ভোট কম পড়লে কী হয় দেশে দেশে

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন্ন। এবারের আকর্ষণ হলো ইভিএম-এ বেশি কম ভোট। মাহবুব তালুকদারের ভবিষ্যদ্বাণীর পরে মঙ্গলবার সংসদে এ নিয়ে (এক তৃতীয়াংশের কম ভোট) বৈধতার প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। সরকারি দল অবশ্য এতে ক্ষতি দেখেন না। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ার মতো আদর্শস্থানীয় গণতান্ত্রিক দেশে শতকরা ৫০ ভাগের নিচে ভোট পেলে, তাকে ‘জনপ্রতিনিধি’ কিংবা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি মনে করা হয় না। এ ছাড়া মৌরিতানিয়া, চাদ, গ্যাবন, বেলারুশ, ইরান তুর্কমেনিস্তান, রোমানিয়া, পর্তুগাল, সেনেগাল ও দক্ষিণ কোরিয়াতেও বিভিন্ন নির্বাচনে ৫০ ভাগের কম ভোট পেলে কেউ ‘নির্বাচিত’ বলে গণ্য হন না। দিয়াগো ম্যারাডোনার দেশ আর্জেন্টিনায় এই পদ্ধতির নাম ‘ব্যালোটেজ।’ সেখানে শতকরা ৪৫ ভাগ এবং নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে কমপক্ষে ১০ ভাগ ভোটে এগিয়ে থাকার শর্ত পূরণ করতে হয়। বিশ্বব্যাপী ন্যূনতম ৫০ ভাগ ভোট পাওয়ার এই ব্যবস্থার নাম মেজরিটারিয়ান ভোটিং সিস্টেম। আর দুই নতুন মেয়র মাত্র ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ ভোট পেয়ে যেভাবে নির্বাচিত হলেন, তার নাম ‘ফাস্টুপাস্টুদিপোস্ট ভোটিং।
সংক্ষেপে এফপিটিপি। গত সংসদ নির্বাচনে ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। এ ছাড়া আগের রাতে ভোটের অভিযোগ উঠেছিল। এ ধরনের অভিযোগ থেকে দুই সিটি নির্বাচন মুক্ত। ১লা ফেব্রুয়ারি দুই সিটি নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগেই নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার কোনো দেশের নাম না নিয়ে উল্লিখিত বিধান স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি তিনি সাফল্যের সঙ্গে ইঙ্গিত বা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, দুই সিটি নির্বাচন এমন সংবেদনশীল অভিযোগ থেকে মুক্ত থাকবে। বঙ্গবন্ধুর আমল থেকে খ্যাতিমান ঝানু আমলা মাহবুব কি কারণে হঠাৎ ইভিএম প্রেমিকে পরিণত হয়েছিলেন, তার মাজেজাটা এখন অনেকে অনুমান বা দুয়ে দুয়ে চার মেলানোর কসরৎ করছেন। আওয়ামী লীগ থেকে বিপরীতমুখী মূল্যায়ন আসছে। জনাব হানিফ বলছেন, শতবছরেও এমন ভোট দেখেননি। তথ্যমন্ত্রী কম ভোটে ক্ষতি দেখছেন না। তবে বিএনপিকেও দুষছেন। আবার সদ্য চিকিৎসাধীন থাকা জননেতা ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ভোটের রাজনীতির প্রতি মানুষের অনীহা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। রাজনীতির প্রতি মানুষের আগ্রহ আরো বেশি হওয়া উচিত।’ অল্প কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে মাহবুব তালুকদারও সাংবাদিকদের মাধ্যমে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতি দিয়েছেন। এতে তিনি গণতন্ত্রের জন্য ‘অশনি সংকেত’ দেখেছেন।
উল্লেখ্য, গত ২৩শে জানুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা মাহবুবের ওই ৫০ ভাগ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশের ঘটনায় প্রকাশ্যে তার অসন্তোষ ব্যক্ত করেছিলেন বলে জানা যায়। মাহবুব তালুকদার বলেছিলেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) যদি ৫০ শতাংশ ভোট না পড়ে, তাহলে ব্যালট পেপারে পুনরায় ভোটগ্রহণ করা উচিত। এজন্য নির্বাচনী বিধি-বিধান পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে। তিনি বলেন, যেকোনো নির্বাচনে শতকরা ৫০ ভাগ ভোট না পড়লে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এজন্য বিশ্বের অনেক দেশে ৫০ শতাংশের কম ভোট পড়লে পুনরায় ভোটগ্রহণ করা হয়। খোদ নির্বাচন ভবনে আয়োজিত ঢাকার দুই সিটি ভোটের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বৈঠকে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে তিনি এসব কথা বলেছিলেন। তার পর পরই সিইসি বক্তব্য রাখলেও তিনি এসব অভিযোগের কোনো জবাব দেননি। তবে বলেছেন, কোন ফোরামে কোন বক্তব্য দেয়া উচিত- এ বিবেচনা বোধ সবার থাকা উচিত।
মাহবুব তালুকদার তখনই তথ্য দিয়েছিলেন, চট্টগ্রাম-৮ আসনের সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে সব কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। এতে ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশ ভোট পড়েছে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ইভিএমবিহীন ব্যালট পেপারে যে ২৯৪টি আসনে ভোট হয়েছে, ভোটের হার যেখানে ছিল শতকরা ৮০ ভাগ, সেখানে ইভিএম ব্যবহারে ২৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ কম ভোট পড়েছে। এর কারণ ভোটারদের মনে আছে ইভিএম ভীতি। বাংলাদেশ সংবিধানের শর্ত হলো, প্রশাসনের সকল স্তরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকতে হবে। কিন্তু নির্বাচিত ব্যক্তি কে, কি কি শর্ত পূরণ করলে একজন ব্যক্তি নির্বাচিত বা তার পক্ষে কোনো অফিস পরিচালনা করার ‘রাজনৈতিক বৈধতা’ পূরণ করা হবে, সেই বিষয়ে সংবিধানে কিছু বলা নেই। গতকাল সংসদ সদস্য হারুন বলেছেন, সংবিধানে যদি শর্ত দেয়া হতো তাহলে আর এত কম ভোট পেয়ে জনগণের ম্যান্ডেট পাওয়ার দাবি করা যেতো না।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন বাংলাদেশে অতীতে বিভিন্ন সময়ে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাব উঠেছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞ বা থিংকট্যাংকগুলো কখনো ৫০ ভাগের কম ভোট পেলে, সেখানে আপনা আপনি সেকেন্ড রাউন্ড ভোটাভুটির বিধান চালুর কথা আলোচনাতেই আসেনি। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও এবিষয়ে কোনো ইস্যু তুলে ধরে সে বিষয়ে জনমত গড়ে তুলতে কখনো কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায় না। এখন বাংলাদেশের নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে কি হয়নি, সেই তর্ক বিতর্ক পেছনে পড়েছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট: ২০১৭ সালে ফ্রান্সে নির্বাচন হলো। তাতে স্বতন্ত্র প্রার্থী বর্তমান ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখো পেয়েছিলেন ২৩.৭ ভাগ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছিলেন ২১.৫ ভাগ। তাই সেকেন্ড রাউন্ড হলো। এবং তাতে মাখো জিতলেন।
ন্যূনতম ৫০ ভাগ ভোট না পেলে কেউ নির্বাচিত হয় না, এমন আরেকটি দেশ হচ্ছে রোমানিয়া। ২০১৯ সালের ১০ই নভেম্বর দেশটি জাতীয় নির্বাচনে যায় এবং দেশটির নেতারা প্রথম রাউন্ডে ভোট পেয়েছিলেন শতকরা ২২ ভাগ। তাই দ্বিতীয় দফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের দরকার পড়ে। আফ্রিকার দেশ চাদে জনাব ইদ্রিস দিবি প্রথম রাউন্ডেই যেহেতু ভোট পেয়েছিলেন শতকরা ৬২ ভাগ। তাই দেশটি দ্বিতীয় রাউন্ডে নির্বাচনে যায়নি। ন্যূনতম বাধ্যতামূলক শতকরা ৫০ ভাগ ভোটের দেশ কিন্তু অস্ট্রেলিয়াও। অস্ট্রেলিয়া পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যা হয়েছে দেড়শ। ৩ বছর মেয়াদে সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত হয়। তাদেরও ‘নির্বাচিত হতে’ ৫০ ভাগ ভোট পেতে হয়। বড় প্রশ্ন এটাই যে, নতুন প্রজন্ম কীভাবে দেখছে। এভাবে যদি সারা দেশের নির্বাচনগুলোতে এই অবস্থা চলতে থাকে তাহলে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে? কে গ্যারান্টি দেবে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো সামনে আর কোনো নির্বাচন হবে না? আর প্রশ্ন আওয়ামী লীগের ভোটাররা তো ভয় পাননি। তারা কোথায় গেলেন? এরআগে চট্টগ্রামের একটি উপনির্বাচনেও বেশ কম ভোট পড়েছিল। তার পর পরই ঢাকা সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। কোটি টাকা দামের প্রশ্ন হলো, আগামী সাধারণ নির্বাচন কি ইভিএমে হবে? তখনও কি এতটা শান্তিপূর্ণভাবে এত কম ভোট পড়বে?