চীনে করোনা ভাইরাস : আক্রান্তের সংখ্যা ৩১০০০ ছাড়ালো

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ এক মাসের কিছুটা বেশি সময়। এর মাঝে পুরো বিশ্বের পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে করোনা ভাইরাস। চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। কেবল চীনেই মৃতের সংখ্যা ৬৩২ জনে পৌঁছেছে। আক্রান্ত হয়েছেন ৩১ হাজারের বেশি। চীনের বাইরেও মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। সামপ্রতিক দিনগুলোয় প্রতিদিন গড়ে ৬০ জনের মতো করে মারা যাচ্ছেন। ভাইরাস মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে চীন।
অচল হয়ে পড়েছে দেশটির বাণিজ্য ব্যবস্থা। এর প্রভাব পড়ছে পুরো বিশ্ব বাণিজ্যে। দেশে দেশে চীনের বিরুদ্ধে জারি হয়েছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা। সেখান ফ্লাইট বাতিল করে দিয়েছে কয়েক ডজন এয়ারলাইন্স। প্রতিবেশী দেশ ও চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলগুলো মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। সড়ক ও রেল যোগাযোগও বন্ধ হয়েছে। দৃশ্যত ভাইরাস মোকাবিলায় একঘরে হয়ে পড়েছে চীন। এ অবস্থায় ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল উহানে আরো কঠোর ব্যবস্থা আরোপ করছে কর্তৃপক্ষ। ভাইরাসের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি এই শহরটিতেই দেখা গেছে। ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের শহরটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে চীনের বাকি অংশ থেকে। ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে আগ থেকেই নানা বিধি-নিষেধ জারি করে রেখেছিল কর্তৃপক্ষ। নতুন করে বৃহসপতিবার তা আরো কঠোর করা হয়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভাইরাস আক্রান্তদের খুঁজে বের করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রতি বাড়িতে তল্লাশি চালানো হবে। অসুস্থদের নিয়ে যাওয়া হবে পৃথক্‌করণ কেন্দ্রে।
করোনা ভাইরাসের এত দ্রুত সংক্রমণের জন্য আংশিকভাবে দায়ী চীন সরকার। প্রাথমিক পর্যায়ে ভাইরাসটি নিয়ে তথ্য ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছিল স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। সমপ্রতি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, প্রাথমিকভাবে ভাইরাসটির ভয়াবহতা সমপর্কে জনগণকে জানায়নি উহান কর্তৃপক্ষ। উল্টো মিথ্যা তথ্য দেয়া হয়েছে। কেউ তথ্য প্রকাশ করলে তাকে শিকার হতে হয়েছে কর্তৃপক্ষের ক্রোধের। সর্বপ্রথম ৩০শে ডিসেম্বর লি ওয়েনলিং নামের এক চিকিৎসক এ ব্যাপারে একটি অনলাইন চ্যাট গ্রুপে নিজের সহকর্মীদের সতর্ক করেন। এজন্য তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, তার বিরুদ্ধে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে পুলিশি তদন্ত চালু হয়, জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি নেয়া হয়। ওই চিকিৎসক শুক্রবার মারা গেছেন। এ নিয়ে সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে জনগণ। তার মৃত্যুর খবর ধামাচাপা দিয়ে রাখার চেষ্টার অভিযোগও উঠেছে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
চীনের জন্য করোনা ভাইরাস নতুন নয়। এর আগে এ শতকের শুরুর দিকেও একবার করোনা ভাইরাস মহামারীর শিকার হয়েছিল চীন। সারস নামে পরিচিত ওই করোনা ভাইরাস বিশ্বজুড়ে প্রায় ৮০০ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। ফের নতুন একটি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ চীনের আন্তর্জাতিক ও দেশীয় রাজনীতির জন্য অমঙ্গলজনক। সে ভয় থেকেই প্রাথমিক পর্যায়ে তা চাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়ে থাকতে পারে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। চীনা কর্তৃপক্ষের তথ্য ধামাচাপা দেয়ার রীতির কারণে অনেকে, মৃত ও আক্রান্তের সরকারি তথ্য বিশ্বাস করছেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই দাবি করছেন, প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি। সমপ্রতি চীনভিত্তিক কংগ্লোমেরট টেনসেন্ট এর এক ওয়েবসাইটে মৃতের সংখ্যা সাময়িকভাবে ২৪ হাজার ও আক্রান্ত লাখের বেশি বলে প্রদর্শন করা হয়। পরবর্তীতে অবশ্য এ তথ্য সরিয়ে সরকারি তথ্যই দেখানো হয়। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, কারিগরি ত্রুটির কারণে এমনটি হয়েছে। তবে তাদের এ তথ্য প্রদর্শনের পর থেকে চীনের বিরুদ্ধে তথ্য গোপনের দাবি আরো জোরদার হয়ে উঠেছে। করোনা ভাইরাসের খবর বিশ্বজুড়ে চাউর হওয়ার পরপরই চীন থেকে নিজেদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা শুরু করে বিভিন্ন দেশ। কিছুদিনের মধ্যে নাগরিকদের একাংশ নেয়া শেষ হলেও, এখনো আটকা আছেন অনেকেই। এর মধ্যেই সেখানে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বহু দেশ। সাময়িক সময়ের জন্য দেশটিতে ফ্লাইট স্থগিত করেছে ডজন খানেক আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স। এর মধ্যে রয়েছে, বৃটিশ এয়ারওয়েজ, আমেরিকান এয়ারলাইন্স, এয়ার ফ্রান্স, এয়ার সিউল, ইজিপ্ট এয়ার, অস্ট্রিয়ান এয়ারলাইন্স, ডেল্টা এয়ারলাইন্স ইত্যাদি। সর্বশেষ তাইওয়ানও করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রোধে চীনে সকল ফ্লাইট স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সীমান্ত পারাপার বন্ধ করে দিয়েছে হংকং। রেল যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া। দেশে দেশে চীন সফররত বিদেশিদের ঢুকতে না দেয়ার নির্দেশ জারি হয়েছে।
নতুন করোনা ভাইরাসটির এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো নামকরণ করা হয়নি। এখন পর্যন্ত এটিকে ২০১৯-এনকভ নামেই একে ডাকা হচ্ছে। নামহীন এই ভাইরাস বিশ্বের অর্থনৈতিক শৃঙ্খলাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল আমদানিকারী দেশ চীন। কিন্তু ভাইরাসের কারণে দেশটির বেশির ভাগ ব্যবসাই আটকে আছে। এতে তেলের বাজারে ধস নেমেছে। এক বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংস্থা ওপেক তেলের দাম ফিরিয়ে আনতে উৎপাদন কমিয়ে দেয়ার কথা বিবেচনা করছে। অন্যান্য শিল্পেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। চীন সহ পুরো এশিয়াজুড়ে পর্যটন খাত ব্যাপক লোকসানের শিকার হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স অনুসারে, চীনের করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে ভিয়েতনামের পর্যটন খাত আনুমানিক ৫৯০ কোটি ডলার থেকে ৭৭০ কোটি ডলার হারাতে পারে। প্রসঙ্গত, ভিয়েতনামের সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসে চীন থেকে। অবস্থা এতটাই বেগতিক যে, জানুয়ারি মাসের বাণিজ্যিক তথ্য প্রকাশ করবে না বলে জানিয়েছে চীন। শুক্রবার এক ঘোষণায় দেশটির কাস্টমস কার্যালয় জানায়, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির তথ্য একসঙ্গে মিশিয়ে প্রকাশ করা হবে। ভাইরাসটি বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন মোটরগাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের ওপরও প্রভাব ফেলেছে। চীনে মোটরগাড়ি প্রস্তুতের কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে হুন্দাই মোটর, কিয়া মোটরস, টয়োটা, বিএমডব্লিউ, ডাইমলার, ফোর্ড মোটরস প্রভৃতি। এদিকে চীন থেকে গাড়ি তৈরিতে প্রয়োজনীয় উপকরণ আমদানিও স্থগিত করার কথা বিবেচনা করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। সামপ্রতিক বছরগুলোয় চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পূর্বের তুলনায় কমছে। এর মধ্যে এই মহামারি দেশটির প্রবৃদ্ধি আরো নিচে নামিয়ে আনার আশঙ্কা রয়েছে। উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া এই করোনা ভাইরাস মহামারি প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের জন্য সামপ্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশটির একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী কম্যুনিস্ট পার্টির সক্ষমতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।