ইকোনমিস্টের রিপোর্ট : আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারকদের বিরল ঐকমত্য

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ২৩শে জানুয়ারি রায় দিয়েছে যে, মিয়ানমারকে নিপীড়িত মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। গণহত্যা পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। দেশটির বিরুদ্ধে কোনো আন্তর্জাতিক আদালতের এটাই প্রথম রায়। একইসঙ্গে দেশটির বেসামরিক অংশের নেত্রী ও স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচির প্রতি তীব্র নিন্দার প্রকাশ ছিল এই রায়। তিনি গত মাসে নিজে আদালতে উপস্থিত হয়ে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে নিয়মতান্ত্রিকভাবে রোহিঙ্গাদের গ্রাম পুড়িয়ে দেয়া, হাজারো রোহিঙ্গাকে হত্যা ও ধর্ষণ করা এবং আরো ৭ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষকে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য করার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
গত নভেম্বরে ৫৭ দেশের সম্মিলিত সংগঠন অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) এর পক্ষে আইসিজেতে মামলা দায়ের করে গাম্বিয়া। মামলায় তারা মিয়ানমারকে গণহত্যার আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে। পাশাপাশি যুক্তি দেখায় যে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা এখনো বিপদের ঝুঁকিতে রয়েছে। সেখানে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে কিনা তা বিবেচনা করে দেখছে আদালত। তবে গাম্বিয়া আরো ক্ষতি এড়াতে ‘অন্তর্বর্তী নির্দেশ’ নামে পরিচিত অস্থায়ী কিছু আদেশ জারির আবেদন জানায়। তারা আইসিজে’র কাছে রোহিঙ্গাদের সহিংসতা থেকে রক্ষা করতে মিয়ানমারকে তাদের সামরিক বাহিনীকে নিপীড়ন বন্ধের নির্দেশ দিতে আহ্বান জানায়। পাশাপাশি গণহত্যার অভিযোগ সংশ্লিষ্ট প্রমাণ সংরক্ষণ ও আদেশ জারির চার মাসের মধ্যে অন্তর্বর্তী পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন জমা দিতে বলে মিয়ানমারকে।
মিয়ানমারের নিয়োগ দেয়া জার্মান বিচারক ক্লস ক্রেস ও চীনা আইনজীবী শু হানকিন সহ আইসিজে’র ১৭ বিচারকের সকলে সর্বসম্মতভাবে গাম্বিয়ার অনুরোধে সায় দিয়েছে। উল্লেখ্য, হানকিন গত মাসের শুনানিতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে গাম্বিয়ার মামলা করার অধিকার রয়েছে কিনা সে বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। বিচারকদের সম্মতি নিয়ে আইসিজে’র সাবেক সহযোগী আইনি কর্মকর্তা মাইকেল বেকার বলেন, এমন পর্যায়ের সম্মতি সচরাচর দেখা যায় না। এছাড়া বিচারকরা আরো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, চার মাসের মাঝে প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর থেকে মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি ছয় মাস অন্তর অন্তর একটি করে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে মিয়ানমারকে। মানবাধিকার সংগঠনের জোট এশিয়া জাস্টিস কোয়ালিশনের পরিচালক প্রিয়া পিলাই বলেন, গাম্বিয়া কিন্তু এ অনুরোধ করেনি।
গাম্বিয়ার জন্য রায়টি পুরোপুরি জয়ের ছিল না। আদালত মিয়ানমারকে দেশটিতে জাতিসংঘ তদন্তকারীদের প্রবেশাধিকার দেয়ার ব্যাপারে কোনো নির্দেশ দেয়নি। সেখানে প্রবেশের অধিকার নেই জাতিসংঘের স্বাধীন আন্তর্জাতিক তথ্য অনুসন্ধান মিশনের। এতে দেশটিতে ২০১৭ সালে চালানো ‘নিধন অভিযান’ সম্পর্কে প্রমাণ সংগ্রহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আদালত গাম্বিয়ার এ অনুরোধ কেন ফিরিয়ে দিয়েছে তা ব্যাখ্যা করেনি। বেকার জানান, তিনি এ সিদ্ধান্তে চমকে যাননি। তিনি বলেন, এটি একটি কলহপ্রিয় প্রশ্ন, বা তর্কযোগ্য যে, জাতিসংঘের তদন্তকারীদের দেশে ঢুকতে দেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কিনা।
তবে আদালতের অনুমোদন দেয়া সকল নির্দেশকেই স্বাগত জানিয়েছে গাম্বিয়া ও রোহিঙ্গা এডভোকেসি সংগঠনগুলো। দ্য বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকে রায়টিকে ‘জবাবদিহিতার ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। অন্তর্বর্তী আদেশগুলো আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক। এছাড়া, গত নভেম্বরে মিয়ানমার প্রকাশ্যে আইসিজে’র কর্তৃত্বের স্বীকৃতি দিয়েছে। পিলাই বলেন, সার্বিকভাবে অন্তর্বর্তী আদেশগুলো মানতে হবে। আইসিজে’র কর্তৃত্ব বিশাল। গাম্বিয়ার যদি মনে হয় যে, মিয়ানমার আদালতের নির্দেশগুলো মানছে না, তাহলে তারা নতুন করে আদেশ জারির আবেদন করতে পারে বা পর্যায়ক্রমে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সাহায্য চাইতে পারে। প্রাক্তন আইসিজে কর্মকর্তা বেকার অবশ্য মনে করেন, চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ায় নিরাপত্তা পরিষদ তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়ার সম্ভাবনা কম। পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ায় চীন যেকোনো প্রস্তাবনায় ভেটো দেয়ার ক্ষমতা রাখে। ইতিপূর্বে রোহিঙ্গা নির্যাতনের অভিযোগে মিয়ানমারের জন্য শাস্তিমূলক একাধিক চেষ্টা নস্যাৎ করে দিয়েছে তারা।
আইসিজে’র প্রেসিডেন্ট আবদুল কাওয়ি ইউসুফ ব্যথিতভাবে জানিয়েছেন যে, এই রায়ের সঙ্গে মামলার যোগ্যতার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। মামলাটি এখনো চলছে। অন্তর্বর্তী আদেশের প্রয়োজনীয়তা পূরণে গাম্বিয়ার আদালতকে বোঝাতে হয়েছে যে, মিয়ানমারের গণহত্যা হয়ে থাকতে পারে ও ভবিষ্যতে তা ফের ঘটতে পারে। তবে গণহত্যা হয়েছে তা প্রমাণ করতে পারেনি তারা। ধারণা করা হচ্ছে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কয়েক বছর লাগবে। আদালতের রায়ের দিন মিয়ানমারের শতাধিক নাগরিক-সমাজ সংগঠন আইসিজে’কে সমর্থন জানিয়ে এক চিঠিতে স্বাক্ষর করেছে। তারা লিখেছে, আমরা সপষ্টভাবে বুঝি যে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইসিজের রায় এদেশের জনগণের বিরুদ্ধে নয়, যারা রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি ব্যবহারের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে। দুঃখজনক হলেও অল্পসংখ্যক ভিন্নমতও আছে। ডিসেম্বর সুচি যখন হেগে যান, তখন তার হাজারো সমর্থকরা মিয়ানমারজুড়ে রাস্তায় নেমে তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে। আইসিজে’র রায় বিদেশে সুচির জন্য লজ্জাজনক হলেও, নিজদেশে এই রায় জাতির অভিভাবক হিসেবে তার ভাবমূর্তি আরো জোরদার করবে। একইসঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধেও দেশটিতে পূর্বধারণা জোরদার করার আশঙ্কা রয়েছে। তারা কেবল মিয়ানমারে অবাঞ্ছিতই নয়, আন্তর্জাতিক লজ্জাও।