‘মানবাধিকার পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেগজনক ছিল’

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ গত বছর মানবাধিকার পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেগজনক ছিল বলে মন্তব্য করেছে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার। গতকাল প্রকাশিত ২০১৯ সালের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে এই মন্তব্য করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, বাক্‌ স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের অধিকার হরণ, গুম, বিচারবর্হিভূত হত্যা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, অনিয়ম-দুর্নীতি এবং জীবনের অধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করার বিষয়গুলো আলোকপাত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত প্রকাশ করা হয়েছে অধিকারের এই প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘বিতর্কিত ও প্রহসনমূলক’ উল্লেখ করে বলা হয়েছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর মানবাধিকার লঙ্ঘন, দলীয়করণ ও দুর্বৃত্তায়ন ব্যাপক আকার ধারণ করে। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো একইভাবে সরকার নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর প্রহসনমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে। নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্সে ভরে রাখা, জাল ভোট দেয়া, প্রকাশ্যে ক্ষমতাসীনদলের প্রার্থীকে ভোট দিতে ভোটারদের বাধ্য করা, কেন্দ্র দখল ও বিরোধীদল মনোনীত প্রার্থীর এজেন্টদের আটক ও বের করে দেয়া এবং ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। এভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার ফলে জনগণ নির্বাচনবিমূখ হয়ে পড়েছে। ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনগণ ভোট বর্জন করায় অধিকাংশ ভোটকেন্দ্রই ছিল ভোটার শূন্য। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ জাতিসংঘের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তিতে (আইসিসিপিআর) অনুস্বাক্ষর করলেও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থাকে অকার্যকর করার মধ্যে দিয়ে তা লঙ্ঘন করা হচ্ছে।
কে এম নূরুল হুদা’র নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদলের পক্ষে ব্যাপক পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করার মধ্যে দিয়ে অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর দলীয় নেতাকর্মীদের অনুকূলে অনেকগুলো ব্যাংকের লাইসেন্স দেয় এবং বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ত করে। ফলে, সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক নামে একটি প্রাইভেট কোম্পানী কয়েক হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বেসিক ব্যাংক, ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর সঙ্গে সরকারের উচ্চ মহলের সখ্যতার কারণে বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির মামলায় এখনও তাঁকে আসামী করেনি দুর্নীতি দমন কমিশন। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে দুর্নীতির ধারাবাহিকতা বিগত বছরগুলোর মতোই বজায় ছিল বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। উন্নয়নে নামে ব্যাপক লুটপাট, অবৈধ ব্যবসা, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, শেয়ার মার্কেট কারসাজি, বিদেশে টাকা পাচার এবং ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যাপক লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে ক্ষমতাসীনদলের বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সাত মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) এর বাজার মূলধন ৬৫ হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে দেশে কোটিপতির তালিকায় প্রতি বছর গড়ে সাড়ে পাঁচ হাজার ব্যক্তি নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন। ২০১৯ সালের মার্চ মাস শেষে ব্যাংক খাতে কোটিপতি আমানতকারী সংখ্যা ৭৬ হাজার ২৮৬ জন। ২০০৯ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ব্যাংক খাতে আমানতকারী ছিলেন ১৯ হাজার ৬৩৬ জন। এই হিসেবে গত ১০ বছরে ৫৬ হাজার ৬৫০ ব্যক্তি নতুন করে কোটিপতির তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি হওয়ায় ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অসমতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এছাড়া প্রতি বছর দেশ থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে।
সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) বাংলাদেশীদের অর্থ জমার পরিমান বছরের পর বছর বাড়ছে। ২০০৯ সালে জমার পরিমাণ ছিল ১৪ কোটি ৯০ লাখ সুইস ফ্র্যাংক তা ২০১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৬১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্র্যাংক, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৫ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর মাসে অবৈধভাবে ক্যাসিনো চালানোসহ বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে আওয়ামী যুবলীগের ঢাকা দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট, সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ ভূঁইয়া, কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায় বিষয়ক সম্পাদক জি কে শামিমসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহিউদ্দিন খান আলমগীরের মালিকাধীন ফারমার্স ব্যাংক, যা বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক নামে পরিচিত এবং জনতা ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকে ব্যাপক দুর্নীতি ও ঋণ কেলেঙ্কারি মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। প্রতিবেদনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতনের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রদান করা হয়েছে। অধিকারের এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছর ব্যাপকভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, সভা-সমাবেশে বাধাসহ বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এই সময়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের বিরুদ্ধে নাগরিকদের গ্রেপ্তার, হয়রানি, চাঁদা আদায় ও তাদের ওপর নির্যাতন করার ব্যাপক অভিযোগ পাওয়া যায়।
সরকার ২০১৮ সালের ১৫ই মে থেকে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করার পর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ব্যাপক আকার ধারণ করে, যা অব্যাহত ছিল ২০১৯ সালেও। এই অভিযানের নামে অনেক নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা হয়েছে। ‘ক্রসফায়ারের’ ভয় দেখিয়ে বা মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে টাকা আদায় করা এবং সাজানো বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। বাংলাদেশী নাগরিকদের পাশাপাশি মিয়ানমারে গণহত্যার শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে। অধিকার এর তথ্যানুযায়ী গত বছরে ৩৯১ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার ৩৯১ জনের মধ্যে ৩৭৬ জন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। এছাড়া ছয় জন পুলিশের নির্যাতনে মারা গেছেন। এই সময়ে আট জন গুলিতে ও একজন পুলিশের পিটুনিতে নিহত হয়েছেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমে যাওয়ায় অপরাধী সন্দেহে পুলিশে সোপর্দ না করে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালে গণপিটুনি দিয়ে ৫৬ জনকে হত্যা করা হয়। গত বছরে সরকার বিরোধীদল ও ভিন্নমতাবলম্বীদের সভা-সমাবেশ করার অধিকার লঙ্ঘন করেছে। বিরোধী রাজনৈতিকদলের মিছিল সমাবেশে পুলিশ এবং ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা হামলা করেছে। সরকার বিরোধীদলের সভা-সমাবেশ করার ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের জোটভুক্ত রাজনৈতিকদলগুলো অবলীলায় সভা-সমাবেশ করছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করেছে এবং তা প্রয়োগ করে নাগরিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘন করেছে। সরকার ও ক্ষমতাসীনদলের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি বা দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখা বা কোন পোস্টে ‘লাইক-শেয়ার’ দেয়ার কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করেছে । গত বছরে ৪২ জনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এবং ছয় জনকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে গ্রেপ্তার করা হয়। গত বছরে নজিরবিহীনভাবে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে এবং শিশুদের ওপর সহিংসতা মারাত্মক আকার ধারণ করে। এই সময়ে রাজনৈতিক কারণে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিরোধীদলের কর্মীর স্ত্রীকে গণধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া পুলিশ হেফাজতেও ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে।
২০১৯ সালে মোট ১০৮০ জন নারী ও মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। তাদের মধ্যে ৩৩০ নারী, ৭৩৭ মেয়ে শিশু এবং ১৩ জনের বয়স জানা যায়নি। ৩৩০ জন নারীর মধ্যে ১০ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, ১৫০ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং দুই নারী আত্মহত্যা করেছেন। ৭৩৭ মেয়ে শিশুর মধ্যে ৩২ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, ১৩৭ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ৫ জন মেয়ে শিশু আত্মহত্যা করেছেন। গত বছরে ১৪৯ নারী ও মেয়ে শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। গত বছরেও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)’র বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা, অপহরণ ও নির্যাতনের ঘটনা অব্যাহত ছিল। অধিকার এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে বিএসএফ’র হাতে ৪১ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। এই সময়ে ৪০ জন বাংলাদেশী বিএসএফ কর্তৃক আহত হয়েছেন। এছাড়াও ৩৪ জন বাংলাদেশিকে বিএসএফ ধরে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু বিএসএফ কর্তৃক হত্যা এবং নির্যাতনের কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি বলে জানিয়েছে অধিকার।