জানা গেছে, গত মাসের ২১ তারিখ থেকে দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও ২টি সমুদ্রবন্দর দিয়ে আগত যাত্রীদের স্ক্রিনিং করা হচ্ছে। তথ্যমতে গত ১৯ দিনে বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরগুলোতে ৭৪ হাজার ৯১১ জন যাত্রীকে স্ক্রিনিং করা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৬ হাজার ২৩ যাত্রীকে স্ক্রিনিং করা হয়। এরমধ্যে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৯ হাজার ১৩২ জন যাত্রীকে স্ক্রিনিং করা হয়েছে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর, মংলা সমুদ্রবন্দর ধরে ২৪ ঘণ্টায় স্ক্রিনিং করা হয়েছে ১০৮ জন যাত্রীকে। দেশের অন্যান্য স্থল বন্দরগুলোতে ৬ হাজার ৮৯১ জন যাত্রীকে স্ত্রিনিং করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে টিকে-৭১২ তার্কিশ এয়ার লাইন্সের একটি ফ্লাইটে ইস্তাম্বুল থেকে আসা যাত্রী ঢাকার কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা রিফাত হোসেন বলেন, বিমান থেকে নামার পরে আমাদেরকে স্ক্রিনিং মেশিনে পরীক্ষা করা হয়েছে। আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করেছেন শরীরে জ্বর বা কাশি আছে কিনা। একই ফ্লাইটে ইতালি থেকে আসা যাত্রী জাকারিয়া বলেন, যাত্রীদের পরীক্ষা করা হচ্ছে। আমাকে পরীক্ষা করতে চেয়েছিলো কিন্তু আমি বলেছি আমার কোনো সমস্যা নাই। তবে দিল্লি থেকে আসা একটি ফ্লাইটের যাত্রী ইমরান হোসেন দাবি করেন তাদের ফ্লাইটে আসা কোনো যাত্রীকে পরীক্ষা করা হয়নি। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের পরিচালক এ এইচ এম তৌহিদ-উল আহসান মানবজমিনকে বলেন, ২১শে জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ৭ হাজার ৫৫৬ জন যাত্রী চীন থেকে দেশে এসেছেন। তাদের প্রত্যেককে স্ক্রিনিং করে ছাড়া হয়েছে। এবং এই স্ক্রিনিং মেশিনের পাশেই একটি মনিটরিং সেল বসানো হয়েছে। যদি কারো শরীরের তাপমাত্রা ১০০ ওপরে হয় তাহলে তাকে পরীক্ষা কেন্দ্রের ভেতরে রেখে পর্যবেক্ষণ করা হয়।