নেতিবাচক ভাবমূর্তি নিয়ে কীভাবে ঠিকে আছে পাকিস্তান?

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ বেশ কিছুদিন ধরেই এটি প্রায় স্পষ্ট যে, পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন বন্ধ করবে না বা এতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কার্যকর বাধা দেবে না। এর অন্যতম প্রধান কারণ দেশটির পার্শ্ববর্তী ভারত, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া। যদিও বছরের পর বছর ধরে ইসলামাবাদের পৃষ্ঠপোষকতায় চলতে থাকা সন্ত্রাসের শিকার এসব দেশ। এক বিশেষজ্ঞ বলছেন, পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের গভীরে প্রবেশ সহজ কাজ না। সশস্ত্র গোষ্ঠী আল-কায়েদার সাবেক প্রধান ওসামা বিন লাদেনের অবস্থান নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি শক্তিশালী দেশের কয়েক বছর লেগে যায়। আর এসব প্রতিরোধে দিল্লির নীতিনির্ধারকদেরও স্বার্থগত ও কৌশলগত দক্ষতার অভাব রয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো ও আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থার সঙ্গেও ভাল যোগাযোগ করতে পারেনি তারা। সন্দেহতীতভাবে বলা যায়, এসব দেশ তাদের নিজেদের নির্বুদ্ধিতার কারণে আংশিকভাবে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারছে না। আফগানিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানও প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন কারণে আফগানরা পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তারা অভিযান পরিচালনায় ব্যর্থ হচ্ছে। সীমান্তে চোরাচালান, অবৈধ অনুপ্রবেশ ও উগ্রবাদ প্রতিহত করতে গিয়ে ইসলামাবাদের সহযোগিতা অত্যাবশ্যক হওয়ায় কাবুলের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে ভাটা পড়ছে। পশ্চিমা দেশগুলো ও তাদের প্রতিষ্ঠানিক দ্বিচারিতার কারণে ওই অঞ্চলের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
আশ্চর্যজনক হলো, পাকিস্তানের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর নিজস্ব কোনও স্বতন্ত্র নীতি নেই। তারা যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশিত বিষয়ের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল। এ অঞ্চলের বিষয়গুলো তারা মার্কিন চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের অভিযোগে জি-৭ এর মতো শক্তিশালী সংস্থা থেকে কোনও বড় ধরনের শাস্তির মুখোমুখি হয়েছে এমন কোনও খবর পাওয়া যায় না। পশ্চিমা নেতারা ও সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের শাস্তির দাবি তুললেও কয়েকটি দেশের বিরোধিতায় তা আর কার্যকর হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ও আফগানিস্তান কাবুলে রাজনৈতিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য পশ্চিমাপন্থি সরকারকে ঠিকিয়ে রাখতে পাকিস্তান ফ্যাক্টরকে পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারে না। সেখানে ব্যতিক্রম হচ্ছে তালেবান। তারা সমঝোতার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের ফেরত পাঠাতে কৌশলের অংশ হিসেবে এটি করছে তারা।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাশ্মির ইস্যুতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়েছে রাশিয়া। ইসলামি সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার বিষয়ে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে তারা এ কাজ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসের সবচেয়ে বড় যোগানদাতা হলো ইসলামাবাদ। এই কারণে এটি মোকাবিলা করতে আঞ্চলিক সহায়তাকারী হিসেবে ভুটান ও বাংলাদেশকে ছাড়া আর কারো সমর্থন পায় না দিল্লি। পাকিস্তানের এমন অবস্থার পরও দেশটিকে একতরফা সমর্থন দেয় চীন। পাকিস্তানে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ ও বাণিজ্যিক স্বার্থের কারণে তাদের সমর্থন দেয় তারা। আর চীনের দুঃসময়েও অব্যাহত সহায়তা ও পাশে থেকেছে ইসলামাবাদ। কাশ্মির ইস্যুতেও জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানের পক্ষে প্রবল ভূমিকা রাখে বেইজিং। ভারত, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান জোরালো ভূমিকা না রাখায় লাভবান হচ্ছে পাকিস্তান। সন্ত্রাসবাদে পৃষ্ঠপোষকতা ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের বিষয়ে শুধু নিন্দা জানায় তারা। পশ্চিমা দেশগুলো ও জি-৭’র কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ থাকলেও জোটটি এখনও বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারছে না।
সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন বন্ধ করতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একবার পদক্ষেপ নিয়েছিল জি-৭ এর অর্থ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা এফএটিএফ। ওই সময় ৩৬ জনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়। ১৯০ জনের সম্পত্তি বায়েজাপ্ত, ৮২ মাদ্রাসা ও ২৫ বিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেয় তারা। তবে এসব বিষয়ে বিস্তারিত কোনও তথ্য দেয়নি ইসলামাবাদ। পরে এই অবস্থান থেকেও সরে যায় তারা। এখন পাকিস্তানের লস্কর-ই-তৈয়বার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ সাঈদ, জাফর ইকবাল ও হাজী মোহাম্মদ আশরাফকে মাসিক ভাতা দিচ্ছে পাকিস্তান। তাদের পূর্ববর্তী সন্ত্রাসবাদী কাজের জন্য এই ভাতা দেওয়া হচ্ছে। সাঈদকে ২০০৮ সালের মুম্বাই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী বলে ধারণা করা হয়। তার বিরুদ্ধে ৩০টি সন্ত্রাসবাদী মামলা রয়েছে।
বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যেও উগ্রবাদের অর্থায়ন করার অভিযোগ রয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। ২০১৯ সালে আগস্টে চট্টগ্রামে রোহিঙ্গার এক সমাবেশে দুই লাখ লোক জড়ো হয়। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সমর্থিত আল খিদমত সংস্থাই ওই সমাবেশের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বলে জানা যাচ্ছে। আর তাদের এজেন্টরা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, যারা অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিচ্ছে আফগানিস্তানে। এই তথ্য ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানি নিয়ন্ত্রণকদের নির্দেশে এলইটি, জইশ-ই-মোহাম্মদ ও জামায়াতে ইসলামি তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে।
ইসলামি চরমপন্থী গোষ্ঠীরা তাদের কার্যক্রম জোরদার করতে কাবুলের ওপর প্রায় চাপ প্রয়োগ করে। সম্প্রতি খবরে জানা গেছে, তালেবানদের সঙ্গে তাদের মতবিরোধ হয়েছে। এইসব চরমপন্থী ক্যাডাররা ইসলামিক স্টেট অব খোরাসান প্রোভিন্স নামের একটি সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছে। এতে তালেবানদের কোনও ক্ষতি নেই। এলইটির সদস্যরা আইএসআই ও তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে শুন্যস্থান পূরণ করছে। দিল্লি, ঢাকা ও অন্য সংস্থাগুলোর নীতিনির্ধারকদের ভুলের জায়গা হচ্ছে- তারা যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তবে বাংলাদেশ কিছু কিছু ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। ২০২০ সালে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে অগ্রসর পরিকল্পনা ও পারষ্পরিক সহযোগিতা জোরদার করা জরুরি।