ভুয়া প্রশ্নপত্রের শতাধিক চক্র

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ ‘হ্যালো এসএসসি/এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা। কেমন আছো সবাই। আমরা তোমাদের জন্য সরবরাহ করছি বিষয় ভিত্তিক প্রশ্নপত্র এবং তার সমাধান। বিশেষ ক্ষেত্রে আমরা ফলাফল পরিবর্তনের নিশ্চয়তা দিচ্ছি। তবে আর দেরি নয় আজই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করো। আগ্রহীরা বিস্তারিত জানতে ইনবক্সে যোগাযোগ করো’। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপ তৈরি করে এভাবেই প্রচারণা চালায় ভুয়া প্রশ্নপত্রের চক্রের সদস্যরা। তার আগে তারা পরীক্ষার্থীদের টার্গেট করে ফেসবুকের ম্যাসেঞ্জার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপসে গ্রুপ তৈরি করে সদস্য সংগ্রহ করেন। পরে অভিভাবক ও পরীক্ষার্থীদের এসব গ্রুপে সংযুক্ত করে নেয়। ইনবক্সে আলোচনার মাধ্যমে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে প্রশ্নপত্র বিক্রির দর কষাকষি করে। দরদাম ঠিক হলে একপর্যায়ে চক্রের সদস্যরা বিকাশের মাধ্যমে টাকার লেনদেন করে। আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে প্রতিটা প্রশ্নপত্রের জন্য ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। জানিয়ে দেয়া হয় বিষয় ভিত্তিক পরীক্ষার আগে ইনবক্সে প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে দেয়া হবে। এভাবে একসঙ্গে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে টাকা সংগ্রহ করে এসব চক্র ওই গ্রুপগুলো বন্ধ করে দেয়। যেসব বিকাশ নম্বরে লেনদেন বা কথা হতো পরবর্তীতে এসব মোবাইল নম্বরও বন্ধ পাওয়া যায়। এভাবেই ভুয়া প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যরা পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে প্রতারণা করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, এসএসসি, এইচএসসি ও বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সরবরাহ করার কথা বলে কিছু চক্র সারা দেশব্যাপী প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। যাদেরকে এসব অভিযোগে বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার করা হলেও জামিনযোগ্য এসব অপরাধে জামিন নিয়ে তারা ফের এসব কাজে জড়িয়ে পড়ছে। তথ্যমতে, সারা দেশে কম বেশি শতাধিক চক্র ভুয়া প্রশ্নপত্র নিয়ে কাজ করে। প্রকৃতপক্ষে তারা সঠিক প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করতে পারে না। শিক্ষার্থীদের লোভে ফেলে টাকা হাতিয়ে নেয়াই তাদের কাজ। অনেক ক্ষেত্রে তারা যেসব প্রশ্নপত্র দেয় সেগুলোর সঙ্গে পরীক্ষা কেন্দ্রের প্রশ্নপত্রের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ভুয়া প্রশ্নপত্র চক্রের সদস্যা দেশব্যাপী ফাঁদ তৈরি করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। বিভিন্ন আশ্বাস দিয়ে তারা হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। তাই তাদেরকে আটকের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। মূলত, তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপ/ পেজ খুলে এসব প্রতারণা করছে। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্য বেশ কিছু পেজ, গ্রুপকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গতিবিধি মনিটরিং করা হচ্ছে। ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ক্রাইম ডিভিশন তাদের ভেরিফাইড পেজে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভুয়া প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের হাত থেকে দুরে থাকার জন্য সতর্ক করছে। সাইবার ডিভিশন বলছে, প্রশ্নপত্র প্রনয়নের কাজ নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। কোনভাবেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার সুযোগ নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা জনপ্রিয় চ্যাট ইঞ্জিনগুলোর পাবলিক বা ক্লোজড গ্রুপে যারা প্রশ্নপত্র সরবরাহ করবে বলে চটকদার বিজ্ঞাপন দিচ্ছে সেগুলো ভুয়া। সেই ভুয়া এন্টিটি বা কন্টেন্টগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। যেসকল গ্রুপ থেকে এ ধরণের কাজ করা হচ্ছে এসব গ্রুপের তৎপরতাকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তাই সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এসব গ্রুপে ঢুকে আইনী ঝামেলায় না পড়তে বলা হয়েছে। সাইবার ইউনিট সূত্র জানিয়েছে, কিছু কিছু পরীক্ষার হলগুলোতে ম্যাগনেট, অপ্টিক ও ফ্রিকুয়েঞ্চি ডিটেক্টর বসানো হয়েছে। যাতে, হলে গিয়ে কেউ বিশেষ ডিভাইস দিয়ে জালিয়াতি করতে না পারে। ভুয়া প্রশ্নপত্র চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারের জন্য ডিভি ও সাইবারের টিম প্রতিনিয়ত বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে বলেও সাইবার সূত্র জানিয়েছে।
ভুয়া প্রশ্ন পত্রের কারবারিদের ধরতে পুলিশের পাশপাশি মহানগর গোয়েন্দা সংস্থা (ডিবি), ডিএমপির সাইবার নিরাপত্তা ও ক্রাইম ইউনিট, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও সিআইডির সাইবার মনিটরিং টিম কাজ করছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রতিদিনই দেশের অনেক জায়গা থেকে ভুয়া প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করছেন। গতকাল এসএসসি পরীক্ষা-২০২০ প্রথম পরীক্ষার দিনে রাজধানীর রামপুরা, গাজীপুর ও খুলনা থেকে পৃথক অভিযান চালিয়ে ভুয়া প্রশ্নপত্র প্রতারণা চক্রের চারজনকে আটক করেছে র‌্যাব। তারা হলেন, ঢাকার গাজীপুর থেকে মো. আবু বক্কর সিদ্দিক (২৬), রামপুরা থেকে আল মাহমুদ (১৮), খুলনা থেকে শাকিল মাহমুদ (২০) ও সাইমন ইসলাম (২০)। র‌্যাব-১-এর সহকারী পুলিশ সুপার মোর্শেদুল হাসান জানান, গাজীপুর মহানগরীর গাছা থানার উত্তর খাইলপুকুর মাদরাসা রোডের মমতাময়ী বিদ্যানিকেতনের সামনে অভিযান চালিয়ে প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্রের সদস্য আবু বক্কর সিদ্দিককে আটক করা হয়। এসময় তার মোবাইল ফোনের হোয়াটস অ্যাপ ও ফেসবুকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। র‌্যাব জানায়, আবু বক্কর ২০১৯ সাল থেকে ফেসবুকে প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে কাজ করেন। সে ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সের (ইউআইটিএস) বিএসসি তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। পাশাপাশি তিনি মমতাময়ী বিদ্যানিকেতন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে আবু বক্কর জানিয়েছে, তিনি গোপণীয়তার সঙ্গে চলমান এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন সরবরাহ করে সুযোগ সন্ধানী শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে টাকা নিয়ে তাদের প্রশ্ন সরবরাহ করতেন। পরে ফাঁসকৃত প্রশ্নগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাাপ ও ইমো থেকে ডিলিট করে দিতেন। এর আগে ২৯শে জানুয়ারি ঢাকার সবুজবাগ এলাকা থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্য রাশেদুল হাসান রাব্বিকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। রাব্বি র‌্যাবকে জানিয়েছে, ২০১৮ সাল থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও রেজাল্ট পরিবর্তনের আশ্বাস দিয়ে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে বিকাশের মাধ্যমে অবৈধ অর্থ উপার্জন করে আসছে। এর আগেও সে সবুজবাগ ও তেজগাঁও থানার দুটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলো। ৩১শে জানুয়ারি রাতে ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্য মাসুদ রানা (২৪) কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন, প্রশ্নের প্রিন্ট করা কপি উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মাসুদ জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে সে ফেসবুকে প্রশ্নপত্র বিক্রি করছে। রোববার রাতে ফেনির রাজাপুর এলাকা থেকে হাতিয়ে নেয়া বিপুল পরিমাণ টাকাসহ ইমাজ উদ্দিন নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। সে বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করবে বলে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি ও ক্রাইম ডিভিশনের অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার নাজমুল ইসলাম বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যরা যাতে কোনো ভাবেই শিক্ষার্থী/অভিভাবকদের সঙ্গে প্রতারণা করতে না পারে সেজন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। সন্দেভাজনদের আটকের চেষ্টা চলছে। এদিকে, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, প্রশ্ন ফাঁসরোধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে প্রশাসন। প্রশ্ন ফাঁস রোধে ৫ হাজার ৫৮০ সেট প্রশ্ন প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আর ২ হাজার ৭৯০ সেট প্রশ্ন মুদ্রণ করা হয়েছে। প্রশ্ন ফাঁসে গোয়েন্দা সংস্থা যথেষ্ট সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। তাই গুজবে কান না দিয়ে ভালো ফলাফলের জন্য ভালো প্রস্তুতি নিতে শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।