মন্ত্রী-এমপিদের প্রচারণা নিয়ে বিতর্ক

0

লোকসমাজ ডেস্ক ॥ ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের নির্বাচনী কাজে অংশ নেয়া নিয়ে চলছে বিতর্ক। নির্বাচন কমিশনের বিধিমালা অনুযায়ী সিটি নির্বাচনের কার্যক্রমে সরকারের মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যরা অংশ নিতে পারেন না। এ নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারও স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন। তারপরও ক্ষমতাসীন দলের প্রতিনিধির পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্বাচনের কার্যক্রমে এমপিদের অংশ নেয়ার সুযোগ আছে। ওই প্রতিনিধি নিজেও সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক। দুই সিটির নির্বাচন পরিচালনায় আওয়ামী লীগ যে কমিটি করেছে সেখানে বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য রয়েছেন। নির্বাচন পরিচালনা কমিটিতে এমপিদের থাকা বা তাদের কার্যক্রম চালানো নির্বাচনী আইনসিদ্ধ কিনা এ নিয়ে ধোয়াশা রয়েছে জনমনে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের মাঝে।
এ অবস্থায় বিষয়টি পরিস্কার করে একটি পরিপত্র জারির দাবি তুলেছেন জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকার। প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে দেয়া আনঅফিসিয়াল নোটে তিনি এ দাবি করেন। তিনি বলেন, বিদ্যমান আচরণবিধি অনুযায়ী নির্বাচন সম্পর্কিত যে কোনো কমিটিতে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। এই নির্বাচনী কার্যক্রম ঘরে বা বাইরে যে কোনো স্থানে হতে পারে। তিনি বলেন, আচরণ বিধিমালা সম্পর্কে যাতে কোনো প্রকার বিভ্রান্তির অবকাশ না থাকে, সে জন্য নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনাসহ একটি পরিপত্র জারি করা অত্যাবশ্যক। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেনও মনে করেন বিষয়টি স্পষ্ট করতে একটি পরিপত্র জারি করা জরুরি। তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমাদের নির্বাচন নিয়ে অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। ভোট না দিয়ে প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে যাচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে যদি এভাবেই নির্বাচন হতে থাকে তাহলে তো ভোট দেয়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে মানুষ। তিনি বলেন, গত দশ বছর কোন ভোট ঠিক মতো হয়নি। সেটার ছাপ থেকে যাবে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও। কাজেই নির্বাচন কমিশনকে তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে হবে। নির্বাচনে কারা কাজ করতে পারবে আর কারা পারবে না এ বিষয়ে আইনের গ্রে এড়িয়া আছে। এই গ্রে এরিয়াকে স্পষ্ট করে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিপত্র জারি করতে পারে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) মুখে বললে তো হবে না, পরিপত্র জারি করতে হবে। কোন রাজনৈতিক দলের কে কি বললো এটা কোন বিষয় নয়। এটি কোন ইস্যু নয়। বিষয় হচ্ছে আইন কি বলে। নির্বাচনের যখন তফসিল ঘোষণা করা হয়, তখন পরিপত্রই হচ্ছে আইন।
শনিবার আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা জানিয়েছিলেন, সিটি নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিরা প্রচারণা ও ঘরোয়া কাজেও অংশ নিতে পারবেন না। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের প্রধান তোফায়েল আহমেদ বৈঠক শেষে বলেছিলেন, নির্বাচন কাজে এমপিদের অংশ নেয়ার সুযোগ আছে।
উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় সুবিধাপ্রাপ্ত ও গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীদের প্রচারে বাধা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসার মধ্যে শনিবার নির্বাচন কমিশনে যায় আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল। ইসির সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন উত্তর সিটির দলীয় প্রার্থী আতিকুল ইসলামের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সময়ন্বয়ক বর্ষিয়ান এমপি তোফায়েল আহমেদ। অন্যান্যের মধ্যে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচনী বিধিমালার অসঙ্গতি তারা তুলে ধরেছেন ইসির কাছে। আর এতে মাহবুব তালুকদার ছাড়া অন্য নির্বাচন কমিশনাররা একমতও পোষণ করেছেন।
তিনি বলেন, আমরা এমপিরা পথসভায় যাবো না, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ক্যাম্পেইন করবো না। কিন্তু আমাদের যে সমন্বয়কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমরা তো ঘরোয়াভাবে মিটিং করতে পারবো। নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো ক্যাম্পেইনে যেতে পারবো না, সেটা আমরা মেনে নিয়েছি। তারা (ইসি) অনুরোধ করেছেন, এমপিদের ভোট না চাইতে। ভোট চাওয়া ছাড়া আমরা সব করবো। নির্বাচনী আচরণবিধিতে সরকারি সুবিধাভোগী অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সংসদ সদস্যদেরও স্থানীয় নির্বাচনে প্রচারে নামার উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এনিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। তারা বলছেন, এতে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা প্রচারে নামতে পারলেও আওয়ামী লীগ নেতারা পারছেন না। তোফায়েল বলেন, জাতীয় সংসদ সদস্যরা কিন্তু সুবিধাভোগী না। সুবিধাভোগী হলো অফিস অব প্রফিট যেটা আমরা এমপিরা পাই না। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, হুইপ, স্পিকাররা পায়। অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির যে বিষয়টি সেখানে আমাদের শেখ সেলিম, হানিফ, তারা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আবার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর, তারা সবাই কিন্তু মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ছিলেন, তারাও কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তারা (ইসি) স্বীকার করেছে যে আসলে সংজ্ঞা মধ্যে স্ববিরোধিতা রয়েছে। মাহবুব তালুকদার সাহেব সেদিন যে কথা বলেছিলেন, আজকেও বলেছেন, আমি আমার অফিস বা ঘরে বসেও নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলতে পারবো না। এটা বাস্তবসম্মত নয়।
ওই বৈঠকের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, কোনো এমপি নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে পারবেন না। নির্বাচনী কার্যক্রমে থাকতে পারবেন না। নির্বাচন সমন্বয়ও করতে পারবেন না। সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দুই জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদ ও আমির হোসেন আমু সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন হয়েছে কি না, জানতে চাইলে সিইসি জানান, আওয়ামী লীগ কী দায়িত্ব দিয়েছে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে ইসি জানে না। এ ব্যাপারে ইসি অবহিত হলে নিষেধ করা হবে। সিইসি বলেন, আচরণবিধি অনুসারে, নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে বাধা রয়েছে এমন ব্যক্তিরা প্রার্থীর পক্ষে কথা বলতে পারবেন না। ভোট চাইতে পারবেন না।
ওদিকে, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নির্বাচনে লেভেল প্ল্রেয়িং ফিল্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলে বলেন, সরকারি দলের সিনিয়র নেতারা প্রচারণায় অংশ নিতে না পারলেও বিরোধী পক্ষের সবাই অংশ নিতে পারছেন। অবশ্য তার এ বক্তব্যে জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাকে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে নির্বাচনী প্রচারে নামার আহবান জানান। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, নির্বাচনী মাঠে বিরোধীদের মোকাবিলায় দলের দুই মেয়র প্রার্থীই যথেষ্ট। নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে তারাই প্রচার কাজ করে দলীয় প্রতীক নৌকাকে বিজয়ী করতে পারবেন। আগামী ৩০শে জানুয়ারি ঢাকার দুই সিটিতে ভোট গ্রহণ করা হবে। ৫৪ লাখেরও বেশি ভোটারের ভোট গ্রহণ করা হবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ইভিএমে। সরস্বতী পূজা উপলক্ষ্যে এদিন ভোট গ্রহণে আপত্তি জানিয়ে আসছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। এ নিয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদনও করা হয়েছে। আজ এ আবেদনের বিষয়ে আদেশ দেয়া হবে।
ঐক্য পরিষদের বৈঠক: ওদিকে ঢাকার দুই সিটির ভোটের দিন পরিবর্তন না করার কারণে যদি অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি তৈরি হয়, তাহলে এর দায় নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে নিতে হবে বলে হুশিয়ারি দিয়েছে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তনের দাবিতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে বৈঠক করেন পরিষদের সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। দেড় ঘণ্টার সভা শেষে ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেন, হতাশ মনে এই নির্বাচন কমিশন থেকে আমাদের বিদায় নিতে হয়েছে। তারা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলেছেন, আমরা আমাদের হৃদয়ের অনুভূতির কথা বলেছি। আমরা বলতে চাই, এ আলোচনার মধ্য দিয়ে কোনো সমস্যার সুরাহা করতে পারিনি। রানা দাশগুপ্ত বলেন, সরকারের হিসাব অনুযায়ী ২৯শে জানুয়ারি সরস্বতী পূজা। আমরা বলার চেষ্টা করেছি, ২৯শে জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টার পর থেকে শ্রী পঞ্চমী তিথি শুরু হবে। তারপর দিন ৩০শে জানুয়ারি বেলা ১১টার দিকে তিথির অবসান ঘটবে। নিয়ম হলো, শ্রী পঞ্চমী তিথির সকালবেলা সূর্যোদয়ের পর সরস্বতী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এটাই ধর্মীয় শাস্ত্রীয় রীতিনীতি বা বিধান। ৩০শে জানুয়ারি নির্বাচন হলে পূজা হবে কোথায়? আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে উৎসবের সাথে পূজা হয়। নির্বাচন হলে কী করে পূজা করবে? এবিষয়ে ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর বলেন, এ বিষয়ে আদালতে একটি রিট মামলা হয়েছে। আগামীকাল মঙ্গলবার (আজকে) আদালত সিদ্ধান্ত দেবে। আমরা সেই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। মামলাটি আদালতে থাকায় এ বিষয়ে কমিশন এখন কিছু বলবে না। আদালত যেভাবে নির্দেশনা দেবেন, কমিশন সেভাবে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে। ইসি সচিব আরও বলেন, আমাদের সরকারি ক্যালেন্ডার মেনে চলতে হয়। সরকারি ক্যালেন্ডারে সরস্বতী পূজার বন্ধ দেখানো আছে ২৯শে জানুয়ারি। এটা আবার ঐচ্ছিক বন্ধ, কোনো সরকারি বন্ধ নয়। অফিস, আদালতসহ সরকারি সব প্রতিষ্ঠানই খোলা থাকে। এদিকে রোববার নির্বাচনী প্রচারে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে কমিশন উদ্বিগ্ন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, কমিশনের কাছে এ ধরনের কোনো রিপোর্ট নেই। এটা রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দায়িত্ব। যদি কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তার প্রমাণসহ রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত আপত্তি দিতে পারেন। তখন রিটার্নিং কর্মকর্তাকে যে ক্ষমতা দেয়া আছে, সে অনুযায়ী তিনি ব্যবস্থা নেবেন। যেখানে কমিশনের প্রয়োজন, তা কমিশনে রেফার করলে কমিশন ব্যবস্থা নেবে।